odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Monday, 8th December 2025, ৮th December ২০২৫
অপমানের ভ্রান্তি, মনের ময়লা সাফ করার আর লালনের সত্য দর্শন সম্পর্কে জানতে হবে। লোক দেখানো বাউল সেজে মনোযোগ আকর্ষণ, লালনের দর্শনকে বিকৃত করা ও ব্যবসার ফাঁদ। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় লালন সাঁইয়ের মূল বার্তা কী? এ বিষয়ে ইসলামের শিক্ষাই বা কি?

লোক দেখানো বাউলগিরি ও বাউল বেশে ভণ্ডামি: লালনের নামে ব্যবসা, ইসলামের প্রতি অসম্মান ও লালনের সত্য দর্শন এবং ইসলামের আসল শিক্ষাবাণী

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ৭ December ২০২৫ ২৩:৩৭

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ৭ December ২০২৫ ২৩:৩৭

অধিকারপত্র গবেষণাধর্মী ধারাবাহিক ফিচার সিরিজ “লালনকে জানুন: বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকুন” (প্রথম পর্ব)

এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে কীভাবে কিছু লোক বাউল সেজে লালন শাহের নাম ব্যবহার করে ইসলাম বা অন্য ধর্মকে অপমান করে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের চেষ্টা করে। বিশ্লেষণ করা হয়েছে— লালনের আসল দর্শন ছিল সকল ধর্মের প্রতি সম্মান ও সম্প্রীতি। তাঁর অনুসারীদের জন্য তাঁর প্রকৃত উপদেশ কী ছিল? অপরদিকে ইসলাম শান্তির বিধান। এরূপ সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি সৃষ্টির প্রয়াসকারীদের প্রতি করণীয় সম্পর্কে ইসলাম কি শিক্ষা দেয়?

লোক দেখানো বাউল: ভেতরের ফাঁকা আওয়াজ

আসল বাউল আর লোক দেখানো বাউলের মধ্যে পার্থক্য বোঝা এখন মুশকিল। লালন সাঁইয়ের সময়ে বাউল হওয়া ছিল এক কঠোর সাধনা। এর জন্য চাইত বৈরাগ্য, বিনয় আর মানুষের প্রতি অগাধ প্রেম। কিন্তু এখন?  একতারা হাতে, লম্বা আলখাল্লা পরে, আর দু'চারটে লালনের গান গেয়ে দিলেই অনেকে নিজেদের 'বাউল' বলে দাবি করেন। এদের চোখে থাকে না সেই আত্ম-অনুসন্ধানের আলো, থাকে শুধু 'লোক দেখানো' আর 'মনোযোগ আকর্ষণের' তীব্র বাসনা। তাদের কাছে বাউল বেশভূষা একটি ফ্যাশন, একটি ব্যবসার কৌশল। এরা ভুলে যায়, বাউল ধর্ম হলো—ধর্ম, বাইরের সাজসজ্জা দেখানোর ধর্ম নয়। লালন সাঁই তাঁর শিষ্যদের বলতেন, "ভেতরে যার সাধনা নেই, বাইরে তার হাজার ঢাকঢোলে কী আসে যায়!"

ইসলামকে অপমান করে সস্তা জনপ্রিয়তা!

সাম্প্রতিক কালে দেখা যায়, কিছু লোক বাউলের নাম ভাঙিয়ে বা লালনের গানকে ভুল ব্যাখ্যা করে ইসলাম ধর্মসহ অন্য কোনো ধর্মকে উদ্দেশ্য করে কুরুচিকর মন্তব্য করে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে চাইছে। তাদের এই কাজ সমাজের শান্তি ও সম্প্রীতিকে নষ্ট করে। প্রশ্ন হলো: লালন কি এমন শিক্ষা দিয়ে গেছেন?

লালন সাঁইজীর দর্শন ছিল অসাম্প্রদায়িক, কিন্তু তা কখনোই কোনো ধর্মকে অপমান করার শিক্ষা দেয়নি। তিনি সব সময় বলেছেন: “যদি সুন্নত দিয়ে হয় মুসলমান, নারীর তবে কি হয় বিধান, বামন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামণি চিনি কিসের রে।” এই গানে তিনি কোনো ধর্মকে আক্রমণ করেননি, বরং ধর্মের বাহ্যিক চিহ্নগুলো মানুষের আসল পরিচয় হতে পারে না— সেই সত্যটি তুলে ধরেছেন। লালন সাঁই সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই 'মানুষ রতন' বা স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজেছেন। তাই, কোনো বাউলের মুখে যদি ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মকে নিয়ে কটূক্তি শোনেন, তবে নিশ্চিত থাকুন— সে লালনের অনুসারী নয়, সে কেবলই ভণ্ড।

আরো পড়ুন লালনকে জানুন: বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকুন। ‘অধিকারপত্র’ শুরু করলো নতুন গবেষণাধর্মী সিরিজ। জানুন কেন বাউলিয়ানা আজ ব্যবসার হাতিয়ার? এই সিরিজ ভেদাভেদ ভাঙার, চোখ খুলে দেওয়ার, মনুষ্যত্বে ফেরার আহ্বান। সম্পূর্ণ পড়ুন কেননা এই সময়ে প্রয়োজন সত্যিকারের লালনকে চেনা। কারণ বিভ্রান্তির অন্ধকারে মানুষের চোখ, কিন্তু সত্যের আলো বড়ই ক্ষীণ। আপনার সচেতনতাই বদলে দিতে পারে সমাজের আলো।

লালনকে ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহার: গানের বিকৃতি

লালন সাঁইয়ের গানের আবেদন এতটাই তীব্র যে, এটি খুব সহজেই মানুষকে আকর্ষণ করে। কিছু বাণিজ্যিক গোষ্ঠী ও তথাকথিত 'শিল্পী' এই সুযোগের অপব্যবহার করছে।

  • গানের বিকৃতি: লালনের গভীর তত্ত্বমূলক গানগুলোকে স্রেফ একটি প্রেমের গান বা সস্তা বিনোদন হিসেবে পরিবেশন করা হচ্ছে। গানের মূল দর্শন বা 'তত্ত্বকথা' বাদ দিয়ে কেবল সুর আর তালকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
  • ব্যক্তিগত প্রচার: লালনের নাম ব্যবহার করে নিজেদের খ্যাতি ও অর্থ উপার্জনের পথ তৈরি করছে।
  • ধর্মীয় বিভেদ উসকে দেওয়া: কখনও কখনও লালনের দর্শনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে দুই ধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে বিতর্ক তৈরি করা হয়, যাতে প্রচারের আলো তাদের ওপর পড়ে।

এইসব ব্যবসায়িক কাজে লালনের আসল বাণীসাম্য, প্রেম, আর মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে। এটি লালন শাহের প্রতি চরম অসম্মান।

ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অন্য ধর্মকে সম্মান জানাতে লালনের আসল মতবাদ (বাউলদের প্রতি নির্দেশনা)

লালন সাঁইজীর মূল বাণী ছিল সম্মান, সহনশীলতা এবং সম্প্রীতি। তিনি তাঁর অনুসারীদের জন্য যে নির্দেশনা রেখে গেছেন, তার নির্যাস হলো:

ক. সহনশীলতা স্বাধীনতা: লালন সাঁই বলেছিলেন: “যার যার ধর্ম সেই সেই করে, তোমার বলা অকারণ...”। এ বিষয়ে বাউলদের প্রতি নির্দেশ হচ্ছে, অন্য ধর্মের মানুষ কী করছে, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, তাদের স্বাধীনতাকে সম্মান জানাতে হবে। নিজের সাধনায় মগ্ন থাকো।

. মানব ধর্মই আসল ধর্ম : লালন সব সময় মানুষের চেয়ে বড় কিছু এই জগতে নেই— এই কথাটি বলেছেন। “এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে। যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান/জাতি-গোত্র নাহি রবে।।” আর বাউলদের প্রতি নির্দেশ হচ্ছে, মানুষের প্রতি মানুষের শোষণ, অবিচার ও অবজ্ঞা দূর করাই হবে তোমার প্রধান ধর্ম। তুমি বাউল মানেই তুমি মানুষের সেবক।

. সব ধর্মের মূলে এক: উপমার মাধ্যমে লালন বোঝাতেন, ধর্মগুলো আলাদা হলেও তাদের মূল উৎস এক: “গর্তে গেলে কুপ জল হয়, গঙ্গায় গেলে গঙ্গাজল হয়, মূলের এক জল, সে যে ভিন্ন নয়, ভিন্ন জানায় পাত্র অনুসারে।” বাউলদের প্রতি কঠোরভাবে পকির রালনের নির্দেশনা “অন্য ধর্মকে সম্মান করো, কারণ তুমি জানো, তাদের 'পাত্র' আলাদা হলেও, ভেতরের 'জল' আসলে একই। কাউকে ছোট না করে, সব ধর্মের ভালো দিকগুলো থেকে শিক্ষা নাও।”

শান্তির জীবনবিধান ইসলামের নির্দেশনা কি? সহনশীলতা ও ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা

বর্তমানে বাংলাদেশে একটি অনভিপ্রেত প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, তথাকথিত কিছু আদর্শবিচ্যুত বাউল ইসলামের অপব্যাখ্যা এবং অপপ্রচারের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপপ্রয়াসে লিপ্ত, যা প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলিমের হৃদয়ে আঘাত হানে। তবে এই স্পর্শকাতর পরিস্থিতিকে পুঁজি করে একদল 'ধর্ম ব্যবসায়ী' সাধারণ মুসলিমদের উসকে দিয়ে দেশের ধর্মীয় সংহতি ধূলিসাৎ করতে চাইছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই উত্তেজনার ফাঁদে পা দেওয়া মানেই মহাবিপদকে আমন্ত্রণ জানানো।
 
অনেককেই নিজেদেরকে ইসলামের রক্ষক হিসেবে প্রশাণিত করার ভ্রান্ত চেষ্টায় লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। তারা বুলে যায়, বা না জানার ভান করে যে, ইসলামের হেফাজতকারী স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। ইসলাম মহান আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, এই দ্বীনের হেফাজতের দায়িত্ব স্বয়ং তাঁর; আর আল্লাহ কখনও তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ ও তাঁর প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া মানেই পরকালীন ভয়াবহ শাস্তির দিকে নিজেকে ঠেলে দেওয়া। আবেগপ্রবণ হয়ে আইন হাতে তুলে নেওয়া বা সহিংস হওয়া কোনোভাবেই নবীর শিক্ষা হতে পারে না।
 
আমরা মহানবীর উম্মত হিসেবে, আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে বর্তমানের জন্য ইতিহাস থেকে তথা মহানবীর জীবন তেকে শিক্ষা নিতে হবে। শুধু নিলেই হবে না, আমলে সালেহি বা কর্মে দেখাতে হবে। দু:খজনকভাবে তা খুব কমউ আমাদের সমাজে দেখা যায়। আমরা কি ভুলে গেছি তায়েফ নগরীর সেই ঐতিহাসিক ধৈর্য ও ক্ষমার কথা? কাফিরদের চরম নির্যাতনের মুখেও আমাদের নবী (সা.) অভিশাপ না দিয়ে হেদায়েতের দোয়া করেছিলেন। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে মানিকগঞ্জের অপ্রীতিকর ঘটনা এবং আবুল সরকারের গ্রেফতারের বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা নিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহার যথাযথই বলেছেন: “সহিংসতা ইসলামের পথ নয়। যারা নিরীহ মানুষের ওপর জুলুম করে, সহিংসতা করে, তারা কখনোই রাসুলের উম্মত হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারে না” (দৈনিক প্রথম আলো, ২৪ নভেম্বর ২০২৫)।
 
তাহলে শেষ নবীর উম্মত হিসেবে আমাদের করণীয় কি? যেহেতু ইসলামের পথ মানেই ত্যাগ ও সংযমের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি, সেহেতুআমাদেরকে ইসলামে শেখানো পথেই হাটতে হবে। একজন প্রকৃত মুসলিম হিসেবে এই সংকটকালে আমাদের সর্বোচ্চ ধৈর্য ও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কোনো গুজবে কান না দিয়ে আসল তথ্য যাচাই করতে হবে। নবীর শিক্ষা—ধৈর্য, ক্ষমা এবং ইনসাফ—বিস্মৃত হওয়া চলবে না। ইসলামের মর্যাদা রক্ষায় উগ্রতা নয়, বরং সংযত আচরণ এবং আদর্শিক দৃঢ়তাই আমাদের প্রধান হাতিয়ার হওয়া উচিত।

তাহলে প্রশ্ন আসল বাউল চিনবো কেমনে?

এটা খুবই কঠিন একটি বিষয়। তবে লালনের মতে মন দিয়ে চেনো আসল ফকির। আসলে, লোক দেখানো বাউল আর ব্যবসায়ী চক্র যখন লালনের নাম ব্যবহার করে ইসলাম বা অন্য ধর্মকে অপমান করে, তখন তারা লালনের মানবতাবাদী দর্শনকেই সবার আগে অপমান করে। লালনের অনুসারী হতে হলে পোশাক নয়, চাই মন। চাই ভেদাভেদহীন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার। সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখানোই হলো ফকির লালন সাঁইয়ের প্রতি শ্রেষ্ঠ সম্মান। তাই, আসুন, আমরা লোক দেখানো বাউলদের বর্জন করি, আর লালন সাঁইয়ের এই সহজ-সরল কিন্তু গভীর শিক্ষাটিকে নিজেদের জীবনে ধারণ করি।
 
আমাদের দেশের মাটিতে বাউল ধারা শুধু গান নয়—একটা জীবনদর্শন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত এক প্রবণতা: লোক দেখানো বাউল, মঞ্চসাজানো আধ্যাত্মিকতা, এবং ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মকে অপমান করে ভাইরাল হবার সস্তা চেষ্টা। যে বাউলদের পথ একদিন ছিল গভীর সাধনার, তাদের একাংশ আজ যেন রোদনিং হাটের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মনোযোগ টানার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। দু’চারটা শব্দ খোঁচা দেওয়া, ধর্মকে ব্যঙ্গ করা, কিংবা লালনের নাম ব্যবহার করে ভাইরাল হওয়া—এগুলোই যেন নতুন “বাইল-সংস্কৃতি”। কিন্তু গল্পের নায়ক এখানে অন্য কেউ—“লালন ফকির”—যিনি জীবনে কখনোই ধর্ম অবমাননা বা অন্যকে আঘাত দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। তিনি যদিও কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামিকে সমর্থন করেননি, তবু অন্যের বিশ্বাসকে সম্মান দিতে শিখিয়েছেন। এটাই তাঁর দর্শনের মূল প্রাণ। আর মন দিয়ে আসল ফকিরকে চিনতে একটি গল্প বলি, মনোযোগ দিয়ে পড়ুন:

আসল ফকির চেনার গল্প

এক গল্প দিয়ে শুরু করা যাক…এক প্রত্যন্ত এলাকায় একটি গ্রামের এক পাড়া। গাঁয়ের হাটে নেমে এসেছে এক তথাকথিত ‘বাউল গুরু’। তার হাতে একতারা, কিন্তু সুরের চেয়ে বেশি ধার আছে তার কথায়। মাইকে চেঁচিয়ে বলছে— “ধর্ম মানলে মানুষ খুঁজে পায় না মুক্তি! সবই প্রতারণা!” লোকজন জড়ো হলো। কেউ হাসলো, কেউ ভিডিও করলো। গুরু খুশি—ভাইরাল হতে চলেছে। এরই মাঝে সামনে দাঁড়ানো এক বয়স্ক মানুষ চুপ করে বললেন— “বাবা, লালন যেন এসব বলতেন?” মুহূর্তেই হাওয়া বদলে গেল। কারণ সত্যিটা খুব সরল— লালনের দর্শন কখনোই ধর্মবিদ্বেষী ছিল না, বরং ধর্মের আড়ালে মানুষকে খোঁজার পথ।

বাউল বিভ্রান্তি সম্পর্কে আরেকটি গল্পঘন সহজপাঠ

আমাদের গ্রামে মস্তান ফকির (ছদ্ম নাম) নামে এক ব্যক্তি আছেন। হাতে তাঁর একতারা, গলায় লালনের গান, আর কথাবার্তায় মাটির গন্ধ। তিনি গল্প বলতে বলতে এমনভাবে সত্যকে সাজিয়ে দেন যে শোনার সময় মনে হয় সব ঠিকই আছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা প্রশ্ন থেকে যায়—আজকের কিছু বাউলরা আসলে লালনের পথ কতটুকু ধরে রাখছেন?
 
চায়ের দোকানে বসে একদিন এই নিয়েই তর্ক বেধে গেল। পাশের টেবিল থেকে রঞ্জু বলল, “দেখেছো, এখন কিছু বাউল গান গেয়ে এমনভাবে ইসলামকে খোঁচা দেয়, যেন ধর্মটাই তাদের শত্রু!” মস্তান ফকির হাসলেন ধীরে। “সব বাউল এক রকম নয় রঞ্জু। কিছু লোক নিজের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বাউল পরিচয় বিক্রি করে। আর লালনকে ব্যবহার করে কথা বাড়ায়। লালন নিজে কিন্তু কখনো ধর্মকে ছোট করেননি।”
 
সময়ে সময়ে এই দেশে অনেক বিভ্রান্তির বীজ রোপিত হয়েছে। এইরকম একটা হচ্ছে, বাউল মানেই ‘ধর্মবিরোধী’—তাহলে প্রশ্ন আসে, এই ভুল ধারণা কোথা থেকে? যে কোনো চর্চাই যখন জনপ্রিয় হয়, তখন তার পাশে ছায়ার মতো জন্ম নেয় বিভ্রান্তি। বাউল পথও ব্যতিক্রম নয়। আজকের কিছু তথাকথিত বাউল নিজেদের প্রকাশের স্বাধীনতা দেখাতে গিয়ে, বা গানকে একটু ‘হইচই’ করার জন্য, ধর্মের প্রতি বিদ্রূপ ছুঁড়ে দেন। এতে শ্রোতার মনোযোগ জোটে ঠিকই, কিন্তু বাউল দর্শনের আসল আলোটা ঢাকা পড়ে যায়। আর বাইরে থেকে যারা শুনে, তারা ভাবে—“বাউল মানে বুঝি ধর্মবিরোধী!” কিন্তু কথাটি যত সহজে বলা হয়, সত্য তত সহজ নয়।
 
আজকের গুজবের সমাজে অনেকেই জানেন না যে, লালন ‘ধর্মবিরোধী’ ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন ধর্ম–বিভাজন বিরোধী। আজকের ভুল ব্যাখ্যা দূর করতে হলে লালনের কাছে যেতে হয়। তিনি বলতেন, “ধর্মের নাম নিয়ে মানুষে মানুষে দেয়াল তুলো না।” এটা কিন্তু কোনো ধর্মকে ছোট করার কথা নয়। বরং দৃষ্টি ছিল মানুষের দিকে। ধর্ম মানুষকে ভালো হতে শেখায়, আর ভালো হওয়ার পথে যদি কেউ দেয়াল তোলে, লালন সেই দেয়ালটাই প্রশ্ন করেছিলেন। ফকির আজিল মস্তান ফকির বলেছিলেন, “লালন কখনো ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ—কোনো ধর্মকে অপমান করেননি। তিনি শুধু বলেছিলেন, ধর্মের আড়ালে মানুষের অহংকার ও বিভাজন যেন ঢুকে না পড়ে। এটাই ছিল তাঁর সতর্কবাণী।”
 
আমাদের দেখতে হবে, আজকের কিছু বাউল কোথায় ভুল করছে? বউলের ভাষা হলো রূপকের ভাষা। তারা শরীর, মন, সমাজ আর ঈশ্বর—সবকিছুকে কবিত্বে মেশায়। কিন্তু কিছু লোক এই রূপককে অস্ত্র বানিয়ে কটূক্তি করে ফেলেন। ধর্মীয় অনুভূতি যেখানে কোমল, সেখানে ইচ্ছেমতো শব্দ নিক্ষেপ করলে তা আর দর্শন থাকে না; তা হয়ে যায় প্রচার, বা কখনো উত্তেজনা ছড়ানোর মাধ্যম। এই জায়গাতেই লালনের পথ থেকে ফাঁক তৈরি হয়। লালন বলতেন, “মানুষ গড়লে ধর্ম গড়বে। মানুষ ভাঙলে ধর্মও ভাঙবে।” এ কথার মানে হলো, সম্মান বাঁচিয়ে রেখে আলোচনার ভেতর দিয়ে পথ খুঁজতে হবে।
 
আজকের বাউলরা লাইক ফলো ইমোজির আশায় অনেকেই প্রকৃত বাউল পথের সৌন্দর্য ভুলে গেছেন। আর এই সৌন্দর্য লুক্কায়িত আছে ছিল প্রশ্নে, অপমানে নয়। বাউলরা প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন— “আমি কে? কাকে খুঁজি? কিসে বাঁধা পড়ে আছি?” এই প্রশ্নগুলো কখনো কারো বিশ্বাসকে আঘাত করার জন্য নয়। বরং নিজের অহংকার ভাঙার জন্য। যখন আজকের কিছু বাউল ভুল ব্যাখ্যার নামে ধর্মকে ছোট করেন, তখন তারা বাউল–ধর্মমতের নিজের ভিতটাই দুর্বল করে দেন। কারণ বাউলের পথ হলো মুক্তি, অপমান নয়; অনুসন্ধান, বিভাজন নয়।
 
আর তাই বলাই যায়, আবুল সরকারের মতো বাউলদের ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণাও এই বিভ্রান্তির অংশ। আজকের সমাজে ইসলাম নিয়ে যেসব ভুল কথা ছড়ায়, ঠিক সেইসব ভ্রান্তির প্রতিধ্বনি শোনা যায় কিছু আধুনিক বাউলের কথায়ও। তারা ভাবেন, রীতি বা বিধান মানলেই মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম তো মানবিকতারই পাঠ দেয়—নম্রতা, দয়া, ন্যায়, মাপ—এসবই ইসলামের ভিত। লালন নিজে মুসলিম ছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গী ছিল হিন্দু, বৌদ্ধ, সাঁওতাল, ব্রাহ্মণ, ফকির—সবাই। তিনি মানুষকে ধর্ম অনুযায়ী ছোট করেননি, বরং ধর্মকে মানুষের জীবনযাত্রার এক আলো হিসেবে দেখতেন।
 
এইবার আবারো গল্পে ফিরে আসি। মন দিয়ে শুণি মস্তান ফকিরের সহজ উপদেশ। চা–কাপের ধোঁয়া ওঠার মধ্যে ফকির একসময় বললেন, “ধর্মকে ছোট করলে কেউ বড় হয় না। আর লালনের নামে যদি কেউ এই কাজ করে, সে লালনের দরজায় দাঁড়ানোর যোগ্যতাই হারায়।” তারপর একতারা তুলে নরম গলায় গাইলেন— “সোনার মতো মানুষ গড়তে শেখো, ধর্ম তো পথ দেখায়, ঝগড়া নয়।” গান শেষ হতেই সবাই চুপ। কারণ সত্য যখন সহজ ভাষায় আসে, তখন তর্ক থেমে যায়।
 
এবার মস্তান ফকির আক্ষেপের স্বরে বলতে লাগলেন, লালনের আসল শিক্ষাই আমরা ভুলে যাচ্ছি। এখনতো দেখি, আসল শিক্ষা অনুযায়ী নিজের ভেতরকে না বদলিয়ে অন্যকেই আঘাত করতে প্রয়াস পাচ্ছে। লালনের গান, বাণী, দর্শন—যা-ই ধরুন না কেন—সবচেয়ে আগে আসে: মানুষ চেনা; নিজেকে জানা; এবং অন্যকে সম্মান করা। তিনি কখনোই বলতেন না— “ধর্ম মানো না।”তিনি বরং বলতেন—“ধর্মের নামে মানুষকে ছোট কোরো না।” এবং সবচেয়ে বড় কথা—“অন্যের বিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করো না। সেটা কোনো সাধকের ভাষা হতে পারে না”। কিন্তু আজকের অনেক লোকদেখানো বাউলরা ঠিক উল্টোটা করে। এক চুলকানি ভাষা, একটু অশ্লীল রসিকতা, আর জনপ্রিয়তার ক্ষুধা—এই তিনেই যেন তাদের বাউলগিরি শুরু, শেষ। লালনের দর্শনে অন্য ধর্মকে সম্মান—এটাই ছিল তাঁর প্রকৃত নির্দেশ।
 
লালনের যে একটা লাইন সবাই ভুলে যায়— “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবেই।” এখানে ধর্মের কথা আছে? উত্তর ‘না’। কারণ তিনি মানুষকে আগে রেখেছেন। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান—সব ধর্মেই মানবতার শিক্ষা আছে। আর লালন সেই মানবতাকেই সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। তিনি কখনোই বলেননি— “অন্য ধর্মকে অপমান করো।” বরং তিনি বলেছিলেন— “অপরকে আঘাত করা মানে নিজের পথ হারানো।”
 
লালনের নাম ব্যবসায়িকভাবে ব্যবহার—এ এক নতুন বাণিজ্য শুরু হয়েছে। আজকে লালন-মেলা, লালন-শো, লালন-ব্যাণ্ড—অনেকই আছে। সুর আছে, সাজ আছে, তকমা আছে— কিন্তু নেই লালনের সত্য চর্চা। গলায় মালা, গায়ে আলখাল্লা, হাতে একতারা থাকলেই কেউ বাউল হয় না। বাউল হওয়ার মানে— মনের দরজা খোলা, অহং ত্যাগ, মানবতাকে গ্রহণ। আজকের ব্যবসায়িক বাউলরা গান গায়, টাকা নেয়, লাইভে যায়— কিন্তু লালনের পথ? সেটা যেন পথেই পড়ে থাকে।
 
ইসলামকে আঘাত করে 'বাউল-ভাব' দেখানোর এক অদ্ভুত ভ্রান্তির শুরু হয়েছে। কিছু স্বঘোষিত বাউল আজ ইসলামকে আঘাত করা মানেই “মুক্তচিন্তা” বলে মনে করে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে কী? তারা লালনের ভাবধারা বিকৃত করে। এতে সমাজের সম্প্রীতি নষ্ট হয়। ধর্মবিদ্বেষ বাড়ে। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, অনুসারীরা ভুল ধারণায় বেড়ে ওঠে। লালন তাঁর সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে দেয়াল ভাঙতে চেয়েছিলেন। আজকের কিছু বাউল সেই দেয়াল ফের তুলে দিচ্ছেন। এটাই সবচেয়ে দুঃখজনক। মনে রাখতে হবে, লোকদেখানো বাউলগিরির দিন ফুরোবে, লালনের আলো থাকবে চিরদিন। লালন কখনো ভাইরাল হওয়ার জন্য গান লেখেননি। তিনি লিখেছেন পথ দেখাতে, মন বড় করতে। আজকের সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি যখন ভঙ্গুর, তখন লালনকে অপব্যবহার নয়—পুনরায় পাঠ দরকার। তার শিক্ষা খুব স্পষ্ট—“ধর্মের নাম করে কাউকে ছোট কোরো না। মানুষকে আগে ভালোবাসো। এবং সম্প্রীতির পথে চলো “ বাউল হওয়া মানে লোক হাসানো নয়—লোককে মানুষ পরিচয় চিনিয়ে দেওয়া।

চূড়ান্ত প্রতিফলন

লালনের পথ আজও আলো দেয়, যদি অনুসরণকারীর মন পরিষ্কার থাকে। বাউল দর্শন কখনোই ইসলামকে ছোট করার অপচেষ্টা নয়। বা কোনো ধর্মকে লজ্জায় ফেলার কৌশল নয়। এটি মানুষের ভেতরের মানুষকে খোঁজার পথ। যখন কেউ এই পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ধর্মকে ব্যঙ্গের জিনিস বানায়, তখন সে শুধু ইসলামকে নয়, বাউল দর্শনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। লালনের আসল শিক্ষা এখনো টিকে আছে— মানুষকে জানো, ধর্মকে সম্মান করো, বিভাজন নয়, মিলন খুঁজো। এই তিন কথাই আজকের ভ্রান্তি ভেদ করার চাবি। আর চাবিটা আছে আমাদের নিজেদের হাতেই।

রচনা পরিকল্পনা: অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, অধিকারপত্র ডট কম

#বাউল #লালন #ধর্মীয়সম্প্রীতি #লালনেরশিক্ষা #লোকদেখানো #বাউলতত্ত্ব #ইসলামেরপ্রতিসম্মান #LalonShah #BaulPhilosophy



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: