
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য রাজনীতিক সংগ্রামী জননেতা তোফায়েল আহমেদের আজ ৭৬তম শুভ জন্মদিন। পিতা আজহার আলী ও মাতা ফাতেমা খানমের কোল আলো করে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর দ্বীপজেলা ভোলার কোড়ালিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
পাকিস্তান শাসনামলের দ্বিতীয় বছর তথা ’৪৯-এ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হয়। একই বছর তোফায়েল আহমেদের বিদ্যালয় জীবনের সূচনা। নিজ বাড়ীর সন্নিকটে গ্রামের একটি স্কুল কোড়ালিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। এরপর খায়েরহাট জুনিয়র হাই স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বোরহানউদ্দীন হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। প্রাইমারি এবং জুনিয়র স্কুলের পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে ভালো নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে মেধার স্বাক্ষর রাখেন। রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে বিদ্যালয় জীবনের একটি ঘটনার স্মৃতি তর্পণ করে তিনি বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা আছে। ১৯৫৭ সনে ভোলায় উপনির্বাচন হয়। যে উপনির্বাচনে মতিউর রহমান শাহ বিজয়ী হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন প্রধান মন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে এসেছেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সকলের প্রিয় নেতা ‘মুজিব ভাই’। নেতৃবৃন্দ এসেছিলেন সি-প্লেনে। ইলিশা নদীতে সেই প্লেন অবতরণ করে। আমাদের স্কুল মাঠে বিশাল জনসভা। প্রায় লক্ষাধিক লোক সমবেত হয়েছিল জনসভায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বক্তৃতার আগে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন। সে কী সুন্দর বক্তৃতা! তিনি যখন বক্তৃতা শুরু করেন, পুরো জনসভায় পিনপতন নিস্তব্ধতা। মনে আছে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনেছি। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যদি কখনো রাজনীতি করি তাহলে এই নেতার রাজনীতিই করব।
ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মহানায়ক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট সংক্ষেপে বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক, সর্বোপরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য রাজনীতিক সংগ্রামী জননেতা তোফায়েল আহমেদ ১৯৬০-এ ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে এটা ছিল তাঁর জন্য বেদনাদায়ক। সেজন্য ঢাকা কলেজ ছেড়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়াকালে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অভিযাত্রার শুরু। তারপর ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ, ক্লাস ক্যাপ্টেন, স্কুল ক্যাপ্টেন, পরে যথাক্রমে ছাত্রলীগের অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি, অ্যাডমিন সেক্রেটারি, ব্রজমোহন কলেজের ক্রীড়া সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্রীড়া সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন, তারপর হলের নির্বাচিত সহ-সভাপতি, সোস্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ভিপি, ডাকসু’র ভিপি, ’৬৯-এর গণআন্দোলনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন এবং ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ’৬৭ থেকে ’৬৯ সন পর্যন্ত ডাকসু’র ভিপি থাকাকালে চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে বঙ্গবন্ধু মুজিব প্রদত্ত ৬ দফা (দাড়ি, কমা, সেমিকোলনসহ) হুবহু ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন।
উল্লেখ্য যে, ’৬৬-এর ৮ মে থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩৩ মাস কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র সকল রাজবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা বাংলায় তৃণমূল পর্যন্ত তুমুল গণআন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তিদানে স্বৈরশাসককে বাধ্য করেন। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মুক্তমানব শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর ’৬৯-এর ২৫ মার্চের মধ্যে তথাকথিত প্রবল পরাক্রমশালী লৌহমানব স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে গৌরবের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল। এরপর ’৭০-এর ৭ জুন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ভোলা-দৌলতখাঁ-তজুমুদ্দী-মনপুরা আসন থেকে বঙ্গবন্ধু তাঁকে ২৬ বছর বয়সে মনোনয়ন দেন ও নির্বাচিত হন।
ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে পাকিস্তান সামরিক শাসক গোষ্ঠীর টালবাহানার পরিপ্রেক্ষিতে ’৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বীয় বাসভবনে ৪ যুবনেতাকে-শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ-আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে জাতির জনকের পূর্বনির্দেশনা অনুযায়ী তিনি শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন ও অনুমোদন এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র সৃষ্টিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৭ এপ্রিল সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরমাকাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জনে বদ্ধপরিকর তোফায়েল আহমেদ ছিলেন ‘মুজিব বাহিনী’র অঞ্চল ভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার প্রধানের একজন। বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া ও পাবনা সমন্বয়ে গঠিত মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তোফায়েল আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন। ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠার পর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী নিযুক্ত হন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পরই তাঁকে প্রথমে গৃহবন্দি ও পরে পুলিশ কন্ট্রোল রুম এবং রেডিও অফিসে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ৩৩ মাস তিনি কারান্তরালে ছিলেন। ’৭৮-এ কুষ্টিয়া কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বাংলাদেশআওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। দীর্ঘদিন সাফল্যের সঙ্গে এই পদ অলঙ্কৃত করে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে পরপর তিনি এমপি নির্বাচিত হন।
বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার মহতী স্বপ্ন বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম সারথী সংগ্রামী নেতা তোফায়েল আহমেদের শুভ জন্মদিনে তাঁর দীর্ঘজীবন কামনা করছি আমাদের অধিকারপএের পক্ষথেকে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: