—অধিকারপত্র ধারাবাহিক সম্পাদকীয় বিশেষ কলাম - দ্বিতীয় পর্ব
এই ফিচারের দুইটি অংশ। প্রথম অংশে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ও কাজী নজরুলের দৃষ্টিকোন থেকে এক রম্য-ব্যবচ্ছেদ। অপরদিকে দ্বিতীয় অংশে একটি কাল্পনিক গোল টেবিল আলোচনা। দ্বিতীয় অংশে দেখব: সম্প্রতি আমাদের কাল্পনিক স্টুডিওতে এক অনন্য আড্ডায় বসেছিলেন স্বয়ং বঙ্কিমবাবু, বিদ্রোহী কবি নজরুল এবং এই প্রজন্মের একজন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাদের অধিকারপত্রের উপদেষ্টা সম্পাদক মহোদয় । সেই আলোচনার নির্যাস থেকে যা বেরিয়ে এলো, তা তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
প্রথম অংশ —ঝাউবন থেকে ব্ল্যাকবোর্ড— হারানো মেধার কাব্য
বঙ্কিমচন্দ্রের সেই বিখ্যাত বনপথে কপালকুণ্ডলা জিজ্ঞেস করেছিলেন, "পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো?" আর নজরুল সেই প্রশ্নকেই টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন বিপ্লবের রণাঙ্গনে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি কোনো ছাত্র বা অভিভাবককে এই প্রশ্ন করা হয়, তবে তারা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবেন— "ভাই, পথ তো হারাইছিই, সাথে সিলেবাসটাও খুঁজে পাচ্ছি না!"
আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার যে 'দুর্দিনের যাত্রা', তাতে বঙ্কিমী রোমান্টিকতা নেই, আছে নজরুলের সেই "সিংহ-শার্দূল-শঙ্কিত" বিপথ। আজকের ফিচারে আমরা শিক্ষা ব্যবস্থার সেই গোলকধাঁধা নিয়ে এক রম্য-ব্যবচ্ছেদ করব:
- নতুন কারিকুলাম: নবকুমারের 'রান্নাবান্নার' হাতেখড়ি: বঙ্কিমচন্দ্রের 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসে নবকুমার বনবাসে গিয়ে সহযাত্রীদের রান্নাবান্নায় সাহায্য করতে গিয়েছিলেন। আমাদের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান কারিকুলাম যেন সেই নবকুমারকেই আদর্শ মেনেছে! এখনকার স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নের জটিল সূত্রের বদলে শিখছে কীভাবে আলু ভর্তা করতে হয় অথবা কীভাবে দলগতভাবে 'অভিনয়' করতে হয়। অভিভাবকরা বঙ্কিমের সেই সহযাত্রীদের মতো ভড়কে গেছেন। তারা ভাবছেন, "আমার সন্তান কি বাঘে খেল (মানে কোচিং সেন্টারে হারিয়ে গেল), নাকি আলু ভর্তার রেসিপি শিখতে গিয়ে মূল পথ হারিয়ে ফেলল?" যখন একজন অভিভাবক তাঁর সন্তানের রেজাল্ট শিটে মার্কসের বদলে 'ত্রিভুজ', 'বৃত্ত' আর 'চতুর্ভুজ' দেখেন, তখন তিনি দিকভ্রান্ত নবকুমারের মতো হয়ে পড়েন। মনে মনে বলতে চান— "ওরে ডিজিটাল কপালকুণ্ডলা! আমার সন্তান কি জ্যামিতি শিখছে নাকি জ্যামিতিক চিহ্নে পথ হারাইয়াছে?"
- নজরুলের 'তরুণ-পথিক' ও চ্যাটজিপিটি (ChatGPT): কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর প্রবন্ধে তরুণদের আহ্বান করেছিলেন রক্ত-আঁকা পথে চলতে। তিনি বলেছিলেন, "ওরে আমার রক্ত-যজ্ঞের পূজারি ভায়েরা! বল, তোরাও কি আজ সৌন্দর্যাহত রূপ-বিমূঢ় পথহারা পথিকের মতো মৌন নির্বাক চোখে চেয়ে থাকবি?" আজকের তরুণরা নজরুলের সেই আহ্বানকে একটু বেশিই আক্ষরিক অর্থে নিয়েছে। তারা এখন আর বইয়ের পাতায় সৌন্দর্যাহত হয় না; তারা বিভোর হয়ে থাকে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। তাদের 'অভয় তরবারি' হলো 'চ্যাটজিপিটি' বা 'গুগল'। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার সময় তারা নজরুলের সেই ভৈরবী মেয়ের মতো অসংকোচ দৃষ্টিতে শিক্ষকের দিকে তাকায়। শিক্ষক যখন জিজ্ঞেস করেন, "বাবা, এই লেখা কি তোমার নিজের?" ছাত্র তখন নজরুলের ঢঙে উত্তর দেয়— "মাভৈঃ! আমরা পথ হারাই নাই, আমরা শুধু এআই (AI)-এর পথে হাঁটছি!"
- কোচিং সেন্টারের কাপালিক ও জিপিএ-৫ এর বলি: নজরুলের প্রবন্ধে সেই নিদারুণ 'কাপালিক' আর 'রক্ত-পূজার মন্দিরে'র বর্ণনা ছিল। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই কাপালিকরা হলো পাড়া-মহল্লার সেই 'গ্যারান্টিড জিপিএ-৫' কোচিং সেন্টারগুলো। মন্দিরের শুভ্র বেদি যেমন রক্তে ভেসে যেত, তেমনি এই কোচিং সেন্টারগুলোর দেয়াল ভেসে যায় 'গোল্ডেন এ প্লাস' পাওয়া শিক্ষার্থীদের রঙিন পোস্টারে। অভিভাবকরা হলেন সেই 'রক্ত-পথের পথিক', যারা তাদের সন্তানদের (বলির নির্ভীক শিশু!) ভোর ছয়টায় পিঠে দশ কেজি ওজনের ব্যাগ চাপিয়ে এই কাপালিকদের মন্দিরে দিয়ে আসেন। কাপালিকরা (কোচিং মাস্টার) খড়্গ (কলম) উঁচিয়ে হুঙ্কার দেন— "তাতা থৈথৈ! আরো তিনটে ব্যাচ বাকি!" দিনশেষে যখন শিশুটি ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরে, তখন তার চোখেমুখে নজরুলের সেই "ছিন্ন-মুণ্ড খেপী বেটি"র মতো শূন্য দৃষ্টি থাকে। সে পথ হারায়নি, সে আসলে নিজের শৈশবটা হারিয়ে ফেলেছে।
- উচ্চশিক্ষা ও অগ্নিরথ —যখন গন্তব্য 'বিদেশে উচ্চশিক্ষা' — ব্রেইন ড্রেন'-এর হাহাকার : নজরুল দেখেছিলেন তরুণরা অগ্নিরথে চড়ে ঊর্ধ্বে উঠে যাচ্ছে শিব জাগাতে। তাইতো নজরুল লিখেছিলেন, "আকাশ থেকে অগ্নিরথ নেমে এল। বলিদানের তরুণরা তাতে চড়ে যখন ঊর্ধ্বে – ঊর্ধ্বে – আরও ঊর্ধ্বে উঠে যেতে লাগল..." আজকের বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কাছে এই 'অগ্নিরথ' হলো আইইএলটিএস (IELTS) স্কোর আর স্টুডেন্ট ভিসা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার-পাঁচ বছরের গোলকধাঁধায় পথ ঘুরতে ঘুরতে যখন তারা দেখে দেশীয় চাকুরির বাজারটি নজরুলের সেই "সিংহ-শার্দূল-শঙ্কিত" জঙ্গল, যেখানে বাঘের বদলে 'মামু-খালু'র দাপট বেশি, তখন তারা অগ্নিরথে (বিমানে) চড়ে দূর দেশে পাড়ি দেয়। যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে তারা যেন সেই ভৈরবীকে (মাতৃভূমিকে) বলে যায়— "পথ হারাই নাই দেবী! ওই পাসপোর্ট-চিহ্নিত আকাশ-পথই আমাদের বাঁচার পথ।" প্রশ্ন থেকে যায় মেধাবী তরুণরা কেন আজ দেশান্তরী? কারণ আমাদের এই 'দুর্দিনের যাত্রী'রা বুঝতে পেরেছে, দেশের শিক্ষা ও চাকুরির বাজারে বাঘ-ভাল্লুকের চেয়েও ভয়ানক হলো 'অনিশ্চয়তা' আর 'অব্যবস্থাপনা'। নজরুল যে তেজ আর বীরত্বের কথা বলেছিলেন, সেই তেজ আজ বিদেশের মাটিতে ঘাম হয়ে ঝরছে, কারণ আমরা তাদের জন্য নিজের ঘরে কোনো সুস্থ পথ রাখতে পারিনি।
[Enjoy the 🎬 প্রোমো - অধিকারপত্র সম্পাদকীয় সিরিজ — পথিক, তুমি কি আসলেই পথ হারাইয়াছো?| বাংলা সাহিত্য × ডিজিটাল বাস্তবতা, Click on the Video link]
পরিশেষ: তবুও কি আমরা পথ হারাইয়াছি?
বঙ্কিমচন্দ্র আর নজরুলের সেই 'পথ হারানো'র দর্শন আজ শিক্ষা ব্যবস্থার পরীক্ষা আর কারিকুলামের চোরাবালিতে আটকে গেছে। তবে বাঙালি ছাত্ররা বড় অদ্ভুত। তারা জ্যামিতি না বুঝলেও জীবনের জ্যামিতি ঠিকই বুঝে নেয়। তারা ত্রিভুজ-বৃত্তের চক্করে পড়লেও শেষমেশ ইউটিউব দেখে ইঞ্জিনিয়ারিং শিখে ফেলে। তাই পরিশেষে বলা যায়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হয়তো সাময়িকভাবে পথ হারিয়েছে। কিন্তু নজরুলের সেই "বন্য-হিংস্র বীরের দল" বা আজকের লড়াকু ছাত্ররা ঠিকই জানে কীভাবে এই জগাখিচুড়ি সিস্টেমের ভেতর থেকেও নিজেদের বের করে আনতে হয়।
যদি কোনোদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয় আপনাকে জিজ্ঞেস করে, "পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো?" আপনি শুধু মুচকি হেসে বলবেন— "আমরা পথ হারাইনি স্যার, আমরা শুধু পরের কারিকুলামের জন্য 'লোডিং' মোডে আছি!"
দ্বিতীয় অংশ —একটি কাল্পনিক গোল টেবিল আলোচনা: পথ হারানো শিক্ষা ও গোলকধাঁধার যাত্রী
স্থান: আমাদের অধিকারপত্র স্টুডিও
মডারেটর: অধিকারপত্রের উপদেষ্টা সম্পাদক (আধুনিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ)
অতিথি: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কাজী নজরুল ইসলাম
সম্পাদক (অধুনিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ): নমস্কার। আজ আমাদের স্টুডিওতে এমন দু’জন পথপ্রদর্শক উপস্থিত আছেন, যাদের একটি বাক্য আমাদের পুরো জাতির দিশা হয়ে আছে। বঙ্কিমবাবু, আপনি বলেছিলেন 'পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো?'। আর নজরুল ভাই, আপনি সেই পথহারাদের হাতে মশাল তুলে দিয়েছিলেন। আজ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলাম নিয়ে যে অস্থিরতা, তাতে আমরা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা সত্যিই পথ হারিয়েছি কি না—তা নিয়েই আজকের আলোচনা।
বঙ্কিমচন্দ্র: (স্মিত হেসে চাদর সামলে নিয়ে) দেখুন সম্পাদক মহাশয়, আমার নবকুমার যখন পথ হারিয়েছিল, তখন তার সামনে অন্তত প্রকৃতি ছিল, সমুদ্রের গর্জন ছিল। সে পথ হারানো ছিল এক প্রকার আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম। কিন্তু আপনাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার নবকুমারদের দেখি সকালবেলা দশ কেজি ওজনের ঝুলি পিঠে নিয়ে রিকশার হুডের আড়ালে সূর্যদর্শন ছাড়াই বিদ্যালয়ে যায়। আমি তাদের শুষ্ক মুখ দেখে বলি— 'পথিক, তোমরা তো পথ হারাইয়াছোই, সাথে শৈশবও হারাইয়াছো।' এ কোন অরণ্য তৈরি করিয়াছেন আপনারা? যেখানে সিলেবাসের লতা-পাতায় ছাত্ররা জড়াইয়া মরে!
নজরুল: (উত্তেজনায় সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে) থামাুন বঙ্কিমদা! শুধু শৈশব হারানো নয়, এদের তো মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দেওয়ার পায়তারা চলছে। সম্পাদক সাহেব, আমি বলেছিলাম— 'আমরা পথ হারাই নাই, ঘরের পথ হারাইয়াছি'। আজকের ছাত্ররা তো ঘরের আরাম ছেড়ে এখন স্কুলের বেঞ্চে বসে আলু ভর্তা মাখানো শিখছে! আমি চেয়েছিলাম আমার তরুণরা রক্ত-যজ্ঞের পূজারি হবে, তারা তিমির বিদারী বজ্র হবে। আর আপনারা তাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন প্লাস্টিকের কাঁচি আর আর্ট পেপার? তারা কি বিপ্লব করবে নাকি হস্তশিল্পের প্রদর্শনী খুলবে? 'তাতা থৈথৈ' নাচন তো মন্দিরে হওয়ার কথা ছিল, ক্লাসরুমে কেন?
উপদেষ্টা সম্পাদক (আধুনিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ): নজরুল ভাই, শান্ত হোন। আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান বলছে 'লার্নিং বাই ডুইং' বা কাজের মাধ্যমে শেখা। আমরা তো ছাত্রদের জীবনমুখী করতে চাইছি। বঙ্কিমবাবু, আপনি তো উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, আপনি কি মনে করেন না যে শুধু মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে জগত জয় সম্ভব নয়?
বঙ্কিমচন্দ্র: (গম্ভীর স্বরে) মুখস্থ বিদ্যা আমি সমর্থন করি না। কিন্তু সম্পাদক, জ্ঞানার্জন কি কেবল রন্ধনশালা আর মাটির পুতুল বানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ? আমার কপালকুণ্ডলা বনের লতা-পাতা চিনত, কিন্তু সে জানত কোনটি ওষুধি আর কোনটি বিষ। আপনাদের বর্তমান 'ত্রিভুজ-বৃত্তের' জ্যামিতিতে ছাত্ররা কি আদৌ বিষ আর অমৃতের পার্থক্য করতে শিখছে? নাকি তারা কেবল জিপিএ-৫ নামক এক অলীক সোনার হরিণের পেছনে ছুটে মৃগয়া করছে? একেই কি আপনারা 'শিক্ষা' বলেন? এ তো ঘোরতর ব্যাঙ্গ!
নজরুল: ঠিক বলেছেন বঙ্কিমদা। এই যে কোচিং সেন্টারের 'কাপালিক'রা বসে আছে, তারা তো একেকটা শিক্ষার্থীকে বলি দিচ্ছে। সম্পাদক সাহেব, আপনার কাছে আমার প্রশ্ন— আমি যখন তরুণদের বলতাম 'অগ্নিরথ' এ চড়তে, তখন সেটা ছিল জ্ঞানের অগ্নি। আর আজ আপনাদের ছাত্ররা সেই রথে চড়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। কেন? কারণ আপনারা এই বনের বুকে রক্ত-আঁকা পথের বদলে দুর্নীতির পিচ্ছিল পথ বিছিয়ে রেখেছেন। মেধাবীরা আজ 'পথ হারানো'র ভয়ে দেশান্তরী হচ্ছে। আপনারা কি শিব জাগাবেন নাকি কঙ্কাল দিয়ে মিউজিয়াম সাজাবেন?
উপদেষ্টা সম্পাদক (আধুনিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ): আপনারা দুজনেই খুব রূঢ় সত্য বলছেন। আসলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন এক মহাসংকটে। একদিকে আমরা নতুন কারিকুলাম দিয়ে বিশ্বমানের হতে চাইছি, অন্যদিকে আমাদের পরিকাঠামো সেই কাপালিকদের যুগেই পড়ে আছে। অভিভাবকরা দিশেহারা, ছাত্ররা বিভ্রান্ত। বঙ্কিমবাবু, এই গোলকধাঁধা থেকে বেরোনোর উপায় কী?
বঙ্কিমচন্দ্র: উপায় একটাই— কৃত্রিমতা বর্জন। নবকুমার যখন পথ হারিয়েছিল, তখন সে সত্যের মুখোমুখি হয়েছিল। আপনাদের ছাত্রদেরও প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হতে দিন। শুধু পরীক্ষা আর গ্রেডের শিকল পরালে তারা কোনোদিন মানুষ হবে না। তারা হবে কেবল একেকটি রোবট, যারা পথ চেনে কিন্তু গন্তব্য জানে না।
নজরুল: আর আমি বলব— শিকল ভাঙার গান গাও। ছাত্রদের ডানা ছেঁটে দিও না। তাদের 'ভৈরবী' হতে দাও, যাতে তারা অসংকোচ দৃষ্টিতে ভুলকে ভুল বলতে পারে। শিক্ষা যেন কেবল রুটিরুজির হাটের পথ না হয়, শিক্ষা যেন হয় সিংহ-শার্দূল-শঙ্কিত কঠিন সংগ্রামের পথ। মনে রাখবেন, যারা পথ হারায় না, তারা কোনোদিন নতুন পৃথিবীও খুঁজে পায় না। কিন্তু সেই হারিয়ে যাওয়াটা যেন হয় সৃষ্টির নেশায়, ধ্বংসের নয়।
উপদেষ্টা সম্পাদক (আধুনিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ): আপনাদের দুজনকে ধন্যবাদ। বঙ্কিমবাবুর সেই প্রশ্ন আর নজরুলের সেই বজ্রবাণী আজও প্রাসঙ্গিক। শিক্ষা ব্যবস্থা পথ হারিয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলবে। তবে পথিক যদি সচেতন না হয়, তবে কাপালিকের খড়্গ আর জিপিএ-৫ এর মোহ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। আজকের মতো আলোচনা এখানেই শেষ করছি।
আলোচনার সমাপ্তি — পথিকের গন্তব্য ও আমাদের দায়: গোল টেবিল আলোচনা সমাপ্তিতে স্টুডিও-এর আলো নিভে যায়, স্টুডিওর ক্যামেরাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের সেই ধ্রুপদী জিজ্ঞাসা আর নজরুলের সেই বৈপ্লবিক হুঙ্কার স্টুডিওর চার দেয়ালে যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। আধুনিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ তথা 'অধিকারপত্র'-এর উপদেষ্টা সম্পাদক যখন আসন ছেড়ে ওঠেন, তখন তাঁর চোখেমুখে এক গভীর চিন্তার রেখা। আলোচনা শেষে বঙ্কিমচন্দ্র শান্ত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, "কৃত্রিমতা বর্জন করো।" আর নজরুল বজ্রকণ্ঠে হাঁকালেন, "শিকল ভাঙার গান গাও।" আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে এই দুই মহামানবের দর্শনের মিলন ঘটানো আজ সময়ের দাবি।
বঙ্কিম-নজরুল দ্বৈরথ বনাম আমাদের বর্তমান:
বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের দেখিয়েছেন যে, আমরা আসলে এক 'কালচারাল কনফিউশনে' আছি। আমরা না পারছি পুরোপুরি সনাতন জ্ঞান অর্জন করতে, না পারছি আধুনিকতার সাথে খাপ খাওয়াতে। অন্যদিকে নজরুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ তরুণদের 'সিংহ-শার্দূল' হওয়ার বদলে 'ভেড়া' হওয়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
তাহলে কি আমরা সত্যিই পথ হারিয়েছি?
এই প্রশ্নের উত্তরটা হয়তো আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মতোই 'মাল্টিপল চয়েস'।
- ক. আমরা পথ হারাইনি, আমরা শুধু জ্যামে আটকে আছি।
- খ. আমরা ভুল ম্যাপ (কারিকুলাম) অনুসরণ করছি।
- গ. আমরা পথ হারাতে ভালোবাসি বলেই বার বার বৃত্তাকারে ঘুরছি।
অধিকারপত্রের পর্যবেক্ষণ: শেষ গন্তব্য কোথায়?
বঙ্কিমচন্দ্রের দর্শন আর নজরুলের তেজ—এই দুইয়ের সমন্বয়েই হওয়া উচিত ছিল আমাদের শিক্ষা পথ। আমরা কি তবে সত্যিই পথ হারিয়েছি? উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে আমাদের মূল্যায়ন হলো— আমরা পথ হারাইনি, আমরা আসলে এক বিভ্রান্তিকর 'ডাইভারশনে' পড়েছি। আমরা একদিকে আধুনিক হতে চাইছি, অন্যদিকে মেধার মূল্যায়ন করতে ভুলে যাচ্ছি।
নজরুল বলেছিলেন, "আমরা পথ হারাই নাই, ঘরের পথ হারাইয়াছি, বনের পথ হারাই নাই।" আজকের শিক্ষার্থীরাও হয়তো সেই 'বনের পথ' বা টিকে থাকার লড়াইটা ঠিকই চিনে নিচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের যে 'নিরাপদ ঘর' বা স্থিতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থা দেওয়ার কথা ছিল, সেই পথটি আমরা অভিভাবক ও নীতিনির্ধারকরা হারিয়ে ফেলেছি।
প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষা যখন কেবল রুটিরুজির 'হাটের পথ' হয়ে দাঁড়ায়, তখন পথিক পথ হারাবেই। নজরুলের সেই 'অগ্নিরথ' এখন প্লেনের টিকিট হয়ে গেছে আর বঙ্কিমের 'নবকুমার' এখন ল্যাপটপের সামনে বসা এক ক্লান্ত ফ্রিল্যান্সার। কিন্তু তবুও আশার আলো এটাই যে, বাঙালি জাতি পথ হারানোকে শিল্পে রূপান্তর করতে জানে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যদি সেই কাপালিকদের (কোচিং বাণিজ্য ও ভুল নীতি) হাত থেকে বাঁচাতে হয়, তবে আমাদের ছাত্রদের আবার সেই 'বন্য-হিংস্র বীরের দল' হয়ে উঠতে হবে—যারা মুখস্থ বিদ্যার শেকল ভাঙবে এবং সৃজনশীলতার নতুন পথ খোদাই করবে।
পথিক হয়তো আজ বিভ্রান্ত, কিন্তু সে নির্বাক নয়। সে হয়তো জিপিএ-৫ এর মায়ায় কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু তার গন্তব্য আজও সেই 'শিব জাগাবার পথ'—যেখানে প্রকৃত মানুষ হওয়ার দীক্ষা পাওয়া যায়। কপালকুণ্ডলা যদি আজ আবার ফিরে আসেন, তিনি যেন আমাদের দেখে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে গর্ব করে বলতে পারেন, "না পথিক, তোমরা আর পথ হারাইয়া নাই; তোমরা তোমাদের গন্তব্য চিনিয়া লইয়াছো।"
(আপনার মতামত আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। কমেন্ট বক্সে জানান আপনার ভাবনা। তবে অনুরোধ—বিনা কারণে রিলস বা অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও শেয়ার করবেন না!)
পরের পর্ব: (চোখ রাখুন) 'পথিক, তুমি কি আসলেই পথ হারাইয়াছো?' : বিসিএস-এর গোলকধাঁধা ও বেকারত্বের মরীচিকা
- ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#CulturalShift #BengaliHeritage #SocialCritique #FeatureStory #HybridCulture #AmaderOdhikarPatra #পথ_হারানো #দুর্দিনের_যাত্রী #কপালকুণ্ডলা #নজরুল_ইসলাম #বঙ্কিমচন্দ্র #বাংলা_সাহিত্য #ডিজিটাল_বাংলাদেশ #মধ্যবিত্ত_জীবন #রাজনীতির_গোলকধাঁধা #ট্রাফিক_জ্যাম #সামাজিক_সমালোচনা #বাংলাদেশ_সমাজ #EditorialFeature #CulturalCritique #BanglaLiterature #SocialSatire #OdhikarpatraEditorial
🎵 পথিক, তুমি কি আসলেই পথ হারাইয়াছো? | Lok-Rock Satire Song | Lyric Video | অধিকারপত্র সম্পাদকীয় সিরিজ = Video link https://youtu.be/JCp5vht9wG4

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: