odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 10th December 2025, ১০th December ২০২৫
১০ ডিসেম্বরের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে: প্রান্তিক মানুষের চোখ দিয়ে পড়ুন অধিকার, বঞ্চনা, আশা ও নতুন প্রতিজ্ঞার গল্প।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট —ঝুঁকি ও সম্ভাবনার আখ্যান

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ১০ December ২০২৫ ২০:৪৫

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ১০ December ২০২৫ ২০:৪৫

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে অধিকারপত্রের বিশেষ সম্পাদকীয়

From Paper Promises to Real Lives: Bangladesh’s Human Rights Journey.

প্রতি বছরের ১০ ডিসেম্বরের সেই দিনটি যেন সময়ের কাছে দাঁড়িয়ে এক নিয়ন্ত্রক দায়িত্ব শোনায়। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা হয়তো শুধু একটি সংখ্যা; কিন্তু প্রতিবার সে দিনই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় — ১৯৪৮ সালের আজকের দিন, যখন বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের জন্য এক ঐতিহাসিক ঘোষণা গৃহীত হয়েছিল। Universal Declaration of Human Rights (UDHR) — যা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেওয়া হয়েছে “জন্মগত মর্যাদা, স্বাধীনতা, সমতা ও অধিকার” নিশ্চিতে করা হয়েছে মৌলিক প্রতিজ্ঞা।

কিন্তু শুধু কী সেই প্রতিজ্ঞাই যথেষ্ট? কাগজে লিপিবদ্ধ সেই অধিকার কি দেশের প্রতিটি কোণায়, সমাজের প্রতিটি শ্রেণিতে, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছেছে? বিশেষ করে যখন সেই দেশটি হচ্ছে হচ্ছে Bangladesh —রক্ত দিয়ে কেনা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়া একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, যেখানে সংবিধানে মানবাধিকারকে মৌলিক ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

এই নিবন্ধে আমি আপনাদের নিয়ে যেতে চাই — বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ির অন্ধকার থেকে শুরু করে শহরের চৌরাস্তা, কারখানার গরম হলরুম, নদীর পারে হারিয়ে যাওয়া একরোদ ঘর, এবং বিচারালয় ও প্রশাসনের গহীনে হেঁটে যাওয়া নীরব প্রতিজ্ঞার পথে। — আলো, দুঃখ, আশা আর শপথের গল্প।

তারেকের সকাল: স্বপ্ন আর অধিকারের গল্প

ঢাকার পুরোনো এক কাঁচাবাজারের পাশেই ছোট্ট একটি মেসে তারেক থাকে। গ্রাম তার চট্টগ্রাম, কিন্তু এখন এই শহরই তার ঠিকানা—পেশায় সে একজন গার্মেন্টস কর্মী। সূর্য ওঠার আগেই তারেকের দিন শুরু হয়, ঠিক ভোর পাঁচটায়। কিন্তু মনটা একটু খুঁতখুঁত করে, কারণ যে সামান্য মজুরি মেলে, তা দিয়ে যেন স্বপ্ন দেখা বারণ।

কিন্তু এই মজুরিটা যায় কোথায়? সে তো নিমেষে মিলিয়ে যায়—মেসের ভাড়া মেটাতে, ছোট বাচ্চার স্কুলের মাইনে দিতে, আর দিনের শেষে রাস্তার ধারের দু'টো ডাল-ভাত জোগাড় করতে।

একদিন কারখানার এক কোণে ঘটল একটি দুর্ঘটনা। একটি পুরোনো সাটার হুট করে ভেঙে পড়ল, আর তাতে এক সহকর্মী আহত হলো। তারেক দেখল, নিয়ম অনুযায়ী এই আহত শ্রমিকের চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব মালিকেরই নেওয়া উচিত। কিন্তু কী আশ্চর্য! তারেকের চোখে পড়ল, কর্তৃপক্ষ যেন বিষয়টি নিয়ে শুধু টালবাহানা করছে।

এই দৃশ্য দেখে তারেকের ভেতরে আগুন জ্বলে উঠল। বুক কেঁপে উঠল বটে, কিন্তু প্রতিবাদে তার গলা চড়ে গেল। কর্তৃপক্ষের সামনে গিয়ে সে ধীরে, অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “স্যার! আমরা তো ন্যায্য নিরাপত্তার অধিকার চাই! ঠিক আছে, আমাদের বেতন কম, আমরা মেনে নিয়েছি; কিন্তু এইটুকু নিশ্চিত করুন— কাজ করতে এসে আমাদের প্রাণটা অন্তত নিরাপদ থাকবে!”

এই কথা শোনার পর কারখানার পরিবেশ মুহূর্তে ঠান্ডা বরফের মতো জমে গেল। কেউ কোনো কথা বলছে না, যেন সবার মুখে তালা। এই নীরবতা ভাঙলেন মালিক, বাঘের মতো গর্জন করে বললেন, “চুপ! নাহলে আর কী চাস?”

ব্যস! পরের দিন থেকেই তারেকের ওপর শুরু হলো 'বিশেষ নজরদারি'। ওভারটাইমের বেতন বেমালুম কেটে নেওয়া হতো, আর যদি সে অভিযোগ করত, তবেই দেওয়া হতো মেস বদলানো বা আরও কঠিন কাজের হুমকি। তারেকের কণ্ঠস্বর যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল... তবু তার ভেতরের আশাটা মরল না!

কারখানার ভেতরের চাপা গুঞ্জন শুনে তারেকের পাশে এসে দাঁড়াল দু-চারজন সহকর্মী। সেদিন রাতে এক ফাঁকে তারা সবাই মিলে একটা ছোট ঘরে বসলো। বৈঠক শেষে তাদের একটাই সিদ্ধান্ত— ট্রেড ইউনিয়ন গড়তে হবে! তারা আবেদন করল, কিন্তু তা বাতিল হলো, উল্টো জুটল ভয় আর হুমকি।

কিন্তু তাদের মনে তখন কেবল একটাই প্রশ্ন আলোড়ন তুলল— "আমরা আমাদের পরিবারের জন্য দু'বেলা রুটি জোগাড় করি ঠিকই, তবে কি আমরা এই কারখানাতেই নিজেদের শেষ সকালটা দেখতে চাই?" একটু থেমে সহকর্মীদের চোখের দিকে তাকালো, তারপরে আবার বলতে শুরু করলো, “আমরা কি কেবলই গৃহহীন ভিখারি হয়ে মরতে চাই?”

সবাই উজ্জীবিত হলো। এবার ভাবলো, আর নয় নীরবতা। সেই রাতে তারা সকলে মিলে শপথ নিল— ন্যায্য মজুরি আর কাজের জায়গায় সুরক্ষার জন্য তারা লড়বেই! হয়তো এই পথটা খুব কঠিন হবে, সব চাওয়া সঙ্গে সঙ্গে পূরণ হবে না; কিন্তু তাদের এই লড়াইটা কেবল শান্তির ঘুমের জন্য নয়, এটা তাদের প্রাপ্য অধিকারের জন্য। হয়তো এখনই সব হবে না, কিন্তু তাদের এই লড়াইটা কেবল ঘুমের জন্য নয়, এটা তাদের জন্মগত অধিকার! ন্যায্য মজুরি আর নিরাপদ কাজের পরিবেশ প্রাপ্তি তাদের অধিকার।

রহিমার জীবন: চরের স্বপ্ন ও ভাঙা অধিকার

পদ্মা নদীর বুকে জেগে থাকা এক ধূসর চরের ওপর রহিমার বাড়ি। সাদামাটির এক ছোট্ট ঘর। এখানে বর্ষা এলেই ভয়—নদী যখন সবকিছু গ্রাস করতে আসে। আর এই চরে একটাই স্কুল, যা বন্যার সময় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই ঘরেই বেড়ে উঠেছিল রহিমা।

রহিমার কাছে পড়াশোনা শুধু একটি শখ ছিল না—সেটা ছিল তার মুক্তির চাবি। দারিদ্র্যের ঘেরাটোপ থেকে, এই চরের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ।

স্কুলটা ছিল বহু দূরে, প্রায় আট মাইল পথ। নদী পেরিয়ে, ভাঙা মাটির রাস্তা হেঁটে তাকে যেতে হতো। বর্ষার সময় রাস্তা পুরোপুরি ডুবে যেত, তখন নৌকায় পার হতে হতো। তবুও রহিমা হাল ছাড়েনি। সে জানত, এর জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে সে প্রস্তুত। সে স্বপ্ন দেখত, একদিন সে ডাক্তার হবে, মানুষের সেবা করবে।

কিন্তু, এক ভয়ানক বর্ষায় নদী ভয়ঙ্কর রূপ নিল। স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। ঠিক সেই সময়ই ঘটল মর্মান্তিক ঘটনাটি—রহিমার ছোট ভাইটি জ্বরে কাবু হয়ে পড়ল। চিকিৎসার আশায় তারা দ্রুত নৌকায় চেপে শহরের দিকে রওনা হলো। কিন্তু মাঝনদীতে ঢেউয়ের ভয় আর ভালো চিকিৎসার অভাব... ছোট্ট ভাইটিকে বাঁচানো গেল না।

সেই রাতের আতঙ্ক, সেই হারানোর ব্যথা রহিমা আজও ভুলতে পারে না। তার সাজানো পৃথিবীটা যেন এক লহমায় ভেঙে পড়ল। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন, বইয়ের পাতায় লুকানো ভবিষ্যৎ—সবকিছু ধুলোর সঙ্গে মিশে গেল।

সেদিন রহিমা বুঝেছিল—তার শৈশবের আশা, চোখে দেখা সব স্বপ্ন, আসলে শহরের আলোর নিচে থাকা মানুষদের জন্য। তাদের এই ক্ষুদ্র চরের মানুষের জন্য নয়!

তারপর? তারপর আর নতুন করে শুরু হলো না। কারণ, প্রশাসনের খাতায় এই অনুজ্জ্বল গ্রামটার যেন কোনো অস্তিত্বই ছিল না—ছিল না কোনো স্কুল, ছিল না কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ছিল শুধু ভুলভুলাইয়ার মতো রাস্তা, অস্বাস্থ্যকর ঘর আর কিছু নিরুপায় মানুষের স্মৃতি।

আজও রহিমা নদীর ধারের এক চায়ের দোকানে কাজ করে। তার হাতে এক কাপ গরম চা, মুখে কষ্টের ছাপ ঢাকা এক ফিকে হাসি। কিন্তু তার হৃদয়ে এখনও সেই নীরব কান্না, সেই তীব্র অনুপস্থিতি— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর নিরাপত্তা, যা ছিল তার জন্মগত অধিকার।

শহরে রতনের লড়াই: উঁচু-নিচুর ছায়ার সামাজিক অসমতার বিরুদ্ধে

শহরের এক কোণে, সীমানার বাইরে যে গলি—সেখানেই রতনের বাস। নোংরা নর্দমা, নিভে যাওয়া আলো, আর পিচ্ছিল রাস্তা—এই তার জগৎ। জন্ম থেকেই সে 'গারো' বা 'হরিজন' বলে চিহ্নিত; যেন এই 'নিচুত্ব' তার কম্বল, যা সে টেনে বেড়াচ্ছে আজীবন।

রতনের জন্ম এই গলিতে হলেও, তার চোখ স্বপ্ন দেখত অনেক দূরের। স্বপ্ন ছিল—পড়াশোনা। কিন্তু স্কুলে গেলে শিক্ষকরা তাকে দেখতেন আলাদা চোখে। সহপাঠীরাও বসতে চাইত না পাশে। ক্লাসরুমটা যেন হয়ে উঠেছিল অসম আত্মবিশ্বাসের এক কাঁচের দেয়াল।

শেষমেশ, একদিন সে স্কুল ছেড়ে দিল—কারণ, সমাজ যেন চিৎকার করে বলছিল: "নিচু জাতের ছেলে আবার পড়বে কী?"

কয়েক বছর পরের কথা। রতন একদিন কাজের জন্য এক কারখানার গেটে দাঁড়ালো। আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে নিজের পরিচয় দিতেই, ভেতরে থাকা মানুষটি স্পষ্ট বলে দিল: "না, তোমার মতো নিচু জাতের লোকের কাজ হবে না এখানে।"

কথাটা যেন গরম সীসার মতো তার কানে আঘাত করল। জীবিকার অধিকার, কাজ করার অধিকার—এগুলো যেন তাদের জন্য নয়!

রাতের আঁধারে রতন যখন একা আকাশ দেখে, তখন তার মনে প্রশ্ন জাগে: "আমার জাতি, আমার গায়ের রং, আমার এই গলির পরিচয়—এটাই কি আমার অপরাধ?" এই রং-ই কি তার নিয়তি?

তবুও, রতন হাল ছাড়েনি। এখন সে গাড়ি চালায়। শহরের আলোকিত পথ আর আঁধার গলির ফাঁকে সে খুঁজে নিতে চাইছে নিজের গন্তব্য। রোজ কাজ না হলেও, তার কানে একটি নীরব প্রতিজ্ঞা প্রতিধ্বনিত হয়: "আমি মানুষের মতো বাঁচব, মাথা উঁচু করে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচব।"

রতনের প্রতিদিনের এই গল্পটি আমাদের সমাজের বিবেককে এক গভীর প্রশ্ন করে যায়: একটি জাতি, একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্র—কীভাবে নিজের ভেতরের এই ভিন্নতাকে অপরাধ বানিয়ে দেয়? আর কীভাবে আমরা মুখে বলি 'সবাই সমান'—যখন জন্ম থেকেই একটি শিশুকে 'নিচু' বলে গ্রহণ করা হয় না?

ডালিমের অঙ্গীকার: মাটি ও পরিচয়ের সুর

টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়—সবুজে মোড়া এক শান্তির ঠিকানা। পাহাড়, বন আর নদীর কোলে যুগ যুগ ধরে গারোদের বসবাস। এখানে আজও বন, নদী আর মাটি যেন মানুষ আর প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন।

ডালিম, সেই গড়েরই এক লড়াকু গারো যুবক। তার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বনের অংশ—পাহাড়, নদী আর বনের গোপন পথগুলোই ছিল তাদের পরিচয়। বন ছিল তাদের প্রথম পাঠশালা, নদীর স্বচ্ছ জল ছিল তাদের পিপাসা মেটানোর উৎস, আর মাটির গন্ধ ছিল তাদের সন্তানদের হাতেখড়ি।

কিন্তু, গত কয়েক দশকে সেই ছবিটা পাল্টে গেল। বন কেটে উজাড় করা হলো, বহিরাগতরা এসে বসতি গড়ল। উন্নয়নের নামে 'রূপান্তর' ঘটল—পাহাড় কেটে বানানো হলো ফাঁকা জমি। ডালিমের পরিবারকেও একদিন হুকুম দেওয়া হলো—"ভিটা ছাড়ো!"—কারণ সেখানে সরকারের এক বড় প্রকল্প হবে।

প্রথমে তারা প্রতিরোধ করতে চাইল। কিন্তু পুলিশ আর প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসে ভয় দেখাল—"চলে যাও, নইলে..."। একদিন রাতের আঁধারে সেই ভিটায় নেমে এল আগুন—ডালিমের চোখে তখন শুধু আতঙ্ক আর বঞ্চনার ছাপ। তাদের একরত্তি মাটি, জাতিগত গৌরব, আর সাংস্কৃতিক স্মৃতি—সবই যেন এক লহমায় হারানোর পথে!

তবুও ডালিম থেমে যায়নি। তার ভেতরে এক কঠিন সংকল্প জাগল—"আমি আমার পূর্বপুরুষের মাটির জন্য দাঁড়াব। আমার সংস্কৃতি, আমার পরিচয়, আমার অধিকার—আমি কিছুতেই হারাতে দেব না।"

ডালিম হয়তো এখন কোনো বড় নেতা নয়, কিন্তু তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছে সকলে। প্রতিটি গারো যুবক, হিন্দু পরিবার এবং সেই গড়ের সকল মানুষ, যারা নিজেদের এই মাটির অংশ মনে করে—তারা আজ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

তারা গান গায়, তারা সমাবেশ করে, তারা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করে। তাদের মনে ভয় আছে বটে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে সাহস। কারণ, তাদের অহংকার আর অধিকার এই মাটির সঙ্গে গেঁথে আছে।

রাতের ছায়া ও মানুষের নীরব আর্তনাদ

গভীর রাত। শহরের কোনো এক জনমানবহীন গলিতে হঠাৎ একটি গাড়ি এসে থামল। দরজা খুলে নেমে এল কয়েকটি নীরব মুখ, যেন তাদের কোনো পরিচয় নেই। পরের দিন সকালে সংবাদপত্রে খবর বেরোল—"এক ব্যক্তি নিখোঁজ।" এই যে গুম, এই যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড—এ যেন এক আদিম নিয়মের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যে মানুষটি নেই, সে হয়তো মুছে গেছে; কিন্তু তার রেখে যাওয়া ভয়, শ্রদ্ধাহীনতা আর অন্যায়ের ছায়া সমাজের গা ঘেঁষে ঘুরে বেড়ায়। যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাদের ঘরগুলো আজও যেন এক নীরব অন্ধকারে ভরা। প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলে না, কোনো খোঁজ আজও শুরু হয় না।

অথচ আমাদের সংবিধানেই তো লেখা আছে—"জীবন, স্বাধীনতা, আর মর্যাদা।" কিন্তু সেই জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? সেই স্বাধীনতার নিশ্চয়তা কতটুকু? সেই মর্যাদার প্রতিপালন কে করবে?

আমরা যখন সকালে ঘুম ভেঙে খবরের কাগজ খুলি, তখন হয়তো আমাদের চোখে পড়ে গৃহহীন মানুষের ছবি, নদী ভাঙা নিঃস্ব পরিবারের কান্না, অথবা গারো বা হরিজনদের মতো বঞ্চিত পরিবারের জীবনচিত্র। আমরা কি কেবল দেখেই যাব? দেখেও কি আমরা নীরব থাকব?

নিরাপত্তাহীনতার গা-ছমছমে অনুভূতি, বিচারহীনতার দীর্ঘ শূন্যতা, আর পরিবারগুলোকে তাড়িয়ে বেড়ানো সামাজিক বিভ্রান্তি—এগুলো কি আমাদের কাছে শুধু খবরের কাগজের কিছু সংখ্যা? নাকি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের এক অনিবার্য অংশ হয়ে উঠেছে?

এই নীরবতা আসলে প্রতিটি মানুষকে প্রশ্ন করে যায়—আমরা কি শুধু বেঁচে আছি, নাকি মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচছি?

স্বপ্ন, প্রতিজ্ঞা এক নতুন সূর্যের আলো

আজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এই দিনটি কেবল পুরনো স্মৃতি হাতড়ানো নয়; এটি আমাদের সবার জন্য এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আমরা যে তারেক, রহিমা, রতন আর ডালিমের গল্প শুনলাম—তারা শুধু চারজন ব্যক্তি নয়। তারা হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ সেই প্রান্তিক মানুষের প্রতিচ্ছবি, যারা আজও মানবিক মর্যাদা, নিরাপত্তা, সুযোগ এবং স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমাদের রাষ্ট্র, প্রশাসন—আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার, বিচার বিভাগ—তাদের দায়িত্ব শুধু কিছু আইন তৈরি করা নয়। তাদের আসল দায়িত্ব হলো, সেই আইনকে প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অনুবাদ করা। দায়িত্ব হলো—বিচার, সাম্য, সুরক্ষা এবং প্রতিটি মানুষের প্রতি নিঃশর্ত শ্রদ্ধা নিশ্চিত করা।

শপথ: কাগজ থেকে জীবনে

আজ, এই ১০ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে, আসুন আমরা সকলে একটি বিশেষ শপথ নিই:

  • কেবল কাগজে-কলমে নয়—আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, আমাদের আচরণে, পরিবারে, সমাজে, এমনকি আমাদের প্রতিবাদেও সেই শপথকে বাঁচিয়ে রাখব।
  • অন্যায়ের মুখোমুখি হলে আমরা মুখ ফিরিয়ে নেব না। ভয়কে জয় করে আওয়াজ তুলব।
  • দমন-নির্যাতন, বৈষম্য বা সামাজিক অবিচার—যা কিছুই হোক, আমরা তার বিরুদ্ধে শব্দ করব, সোচ্চার হব।
  • প্রান্তিক, নিপীড়িত, গরিব, সংখ্যালঘু—যারা নীরব হয়ে আছে, তাদের কণ্ঠকে আমরাই আবার শব্দ দেব।
  • আইন ও ন্যায়চর্চাকে আমরা শুধু একটা 'শর্ত' মনে করব না; আমরা সেটাকে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, মর্যাদা আর নিরাপত্তার ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলব।

কারণ, একটি আদর্শ, মানবিক, সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার পথ শুধু উন্নয়নের সূচকে মাপা যায় না। সেই পথ তৈরি হয় মানুষের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি পাড়া, আর প্রতিটি সমাজে—মর্যাদা, স্বাধীনতা, সুরক্ষা আর সমতার আলো জ্বালানোর মধ্য দিয়ে।

এই দিনে, আমরা কেবল স্মরণ করছি না; আমরা একটি নতুন প্রতিজ্ঞা করছি। মানবতার নতুন ইতিহাস রচিত হোক—কাগজে নয়, মানুষের হৃদয়ে।

পরিশেষ: শপথ থেকে প্রত্যাশার পথ

মানবাধিকার কেবল কিছু আইন বা আন্তর্জাতিক চুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের প্রত্যেকের প্রতিদিনের নৈতিক দায়িত্ব।

হ্যাঁ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন এবং সাংবিধানিক কাঠামোকে বদলাতে হবে—স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ঠিক ততটাই জরুরি হলো—সমাজ, পরিবার এবং আমাদের নিজের ভেতরের দৃষ্টিভঙ্গিটাকেও পাল্টানো।

আমরা সবাই মিলে একটি গুণের ওপর ঐক্যবদ্ধ হতে পারি: অন্যায় দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেব না; ঘৃণা, বৈষম্য বা হিংসা-ভিত্তিক আচরণকে প্রশ্রয় দেব না; প্রতিবেশীর মর্যাদা ও অধিকারকে নিজের অধিকারের মতোই মনে করব।

আমাদের শপথ হোক—নারী, শিশু, শ্রমিক, সংখ্যালঘু, গরিব—যেই হোক না কেন, আমরা তার মানবিক মর্যাদা রক্ষা করব। ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সমতার জন্য আমরা প্রতিবাদী হব। দমনমূলক সংস্কৃতির বদলে সহমর্মিতা, সংহতি ও সত্যকে বাঁচিয়ে রাখব।

সংবিধানে লেখা অধিকার যদি কেবল কাগজে আটকে থাকে, তাহলে তার কোনো মূল্য নেই। কিন্তু যখন সেই অধিকার মানুষের জীবনে জায়গা পাবে—এক একটি পরিবারে, এক একটি মনের মধ্যে, এক একজন ব্যক্তির কণ্ঠে—তখনই তৈরি হবে সত্যিকারের 'মুক্তির বাংলাদেশ'।

এই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে—নয় শুধু স্মরণ বা আনুষ্ঠানিকতা, বরং এটি যথার্থ প্রতিজ্ঞার দিন। আসুন, আমরা কেবল উন্নয়নের সংখ্যা নয়, মানবিক উন্নয়ন চালু করি। প্রতিটি মানুষের জীবনে মর্যাদা, সুযোগ এবং ন্যায়ের আলো জ্বালাই। এই শপথেই—একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও সমতার আদর্শ সমাজ গড়ব আমরা সবাই মিলে। কারণ, একটি আদর্শ সমাজ গড়তে হলে শুধু আইনের কড়াকড়ি নয়; প্রয়োজন একটি মানবীয় আচরণ এবং একটি ন্যায়ের সংস্কৃতি (ন্যায়ের কর্ম)।

যখন আমরা প্রতিটি মানুষের মুখে একই প্রশ্ন শুনব: "আমার অধিকার, আমার মর্যাদা?"—আর তার উত্তরে দেখব তাদের জীবনে সেই অধিকারের প্রতিফলন, তখনই আমরা জানতে পারব, একটি জাতি হিসেবে আমরা ঠিক কতদূর এগিয়েছি।

মুক্তির স্লোগান [তারেক, রহিমা, রতন, ডালিমের কণ্ঠে]

উপরের গল্পের চরিত্রগুলোর সংগ্রাম এবং তাদের আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে এখানে একটি শক্তিশালী ও অনুপ্রেরণামূলক স্লোগান তৈরি হয়, যা মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে: "ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ ভিটা, শিক্ষার আলো— মর্যাদা মোদের অধিকার, এই বাংলায় সকল ভালো! আর নয় গুম, নয় বৈষম্য, আর নয় ভয়— মানুষের জন্য মানুষ লড়ুক, জয় হোক, জয়!"

 অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)


#মানবাধিকারের_বাংলাদেশ #HumanRightsBD #10December #UDHR #JusticeForAll #BangladeshStories #অধিকার_ভবিষ্যত #RightsNotPrivileges #EqualityForAll #মানবিক_বাংলাদেশ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: