ঢাকা | মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

শততম টেস্ট: বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভিত কতটা শক্ত

Admin 1 | প্রকাশিত: ১৬ মার্চ ২০১৭ ২৩:২৪

Admin 1
প্রকাশিত: ১৬ মার্চ ২০১৭ ২৩:২৪

২০০০ সালের ১০ই নভেম্বর দিনটি হয়তো অনেক ক্রিকেট-প্রেমীর মনে আছে। ওইদিন বাংলাদেশ দল ঢাকার মাঠে তাদের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচটি খেলতে নেমেছিল। প্রতিপক্ষ ভারত।

শুরুটা ভালই হয়েছিল । টসে জিতেছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়। তিনি ব্যাটিং বেছে নিয়েছিলেন।

প্রথম ইনিংসে ভালই ব্যাটও করেছিলেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা। দেড় দিনেরও বেশী সময় ধরে ক্রিজে ছিলেন তারা।

সবগুলো উইকেট হারিয়ে তারা সংগ্রহ করেছিলেন ৪শ রান। ভালই।

এমনকি অভিষেক টেস্টের ইতিহাসের তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে সেঞ্চুরি করেছিলেন বাংলাদেশ দলের আমিনুল ইসলাম বুলবুল।

আউট হওয়ার আগে প্রায় নয় ঘণ্টা ধরে ক্রিজে ছিলেন তিনি। সংগ্রহ করেছিলেন ১৪৫ রান। সতেরোটি ছিল চারের মার।

তবে দ্বিতীয় ইনিংসেই পাওয়া গেলো বাংলাদেশ দলের অপরিপক্বতার পরিচয়। মোটে ৯১ রান করে অল আউট।

চতুর্থ দিনেই ম্যাচ শেষ। অবধারিত জয় পেল ভারত। ওই দিন সন্ধ্যে বেলায়ই ঢাকা ছাড়লো সফরকারীরা।

আমিনুল ইসলাম বুলবুল ক্রিকেট ব্যাট তুলে রেখেছেন বহু আগে। এখন তিনি দায়িত্ব পালন করছেন আইসিসির ক্রিকেট উন্নয়ন বিভাগে। পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন অস্ট্রেলিয়াতে।

টেলিফোনে তিনি বিবিসিকে বললেন, সেদিনকার সেই ইনিংসটি ছিল তার জীবনের 'সিগনেচার' এবং 'অ্যাকমপ্লিশমেন্ট'।

আমিনুল ইসলাম বুলবুল, বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান (ফাইল চিত্র)আমিনুল ইসলাম বুলবুল, বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান (ফাইল চিত্র)

'ডিফাইনিং মোমেন্ট':

বাংলাদেশকে আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ ও টেস্ট খেলবার অধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২৬শে জুন ২০০০ সালে, আইসিসির বোর্ড সভায়।

অনেকেই সেই স্বীকৃতি আদায়ের কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন সেসময়কার বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীকে।

মি. চৌধুরী বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার খবরটিকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলে বর্ণনা করেছিলেন সেসময়।

তার বর্ণনায় এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা কিংবা ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের ঘটনার মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্জন।

মি. চৌধুরীর ভাষায় 'ডিফাইনিং মোমেন্ট'।

আজ এতদিন পরে এসে মি. চৌধুরীকে সেদিনকার সেই বক্তব্য মনে করিয়ে দিলে, তিনি বলেন, তখন নানারকম পরিকল্পনা ছিল, ইচ্ছে ছিল, তার অনেকখানিই পরবর্তীতে বাস্তবায়ন করা যায়নি।

"আমার যে সম্ভাবনা এবং আমার যে অর্জন - এই দুটোকে যদি আমি মেলাতে যাই, তাহলে দেখব একটা বড় ব্যবধান আছে", বলেন মি. চৌধুরী।

সাবের হোসেন চৌধুরী এবং প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়াবাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী (বামে) এবং আইসিসির সাবেক সভাপতি প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়া। অনেকেই বলেন, ২০০০ সালে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়াটা যতটা না খেলার কারণে হয়েছে তার চাইতে বেশী হয়েছে রাজনৈতিক কারণে এবং সেই রাজনীতিতে এই দুজনের ভূমিকা ছিল সবচাইতে বেশী।

টেস্ট স্ট্যাটাস কি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে?

২০০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনেকেই বলে এসেছেন যে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার উপযুক্ত হবার আগেই বাংলাদেশকে সেটা দিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এটা ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

অবশ্য বাংলাদেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা এবং দেশটির ক্রিকেট ভক্তরা তা কখনই শিকার করতে চান না।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেট সংগঠক এবং এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আশরাফুল হক বলছেন, তখন বাংলাদেশ পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না হয়তো, কিন্তু তখন বাংলাদেশ দল যদি টেস্ট স্ট্যাটাস না পেত তাহলে আর কখনোই পেত না। তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেট পরবর্তীতে আরো খারাপ হতে থাকতো।

এজন্যই এত তড়িঘড়ি করা হয়েছে, বলছিলেন মি. হক।

মি. হক বলেন, "শেষ পর্যন্ত আমরা হয়তো বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে পেরেছি যে, হ্যাঁ, টেস্ট স্ট্যাটাস আমাদের প্রাপ্য ছিল"।

সাকিব আল হাসানসতেরো বছর ধরে টেস্ট খেলে মোটে আটবার জিতেছে বাংলাদেশ। এমনকি গত সপ্তাহে শেষ হওয়া ৯৯তম ম্যাচটিতেও শোচনীয় পরাজয় হয়েছে তাদের। এর কারণ কি?

অনভ্যাস নাকি অমনোযোগী:

গতকাল থেকেই কলম্বোতে শ্রীলংকার বিপক্ষে শততম টেস্ট ম্যাচটি খেলতে শুরু করেছে বাংলাদেশ।

এর আগের ৯৯টি ম্যাচের মধ্যে মোটে ৮টিতে জয়।

তার মধ্যে একমাত্র ইংল্যান্ডের সাথের জয়টিকেই শুধুমাত্র লড়াকু বিজয় বলে অভিহিত করেন বিশ্লেষকরা।

দুর্বল জিম্বাবুয়ে কিংবা খর্ব শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষের বাকী জয়গুলো ছিল অনেকটাই অবধারিত।

ব্যাপারটিকে দুর্ভাগ্যজনক বলে বর্ণনা করেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তার মতে, "দীর্ঘক্ষণ ক্রিকেট খেলার অভ্যাস আমাদের গড়ে ওঠেনি। তখনও (২০০০ সাল) ছিল না, এখনও নেই"।

ঘরোয়া লীগ, স্কুল পর্যায়ে টুর্নামেন্ট ইত্যাদি না হওয়ার কারণে খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তবে ক্রিকেট বিশ্লেষক উদয় শংকর দাস, যিনি ঢাকায় খেলা বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচটির খবর সংগ্রহ করেছিলেন বিবিসি বাংলার হয়ে, তিনি বলছেন, দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের 'মনঃসংযোগ' ও 'টেম্পারমেন্ট' প্রয়োজন, সেটার অভাব থাকার কারণেই টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছে না। যদিও খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত অর্জন আছে অনেক।

মিরপুর শেরে-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম
বাংলাদেশের 'হোম অব ক্রিকেট' বলে পরিচিত মিরপুর শেরে-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ২০০০ সালে যখন বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায়, তখন দলটির জন্য নির্ধারিত একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম পর্যন্ত ছিল না। অভিষেক টেস্টটি যে মাঠে হয়েছিল, সেটি এখন ফুটবলের জন্য নির্দিষ্ট করা।

অবশ্য বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেটে বিসিএল নামে দীর্ঘ পরিসরের একটি টুর্নামেন্ট শেষ হল কদিন আগেই, কর্মকর্তাদের বিশ্বাস তারা ফি বছর এমন টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারবেন।

ফলে আশা জেগেছে এসব টুর্নামেন্টে খেলে খেলে দেশটির ক্রিকেটাররা ভবিষ্যতে ৫ দিনের ম্যাচ অর্থাৎ টেস্ট খেলবার সামর্থ্য অর্জন করতে পারবে।

অবশ্য এর ফলাফল পেতেও অন্তত আরো তিন বছর অপেক্ষা করবার কথা বলছেন ক্রিকেট সংগঠকেরা।

ক্রিকেট দিয়েই বাংলাদেশের পরিচয়:

টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর সতেরো বছরে ক্রিকেট খেলায় উন্নতি চোখে পড়ার মতো না হলেও, ক্রিকেট দুনিয়ার রাজনীতিতে যে বাংলাদেশের গুরুত্ব বিস্তর বেড়েছে, সে কথা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই।

মি. হক বলছেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের এখন প্রধান পরিচয় ক্রিকেট দিয়েই।

আর আমিনুল ইসলাম বুলবুল, যিনি আইসিসির ক্রিকেট উন্নয়ন বিভাগের একজন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এখন তিনি বলছেন, ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন শক্তিশালী একটি জাতি।

"ক্রিকেটের দিক থেকে যদি ধরেন তাহলে বাংলাদেশকে সকলেই সমীহ করে। এই সিরিজে শ্রীলঙ্কা কিন্তু ধরে রেখেছে তারা সিরিজ জিততেও পারে, হারতেও পারে। যেটা আগে ছিল না"।

"এর কারণে কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থানও আগের চাইতে অনেক ভাল", বলছেন মি. বুলবুল।

"আইসিসিতে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভাল, বাংলাদেশের কথার গ্রহণযোগ্যতা আছে, এই অ্যাডভান্টেজগুলো যদি আমরা দেশের অভ্যন্তরে কাজে লাগাতে পারি তাহলে অবশ্যই আমরা স্থায়ী ক্রিকেট জাতিতে পরিণত হতে পারব"।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: