ঢাকা | রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

কল ড্রপ, টেলিকমের ‘আয়’ কোটি টাকা

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ২৫ অক্টোবর ২০১৮ ১৩:৫৫

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ২৫ অক্টোবর ২০১৮ ১৩:৫৫

কল ড্রপ সমস্যায় অতিষ্ঠ দেশের মোবাইল ব্যবহারকারীরা। আমজনতার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী নাম উল্লেখ করে টেলিকম অপারেটরগুলোর বিরুদ্ধে কল ড্রপের অভিযোগ তুলে প্রতিকার চেয়েছেন। ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নানা মাধ্যমে তারা এই অভিযোগগুলো জানিয়েছেন। এরপরেও থেমে নেই কল ড্রপের সমস্যা।

সম্প্রতি একটি টেলিকম অপারেটরের বিরুদ্ধে কল ড্রপের অভিযোগ তোলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এতে কিছুটা নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। নিয়ম থাকলেও নিয়ম না মানা এবং এক বছরে টেলিকম অপারেটরগুলোর কল ড্রপের পরিসংখ্যান নিয়ে তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে বিটিআরসি।

বিটিআরসির দেওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক বছরে (সেপ্টেম্বর ২০১৭ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত) কল ড্রপের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা আয় করেছে দেশের টেলিকম অপারেটরগুলো।

বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই এক বছরে রাষ্ট্রীয় টেলিকম অপারেটর টেলিটকসহ অন্য তিন অপারেটর প্রতি কল ড্রপের বিনিময়ে পকেটে ঢুকিয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পকেটে পুরেছে গ্রামীণফোন।

যেভাবে আয়

ধরি, প্রতি কল ড্রপে গ্রাহকরা গড়ে ১০ সেকেন্ড বঞ্চিত হন। প্রতি মিনিট কল ৪৫ পয়সা হলে প্রতি সেকেন্ডে গ্রাহককে গুনতে হয় ০.০০৭৫ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ১০ সেকেন্ডে গ্রাহক হারান ০.০৭৫ পয়সা।

সেপ্টেম্বর ২০১৭ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত গ্রামীণফোনের কল ড্রপ হয়েছে ১০৩ কোটি ৪৩ লাখ বার। এর পরের অবস্থানে রবি। এক বছরে তাদের কল ড্রপ হয়েছে ৭৬ কোটি ১৮ লাখ বার। বাংলালিংকের ৩৬ কোটি ৫৪ লাখ বার এবং টেলিটকের ছয় কোটি বার।

অর্থাৎ এই এক বছরে গ্রাহকদের মিনিট ফিরিয়ে দেওয়ার পর সর্বনিম্ন কলরেট ৪৫ পয়সা হিসেবে গ্রামীণফোনের গ্রাহকরা  হারিয়েছেন তিন কোটি ১২ লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকা, রবি গ্রাহকরা হারিয়েছেন দুই কোটি ৬৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, বাংলালিংক গ্রাহকরা হারিয়েছেন ৫১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং টেলিটক গ্রাহকরা হারিয়েছেন ৪৫ লাখ টাকা।

মোট হিসাবে এই অর্থের পরিমাণ ছয় কোটি ৭৩ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টাকা। তবে কলরেট বৃদ্ধির ওপরে এই লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে।

কার কত কল ড্রপ

বিটিআরসির প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক বছরে কল ড্রপের হার সবচেয়ে বেশি গ্রামীণফোনের। সেপ্টেম্বর ২০১৭ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত গ্রামীণফোনের কল ড্রপ হয়েছে ১০৩ কোটি ৪৩ লাখ বার। এর পরের অবস্থানে রবি। এক বছরে তাদের কল ড্রপ হয়েছে ৭৬ কোটি ১৮ লাখ বার। বাংলালিংকের ৩৬ কোটি ৫৪ লাখ বার এবং টেলিটকের ছয় কোটি বার।

হিসাব করলে দেখা যায়, গড়ে একটি অপারেটরের প্রতিদিন কল ড্রপ হয় গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রে ২৮ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি বার, রবির ক্ষেত্রে ২০ লাখ ৮৭ হাজারের বেশি বার, বাংলালিংকের ১০ লাখের বেশি বার এবং টেলিটকের দেড় লাখের বেশি বার।

কল ড্রপে কার কাছে কত মিনিট পাওয়া যায়

কল ড্রপের মাধ্যমে দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো গলা কাটছে গ্রাহকদের। বিটিআরসির পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি দুবার কল ড্রপের বিপরীতে এক মিনিট ফেরত দেওয়ার কথা অপারেটরদের। তবে বিটিআরসির এই নিয়ম মানছে না অপারেটরগুলো।

হিসাব করে দেখা যায়, গ্রামীণফোনের দুই বা এর অধিক কল ড্রপ হয়েছে মোট ২৭ কোটি ৭৭ লাখ বার। তারা দিয়েছে ১০ কোটি ৩০ লাখ মিনিট।

রবির দুই বা এর অধিক কল ড্রপ হয়েছে মোট ২৪ কোটি ৪৭ লাখ বার। তারা দিয়েছে ছয় কোটি ৮২ লাখ মিনিট।

বাংলালিংকের দুই বা এর অধিক কল ড্রপ হয়েছে মোট চার কোটি ৪৯ লাখ বার। তারা দিয়েছে চার কোটি ৯৪ লাখ মিনিট। রাষ্ট্রীয় অপারেটর টেলিটকের দুই বা এর অধিক কল ড্রপ হয়নি।

গ্রাহক হিসেবে কল ড্রপ কম বাংলালিংকের

বিটিআরসির প্রতিবেদন অনুযায়ী মোট গ্রাহক হিসেবে কল ড্রপ কম মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকের। চলতি বছরের আগস্টের মোট গ্রাহকের হিসাব অনুযায়ী গড়ে একজন বাংলালিংক ব্যবহারকারী বছরে ১০ বার কল ড্রপ সমস্যায় ভোগেন।

অপরদিকে একজন গ্রামীণফোন ব্যবহারকারী ১৪ বার, রবি ব্যবহারকারী ১৬ বার এবং টেলিটক ব্যবহারকারী ১৫ বার কল ড্রপ সমস্যায় ভোগেন।

অপারেটরগুলো কী বলছে

কল ড্রপ ইস্যুতে বাংলালিংক থেকে বক্তব্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি টেলিটকের সঙ্গে। গ্রামীণফোন, রবি তাদের বক্তব্যে কল ড্রপ সমস্যাটিকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছে।

গ্রামীণফোন বিবৃতিতে বলে, ‘রেডিও প্রযু্ক্তিনির্ভর মোবাইল সেবায় কল ড্রপ একটি স্বাভাবিক উপসর্গ। গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কে কল ড্রপের পরিমাণ সবসময়ই বিটিআরসি ও আন্তর্জাতিক নির্ধারিত মানদণ্ডের অনেক নিচে রয়েছে। গ্রাহক সংখ্যার বিচারে গ্রামীণফোনের কল ড়্রপের পরিমাণ অন্যান্য অপারেটরের তুলনায় অনেক কমই রয়েছে। তবে গ্রাহকদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে গ্রামীণফোন গ্রাহকদের কল ড়্রপের ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে।’

রবি তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘টেলিযোগাযোগ একটি ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির সেবা। এ ধরনের সেবায় কল ড্রপ খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। তবে রবি নেটওয়ার্কে কল ড্রপের পরিমাণ ১ শতাংশের কম, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ও আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) নির্ধারিত সীমার মধ্যেই আছে। যদিও বাংলাদেশে কল ড্রপ শুধু মোবাইল ফোন অপারেটরদের ওপর নির্ভর করে না। এর সঙ্গে তরঙ্গের স্বল্পতা, ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের দুর্বলতা, ইন্টারকানেকশন, গ্রাহকের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের মানের মতো অনেক বিষয় ও পক্ষ জড়িত।’

‘নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে টাওয়ার তৈরির উপযুক্ত জায়গা পাওয়া এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অপারেটরদের জন্য। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যের কারণে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ তরঙ্গ এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত অপারেটরদের তরঙ্গের স্বল্পতা পূরণ করা না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কল ড্রপ সমস্যার পুরো সমাধান করা কঠিন।’

বিটিআরসি কী ব্যবস্থা নিচ্ছে

কল ড্রপের এমন সমস্যার বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে অপারেটরদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের পরিচালক মো. গোলাম রাজ্জাক স্বাক্ষরিত অপারেটরদের প্রধানদের ‘কল ড্রপের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রাহক অসন্তুষ্টি প্রসঙ্গে’ চিঠি পাঠানো হয়।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল অপরেটরদের কল ড্রপসংক্রান্ত অভিযোগ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে চলমান জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়েছে। দিন দিন টেলিযোগাযোগ সেবার মান নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেবার মান নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে বিটিআরসির একটি অগ্রাধিকারযোগ্য কার্যক্রম। বিটিআরসি ইতোমধ্যে ড্রাইভ টেস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন অপারেটরের সেবার মান নিয়মিত পরিমাপ করছে।’

চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘গ্রাহক স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কল ড্রপের পরিমাণ বিটিআরসি কর্তৃক নির্ধারিত সীমার (২ শতাংশ) মধ্যে থাকা আবশ্যক। অপারেটর কর্তৃক দাখিলকৃত মাসিক রিপোর্টে তাদের কল ড্রপ নির্ধারিত সীমার মধ্যেই আছে দাবি করলেও সম্প্রতি এ বিষয়ে গ্রাহক পর্যায়ে অনেক অভিযোগ আছে। এ ছাড়াও কোনো কোনো অপারেটরের নেটওয়ার্কে একটি কলে চার থেকে পঁচ বার কল ড্রপ হয় বলে অভিযোগ রয়েছে, যা বাস্তবসম্মত নয়।’

‘এমতাবস্থায়, আপনার নেটওয়ার্কে সাম্প্রতিক প্রকৃত কল ড্রপের অবস্থা এবং এ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে আপনাদের ব্যাখ্যা আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে বিটিআরসি’তে প্রেরণের জেন্য নির্দেশক্রমে বলা হলো।’



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: