
ডেস্ক: হৃদপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হলে হার্ট অ্যাটাক হয়। আর মস্তিষ্কে রক্তের জোগানদারি কমে গেলে হয় ব্রেন স্ট্রোক।
কখনো কোনো ধমনী আচমকা ছিঁড়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তপাত হয়। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে বলে ‘সেরিব্রাল হেমারেজ’। এটাই ব্রেন স্ট্রোকের অন্যতম কারণ।
অনেক সময়ে কোনো কারণে ধমনী সরু হয়ে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এর ফলেও ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে। ডাক্তারি পরিভাষায় এর নাম সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস।
সেরিব্রাল হেমারেজ বা থ্রম্বোসিস কোনোটাই কিন্তু একেবারে জানান না-দিয়ে হঠাৎ করেই আসে না। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, দু’টি ক্ষেত্রেই বেশ কয়েকদিন আগে থেকে ধমনীতে রক্ত চলাচলে সমস্যার শুরু হয়। আর নিয়মিত রক্তচাপ মাপলেই ধরা পড়ে যে শরীরের ভেতরে কোথাও না কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে।
তবে বিপদের সেই গুরুতর ‘ইঙ্গিত’কে আমাদের গুরুত্ব না-দেয়ার প্রবণতাটাই চিকিৎসকদের বেশি ভাবাচ্ছে। কয়েক বছর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে রোগী, রোগীদের পরিজন ও অ-চিকিৎসক কর্মীদের ওপরে একটি ‘স্ট্রোক সচেতনতা’ সমীক্ষা চালিয়েছিলেন স্নায়ুরোগের চিকিৎসকেরা। দেখা গিয়েছে, ৬০%-৬৮% মানুষের ধারণা, স্ট্রোক হয় শুধু বুকে (অর্থাৎ হৃদযন্ত্রে)। বুক ব্যথা করে। কিন্তু তারা জানেনই না যে, এর সঙ্গে মস্তিষ্কেরও সংযোগ থাকতে পারে।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজির নিউরোমেডিসিনের চিকিৎসকেরা পাঁচ বছর ধরে বারুইপুরের রামনগরে কুড়ি হাজার মানুষের ওপরে সাধারণ স্নায়ুরোগ সম্পর্কে সমীক্ষা চালান। সমীক্ষকদের অন্যতম চিকিৎসক শঙ্করপ্রসাদ সাহা আক্ষেপ করে বলেন- স্ট্রোক জিনিসটা কী, সেটা কোথায়, কেন হয়, সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মাত্র ২০% মানুষ! স্ট্রোকের হার কমানোর পথে এটাই তো সবচেয়ে বড় বাধা।
অপরদিকে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ৯ হাজার স্ট্রোক-আক্রান্তকে নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে ‘স্ট্রোক ফাউন্ডেশন অফ বেঙ্গল।’ এতে সমীক্ষকদের অন্যতম চিকিৎসক দীপেশ মণ্ডল জানান, এ দেশে, বিশেষত এ রাজ্যে যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের ৫০% সে সম্পর্কে জ্ঞাত নন। যারা জানেন, তাদের অর্ধেক আবার চিকিৎসাই করান না, কিংবা নিয়মিত ওষুধ খান না। ফলে স্ট্রোক নিঃশব্দে থাবা বসায়। প্রায় একই আবহাওয়া আর পরিবশেগত কারণে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী দেশ আমাদের বাংলাদেশেও এ ধরনের পর্যবেক্ষণ চালালে ফলাফল এমনি হতে পারে বলে অণুমান করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসক নিখিল বিশ্বাস স্ট্রোক সম্পর্কে মানুষের এ হেন ‘অজ্ঞানতা’ই মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, আমাদের এখানে আচমকা কারোর ঘাড়ে-হাতে যন্ত্রণা শুরু হলে লোকে ভেবে ফেলবে, শোওয়ার দোষ! মাথা ব্যথা করলে মনে করবে অ্যাসিড। হাত-পা ঝিনঝিন করে অবশ হতে লাগলে ভাববে বাত। কিছুতেই ভাবতে পারবে না যে, এগুলো স্ট্রোকেরও লক্ষণ হতে পারে!
স্নায়ুরোগ-চিকিৎসক পরিমল ত্রিপাঠীর বলেন, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে নিয়মিত হেল্থ চেক-আপ জরুরি। কিন্তু এখানকার অধিকাংশ মানুষ উদাসীন। মধ্যবিত্তদের কাছে হেল্থ চেক-আপ মানে বিলাসিতা। অথচ এটা করলে প্রতি বছর প্রায় দশ লাখ লোক স্ট্রোক এড়াতে পারেন।
বস্তুত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু’র রিপোর্ট অনুযায়ী ব্রেন স্ট্রোকের আক্রমণ-হার এখন ‘সিক্স-ইন-ওয়ান।’ অর্থাৎ সারা বিশ্বে যেখানেই হোক, ছ’য়জন মানুষ যদি একত্রিত হন, দেখা যাবে, তাদের এক জন না এক জন জীবনে কখনো না-কখনো এই রোগের কবলে পড়েছেন, বা পড়তে পারেন! ছয়ের মধ্যে এক-এর বিপদ সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করাটাই আশু কর্তব্য বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। সচেতনতা বাড়লে প্রতিরোধটাও বাড়বে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই কমতে থাকবে স্ট্রোকের ঝুঁকি।
এখানে স্ট্রোকের লক্ষণ ও প্রতিরোধ কৌশল বিষয়ে কিছু পয়েন্টস দেয়া হলো যা আপনার কাজে লাগতে পারে-
লক্ষণ:
> হাত-পায়ে অবশ ভাব
> জুতোর ফিতে বাঁধতে সমস্যা
> মুখের অসাড়তা, কথা জড়িয়ে যাওয়া
> বেসামাল হাঁটা-চলা
> ঘাড়ে-মাথায় যন্ত্রণা, বমি, সংজ্ঞা হারানো
প্রতিরোধ:
> নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা
> ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ
> ডাক্তারের কথা মেনে নিয়ম করে হাঁটা
> খাদ্যাভ্যাসে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন
> ওজন নিয়ন্ত্রণ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: