ঢাকা | মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
রাজনীতি

রাজনীতিতে নড়াচড়া ও কৌতূহলী অপেক্ষার শুরু

MASUM | প্রকাশিত: ১৪ আগস্ট ২০১৭ ০৮:১৩

MASUM
প্রকাশিত: ১৪ আগস্ট ২০১৭ ০৮:১৩

নির্বাচনের আগে বিরোধীপক্ষের ‘আন্দোলন’ বাংলাদেশের রাজনীতির একটি প্রথা বা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এটা এমনই এক ‘ঐতিহ্য’, যা থেকে মুক্তি মিললেই আমাদের মঙ্গল। এবার আমরা এ থেকে রেহাই পাব কি না কে জানে! নির্বাচনের আরও বছর দেড়েক বাকি। কিন্তু রাজনীতিতে এরই মধ্যে বেশ নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখেই যে এসব হচ্ছে, তা স্পষ্ট। নির্বাচন নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বা হতে পারে, এমন অভিযোগও উঠতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ষোড়শ সংশোধনীর পুরো রায়ের প্রকাশ ও এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা এতটাই কঠোর ভাষায় হচ্ছে যে এটা এখন দেশের রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের মূল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেশের রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে বা হবে, তা নিয়ে বলা যায় এক কৌতূহলী অপেক্ষার শুরু হলো মাত্র!

আগামী নির্বাচনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে এসেছে নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে তাদের মতবিনিময় চলমান। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশের ইঙ্গিতও মিলছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের কারা প্রার্থী হবেন, তরুণদের প্রার্থী হওয়ার তৎপরতা বা কারা বাদ পড়তে পারেন, এসব নিয়ে আলোচনা ও পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হওয়া শুরু হয়েছে। বিএনপির নাকি ৩০০ আসনে ৯০০ প্রার্থীর তালিকাও তৈরি। এর মধ্য থেকে ৩০০ প্রার্থী ঠিক করাই শুধু বাকি। জামায়াত নিজের প্রতীকে প্রার্থী হতে পারবে না, তাই বিএনপির কাছে দলটি কত আসন চাইতে পারে, সেই খবরও পত্রিকায় দেখেছি। পড়েছি হেফাজতের তরফে কিছু প্রার্থী দেওয়ার কথা।

নতুন জোট গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। আ স ম আবদুর রব, ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্না ও কাদের সিদ্দিকী এক হওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁদের দলগুলোকে নিয়ে। আর সংসদের ‘বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদ তো ৫৮টি দল নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় জোট গঠন করে ফেলেছেন। সেই জোট গঠনের পরপর কয়েকটি দল বের হয়ে গেলেও দলের সংখ্যার দিক থেকে এই জোটের ধারেকাছেও কেউ নেই। ধারণা করি, জোট গঠন, ভাঙা বা নতুন জোট গড়া, এসব নানা কিছুই ঘটতে থাকবে সামনের দিনগুলোতে।

এই যে নির্বাচনী ‘হাওয়া’, এতে তো সব গুমোট কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা তো হচ্ছে না! এর মূল দায়টা আসলে গত নির্বাচনের। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচনে ‘বিরোধী রাজনৈতিক দল’ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই দলটি অংশ নেয়নি। এ ধরনের নির্বাচনের পরিণতি অতীতে যা হয়েছে, এবার তা হয়নি। এমন একটি নির্বাচন করে সরকার এরই মধ্যে সাড়ে তিন বছর পার করে দিয়েছে। নির্বাচনের দেড় বছর আগে বইতে শুরু করা নির্বাচনী হাওয়া অস্বস্তি কাটাতে পারছে না মূলত একটি ধাঁধা ও প্রশ্নকে সামনে রেখে; নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান আসলে কী? অথবা শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে তো? সরল অঙ্কের হিসাবে অনেকের কাছে এর জবাব রয়েছে। কিন্তু রাজনীতি কি সব সময় সরল অঙ্কের নিয়ম মেনে চলে?

এত দিন আওয়ামী লীগের নেতাদের যেসব কথাবার্তা শোনা গেছে, তাতে মনে হয়েছে, বিএনপি যে আগামী নির্বাচনে যাবেই, সে ব্যাপারে তঁারা প্রায় নিশ্চিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে তো বিএনপি সরেছেই, এখন দলটি যেকোনো শর্তেই নির্বাচনে আসবে। আওয়ামী লীগের এমন ধারণার পেছনে যুক্তি আছে। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও বিএনপির অনেক নেতাই মনে করেন, গত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মতও তা-ই। সাধারণভাবে আমরা বুঝতে পারি, গত নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি ও দলটির প্রধান খালেদা জিয়া এখন যতটা বেকায়দায় রয়েছেন, তা হতো না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে যদি বিএনপি হারত বা তাদের আশঙ্কা অনুযায়ী যদি তাদের ‘হারানো হতো’, তাহলেও দলটি অন্তত ‘প্রধান বিরোধী দলের’ মর্যাদা ও সুযোগ নিয়ে সক্রিয় থাকতে পারত।

এসব বিবেচনায় অনেকের সাধারণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপির সামনে কোনো পথ নেই। একই ভুল তারা আবার করবে না। বিএনপির সামনে আরও একটি সমস্যা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল হিসেবে পরপর দুবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধন বাতিল হওয়ার বিধান রয়েছে। আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হবে। ‘বিরোধী দলের’ মর্যাদা হারিয়ে দলটি যে খেসারত দিয়েছে, নিবন্ধন বাতিল হলে আরও কী খেসারত দিতে হয়, কে জানে! ফলে বিএনপির নির্বাচনে না গিয়ে আর পথ কী!

ভুল করে থাকলেও গত নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়ার কারণটি পরিষ্কার। দলটি ভেবেছিল, তাদের বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। এ ধরনের  নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতীতে তা-ই হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবার তা ভুল প্রমাণ করেছে, বিএনপির সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। এর শিক্ষাটি হচ্ছে, রাজনীতি সব সময় সরল অঙ্কের হিসাব মেনে বা হুবহু অতীতের পথ ধরে চলে না। ফলে এখন যাঁরা ধরে নিয়েছেন যে গত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পরিণতি বিবেচনা করে যেকোনো শর্তে নির্বাচনে আসা ছাড়া বিএনপির কোনো পথ নেই, তাদের এই ভাবনাও সম্ভবত বেশ সরলীকৃত। কারণ, আবার ৫ জানুয়ারির মতো একটি নির্বাচন করতে না চাইলে সামনের নির্বাচনে বিএনপিকে লাগবে। ফলে বিষয়টি শুধু বিএনপির ‘নাকে খত’ দিয়ে নির্বাচনে যাওয়া নয়, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে নির্বাচনে ‘নেওয়ারও’ দরকার পড়বে। বিএনপির দর-কষাকষির জায়গাটি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে, এমন ভাবনার মধ্যে সম্ভবত সমস্যা আছে।

আওয়ামী লীগ যদি আবারও ৫ জানুয়ারির মতো একটি নির্বাচন করতে চায়, তা হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু একতরফা নির্বাচন বারবার বা ভবিষ্যতেও সফলতা দেবে, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আসলে কতটা নিশ্চিত? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘একাদশ নির্বাচন ৫ জানুয়ারির মতো হবে না, নির্বাচন কঠিন হবে।’ তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে আমরা একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের ইঙ্গিত পাই। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের মুখে সম্প্রতি আমরা বেশ স্পষ্টভাবে নির্বাচনে যাওয়ার কথা শুনলাম। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি অবশ্যই নির্বাচনে যাবে এবং এর জন্য যতটুকু প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, আমরা নিচ্ছি। তবে আমরা মনে করি, নির্বাচনের সময় একটি নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এর জন্য সহায়ক সরকারের বিকল্প নেই।’ মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যের পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই দলের প্রধান খালেদা জিয়ার মুখে বিভিন্ন সময়ে শোনা বক্তব্যগুলোকেও বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি অব্যাহতভাবেই বলে আসছেন, বর্তমান সরকার বা শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না।

আওয়ামী লীগ যে বর্তমান সরকার বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করার ব্যাপারে কঠোরভাবে স্থির, তা আমরা ধারণা করতে পারি। ফলে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে ধোঁয়াশা কি আদৌ কাটল? মির্জা ফখরুলের মুখে আমরা যখন বিএনপির ‘অবশ্যই’ নির্বাচনে যাওয়ার কথা শুনলাম, তখন খালেদা জিয়া ‘চিকিৎসার জন্য’ লন্ডনে। চিকিৎসার পাশাপাশি ছেলে ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো ও কোরবানির ঈদ উদ্‌যাপনও এই সফরের উদ্দেশ্য বলে আমরা জেনেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজন বিষয়টিকে এভাবে দেখছেন না। দেখার কারণও নেই। লন্ডনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেক রহমানের সময় কাটানো শুধু মা-ছেলের একসঙ্গে থাকার বিষয় নয়। এটা বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের, মানে দলের প্রথম ও দ্বিতীয় নেতার দীর্ঘ মতবিনিময় ও সলাপরামর্শের একটি পরিস্থিতিও তৈরি করেছে। সেই সুযোগ তাঁরা নেবেন এটাই স্বাভাবিক।

খালেদা জিয়া লন্ডনে যাওয়ার পরপর মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র হতে পারে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকের কাছে খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়া ছিল ‘মামলার ভয়ে পালিয়ে যাওয়া’। কিন্তু এখন অনেকের মুখে লন্ডনে বসে ‘ষড়যন্ত্রের’ কথা শোনা যাচ্ছে। বিএনপি সংঘাত ও সন্ত্রাসী কাজে জড়িত, এমন দাবি করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ব্যাপারে ব্রিটিশ এমপিদের সতর্ক করতে চিঠি দিয়েছে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ। বোঝা যায়, খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর, বিশেষ করে তারেক রহমানের সঙ্গে সলাপরামর্শের ফলাফল নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছে আওয়ামী লীগ।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ষোড়শ সংশোধনীর রায় বাতিল ও এর নানা পর্যবেক্ষণ। আওয়ামী লীগ একে নিজেদের ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে মনে করছে। আওয়ামী লীগকে যা আঘাত করেছে, তা বিএনপির জন্য খুশির কারণ হবে, এটাই স্বাভাবিক। রায়ের অনেক পর্যবেক্ষণ দলটির বিরুদ্ধে গেলেও এই রায় যেন বিএনপির জন্য এক সুযোগ হিসেবে হাজির হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মুখে শুনলাম, ‘আবার আমরা দুঃসময়ে পতিত হয়েছি। চক্রান্তের মুখে পড়েছি। ষড়যন্ত্র চলছে।’

সামনের রাজনীতি যে নানা দোলাচলের মধ্য দিয়ে যাবে, তা টের পাওয়া যাচ্ছে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: