odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 29th October 2025, ২৯th October ২০২৫

বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী কোটার উদাসীনতা: ন্যায়বিচারের নীরব লড়াই

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২৯ October ২০২৫ ২০:৪৮

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২৯ October ২০২৫ ২০:৪৮

উপসম্পাদকীয়

১৯৭২ সাল থেকে নির্ধারিত সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত কোটা আজও বাস্তবে কার্যকর হয়নি। দীর্ঘ আইনি সংগ্রাম, আদালতের নির্দেশনা এবং মানবাধিকার আন্দোলনের মধ্যেও কোটার বাস্তবায়ন আজও অনিশ্চয়তায়। এই সম্পাদকীয়তে বিশ্লেষণ করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী কর্মসংস্থান নীতির বাস্তব চ্যালেঞ্জ, কাঠামোগত বৈষম্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থানের সম্ভাব্য সমাধান।

চাকরি ও কর্মসংস্থানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কোটার সূচনা

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কোটা ধারণাটি মূলত বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের একটি ধারাবাহিক ফল, যার প্রধান লক্ষ্য সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সমান সুযোগ, মর্যাদা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বা নীতিগত উদ্যোগ নয়, বরং একটি মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক আন্দোলনের রূপ, যা কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও নাগরিক অধিকার—সবক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে সচেষ্ট।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলন ২০শ শতাব্দীর শেষভাগে শক্তিশালী রূপ পায়। এই আন্দোলন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও বাসস্থানসহ মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। এর ফলেই বিভিন্ন দেশে ধীরে ধীরে সরকারি চাকরি ও শিক্ষা খাতে কোটা সংরক্ষণ বা রিজার্ভেশন নীতি প্রবর্তিত হয়—যা বৈষম্য কমাতে এবং সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

প্রতিবন্ধী কোটা কেবল একটি দেশের নীতি নয়, বরং একটি বৈশ্বিক মানবিক আন্দোলনের অংশ, যার লক্ষ্য হলো—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটি বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা।

এই আন্দোলনের সারকথা হলো—সমাজে কোনো মানুষ যেন তার শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতার কারণে পিছিয়ে না পড়ে। অন্তর্ভুক্তি কেবল সুযোগের বণ্টন নয়, এটি মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক উন্নয়নের নিশ্চয়তা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোটা ব্যবস্থা

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান, ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে কোটা ব্যবস্থা এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি উদ্যোগ হলেও এর বাস্তবায়ন আজও সীমাবদ্ধতার আবরণে ঢাকা। স্বাধীনতার পর থেকেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে প্রতিবন্ধীদের সক্ষমতা যেন এক প্রান্তিক সত্য—যাকে স্বীকৃতি দিতে সরকার ও সমাজ বারবার পিছিয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা চালু হলেও, দীর্ঘ ২৫ বছর পর ১৯৯৭ সালে এতিমদের সঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১০% কোটা সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সেই সুযোগ এলো আরও দেরিতে—২০১২ সালে, হাইকোর্টের নির্দেশের পর, যেখানে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য ১% কোটা নির্ধারিত হয়।

এর পেছনে ছিল এক দীর্ঘ সংগ্রাম। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আইনজীবী ও কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগের দাবিতে। কারণ, ততকালীন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের শিডিউল ৩ অনুযায়ী প্রতিবন্ধীরা সরকারি ক্যাডার পদের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতো। হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ২০ মার্চ থেকে সেই অযৌক্তিক বাধা ভেঙে যায়। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিসিএস পরীক্ষা উন্মুক্ত হয়, এবং ১% কোটা সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক হয়। সেটিই ছিল বাংলাদেশের প্রশাসনিক ইতিহাসে প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক জয়।

কিন্তু ইতিহাসের সেই অর্জন আজও বাস্তব রূপে প্রতিফলিত হয়নি। ২০১২ সালের ৩৩তম বিসিএস থেকে শুরু করে ৪৪তম বিসিএস পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাতেই প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য ১% কোটা বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ যখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ হয়নি, তখন ২৩তম ও ৩২তম বিশেষ বিসিএসের মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী কোটার ক্ষেত্রে কেন সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি, তার উত্তর আজও অজানা। এমনকি বিসিএস পরীক্ষার কাঠামোগত জটিলতাও প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীরা শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর দেন, কিন্তু এমসিকিউ পরীক্ষায় যেখানে নেগেটিভ মার্কিং চালু, সেখানে শ্রুতি লেখকের ভুল বা বোঝাপড়ার ঘাটতি তাদের জন্য মাইনাস নম্বর বয়ে আনে। অর্থাৎ প্রতিযোগিতা সেখানে সমান নয়, বরং বৈষম্যের ভারেই ভারসাম্যহীন।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান আরও হতাশাজনক। ৪৭তম বিসিএসে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ১০ হাজার ৬০০ জন প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। উত্তীর্ণের হার ২.৮%। এমন কঠিন প্রতিযোগিতায় যেখানে সাধারণ প্রার্থীরাই হোঁচট খান, সেখানে শারীরিক সীমাবদ্ধতা ও কাঠামোগত বৈষম্যের ভার বইতে থাকা প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের অবস্থান কতটা দুরূহ, তা সহজেই অনুমেয়।

সরকারের দাবি, প্রতিবন্ধী কোটা বাতিল হয়নি—কিন্তু বাস্তবে নিয়োগের ফলাফলে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বরং কোটা বাতিল আন্দোলনের পর থেকে এই ব্যবস্থা আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। আদালতে থাকা পুরোনো রিটগুলো বছরের পর বছর শুনানির অপেক্ষায় পড়ে আছে। যেন রাষ্ট্রের সচেতন নীরবতা প্রতিবন্ধীদের অধিকারকে আইনি গোলকধাঁধায় আটকে রেখেছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি পিএসসির বিমাতাসুলভ আচরণের আরেকটি নজির ৩৪তম বিসিএস পরীঢক্ষায় উত্তীর্ণ প্রতিবন্ধী মেধাবীদের ক্যাডার না দেওয়া। বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর হাইকোর্ট প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিসিএস নিয়োগে কোটা বিধি অনুসরণের বিষয়ে এক ঐতিহাসিক রুল জারি করে। আদালত জানতে চান, নির্ধারিত ১ শতাংশ কোটা অনুযায়ী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের কেন নিয়োগ দেওয়া হবে না। ৩৪তম বিসিএসে অংশ নেওয়া পাঁচজন প্রতিবন্ধী প্রার্থী সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও নন-ক্যাডারে নিয়োগ পেয়ে এই রিট দায়ের করেন। আদালতে রিটকারীদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার শফিকুল ইসলাম। রিটে উল্লেখ করা হয়, আইনে সমান সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি, যা সংবিধানের ২৬, ২৭, ২৯ ও ৪০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। এই রুলের মাধ্যমে আদালত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়োগে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য প্রশাসনের দায়িত্ব পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়, যদিও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি।

তবুও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা হাল ছাড়েননি। তারা এখনও আশাবাদী, একদিন রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসন সত্যিই ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন’-এর ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেবে—যেখানে অক্ষমতা নয়, সক্ষমতাই হবে মর্যাদার মানদণ্ড। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিবন্ধী কোটা ব্যবস্থা কেবল একটি নীতির বিষয় নয়, এটি এক নৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রতীক—যে প্রতিশ্রুতি বলে, “রাষ্ট্র সবার।” আজ সেই প্রতিশ্রুতিই আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠার অপেক্ষায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও নীতিগত প্রস্তাবনা

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আইনি কাঠামো বিদ্যমান থাকলেও বাস্তবায়নের ঘাটতি স্পষ্ট। ২০১৩ সালের “প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন” এবং সরকারি চাকরিতে ১% কোটা ব্যবস্থা এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলেও, এর কার্যকর প্রয়োগ ও নিয়মিত তদারকি এখনো পর্যাপ্ত নয়। কর্মসংস্থানকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হলে শুধু আইন নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক মনিটরিং, অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং সামাজিক সচেতনতার সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি। নিচে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি নীতিগত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হলো:

আইনগত কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ: কেবল কোটা ঘোষণাই যথেষ্ট নয়—বাস্তবে তা পূরণ এবং অনুসরণ-পরীক্ষা করা জরুরি।

অ্যাক্সেসিবিলিটি স্ট্যান্ডার্ড ঘোষণা ও আর্থিক সহায়তা: কাজের স্থান, পরিবহন ও প্রযুক্তি অভিযোজনের জন্য সরকারি ভর্তুকি বাড়ানো।

বেসরকারি খাতে প্রণোদনা ও সাবসিডি: কর-ছাড় বা স্টিমুলাস দিয়েই বড় কর্পোরেটগুলোকে প্রতিবন্ধী নিয়োগে উদ্বুদ্ধ করা।

দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র ও ভোকেশনাল ট্রেনিং: স্থানীয় ভাষা ও বাজার-উপযোগী দক্ষতায় বিনিয়োগ।

জনসচেতনতা ও স্টিগমা-হারানো কার্যক্রম: মিডিয়া, স্কুল ও কর্পোরেটে নিয়মিত কর্মশালা।

রিপোর্টিং ও ডেটা সংগ্রহ: প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান সম্পর্কিত নির্ভুল ডেটা সংগ্রহ করা যাতে নীতির কার্যকারিতা পরিমাপ করা যায়।

কাঠামো, অভিপ্রায় ও মানবিক বিবেচনা

কোটা, বাধ্যবাধকতা ও আর্থিক প্রণোদনা—এসব কেবল ‘সংখ্যা’ বাড়ায়; প্রকৃত ক্ষমতায়ন তখনই অর্জিত হবে যখন কাজের পরিবেশ, সংস্কৃতি ও সুযোগের মান পরিবর্তন করা হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা জানায়: আইন যদি বাস্তবে রূপ নেয়; নিয়োগ কেবল সংখ্যার পরিবর্তে স্থায়ী কর্মসংস্থানের দিকে যায়; এবং কর্পোরেট সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়—তখন কোটা নীতি এক কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে যদি নীতিগত বিপর্যয় ও বাস্তবায়নের ফাঁক মেটানো যায়, তবে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কর্মক্ষেত্র সত্যিকারের সমঅধিকার ও মর্যাদার স্থান হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত নীতিমালা, যেখানে আইনি প্রয়োগ, প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ, অ্যাক্সেসিবিলিটি, ও জনসচেতনতা—সব উপাদান একসাথে কাজ করবে। এই বহুমাত্রিক পদ্ধতিই টেকসই অন্তর্ভুক্তির পথে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হতে পারে।

বাংলাদেশে যদি কোটা বাস্তবায়নের ঘাটতি দূর করা যায়, কর্মক্ষেত্র ও গণপরিসরে অ্যাক্সেসিবিলিটি নিশ্চিত হয়, এবং বেসরকারি খাতকে প্রণোদনার মাধ্যমে সক্রিয় অংশীদার করা যায়—তবে আমরা প্রকৃত অর্থেই অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থানের পথে অগ্রসর হব।

✍️ অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

আরো পড়ুন: 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: