ঢাকা | রবিবার, ৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

অবৈধ কেব্‌ল চ্যানেলে বেআইনি অনুষ্ঠানমালা

Admin 1 | প্রকাশিত: ৫ মে ২০১৭ ২০:৫১

Admin 1
প্রকাশিত: ৫ মে ২০১৭ ২০:৫১

‘করুণাময়ী মা’ হাতের তালু মেলে ধরতেই ভোজবাজির মতো এসে গেল একটি আপেল। একই উপায়ে তিনি এক তরুণীকে এনে দিলেন পাথর।
ঢাকার আজিমপুরে এক কেব্‌ল অপারেটরের নিজস্ব চ্যানেলে প্রচারিত বিজ্ঞাপনটি বলছে, পরকীয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, শনি-রাহুর গ্রাসসহ যাবতীয় সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে মা করুণাময়ীর দরবারে।
আইনের চোখে এ বিজ্ঞাপন অবৈধ। আসলে কেব্‌ল অপারেটরদের নিজস্ব চ্যানেল পরিচালনার পুরো ব্যাপারটিই অবৈধ। তারা অবশ্য বহু বছর ধরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব চ্যানেল খুলে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন, বিদেশি পাইরেটেড চলচ্চিত্র অথবা চলচ্চিত্রের গান প্রচার করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো নজরদারি নেই।
কেব্‌ল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬ অনুসারে, কেব্‌ল অপারেটররা এলাকাভিত্তিক ভূনির্ভর চ্যানেল, স্যাটেলাইট ইত্যাদি চ্যানেলের অনুষ্ঠানমালা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতে সিগন্যাল তৈরি করে বিতরণ করতে পারবে। তাদের কাছ থেকে স্থানীয় অপারেটর বা ফিড অপারেটর সেই সিগন্যাল নিয়ে এলাকায় এলাকায় গ্রাহকদের পৌঁছে দেবে।
তবে আইন অনুযায়ী, কেব্‌ল অপারেটররা সরকারের অননুমোদিত কোনো চ্যানেল বাংলাদেশে বিপণন, সঞ্চালন বা সম্প্রচার করতে পারবে না। তারা নিজস্ব কোনো অনুষ্ঠান অথবা কোনো ভিডিও, ভিসিডি, ডিভিডিও দেখাতে পারবে না।
কেব্‌ল অপারেটররা বলছে, তারা নিজস্ব চ্যানেল চালু করেছে নব্বই দশকের শেষ দিকে। এখন ঢাকার প্রতিটি এলাকায় এমন চ্যানেল আছে। স্থানীয়ভাবে এগুলো ডিশ চ্যানেল, সিডি চ্যানেল বা মুভি চ্যানেল নামে পরিচিত।
ঘুরে দেখা যায়, ঢাকার ওয়ারী, আজিমপুর, টিকাটুলী এলাকায় একটি করে এমন চ্যানেল চালু আছে। মোহাম্মদপুর, বেইলি রোড, খিলগাঁও আর গুলশান ১-এ চলছে দুটি থেকে তিনটি করে চ্যানেল। অনেকে পর্দায় নামও ব্যবহার করে। প্রায় সব কটিই ২৪ ঘণ্টার চ্যানেল।
চ্যানেলগুলোর মূল উপজীব্য হিন্দি, ইংরেজি ও ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র। হিন্দি চলচ্চিত্রের গানও থাকে। নতুন মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রের নিম্নমানের কপি (হল প্রিন্ট) দেখানো হয়। সবই কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করা চোরাই সম্প্রচার।
অনুষ্ঠানের বড় অংশ হচ্ছে স্থানীয়ভাবে তৈরি বিজ্ঞাপন। বিদেশি চলচ্চিত্র ও গানের ফাঁকে ফাঁকে বা নিচে স্ক্রলে দেখানো এসব বিজ্ঞাপনের বেশির ভাগই প্রতারণামূলক ও অশ্লীল।
সম্প্রচার নীতিমালা, ২০১৪-এর আওতায় কেবল নেটওয়ার্কও অন্তর্ভুক্ত। নীতিমালার চতুর্থ অধ্যায়ে বলা আছে, এমন কিছু প্রচার করা যাবে না যাতে জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতারিত হয়। নীতিমালা অনুসারে, ওজন হ্রাসের জন্য অননুমোদিত ওষুধ ও চিকিৎসা, যৌন দুর্বলতার চিকিৎসা, স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ, মাদুলি, কবচ, জাদু ইত্যাদির বিজ্ঞাপন প্রচারযোগ্য নয়। ওষুধজাতীয় পণ্য বা চিকিৎসাসেবার বিজ্ঞাপনদাতার কাছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র থাকতে হবে। কিন্তু কেব্ল অপারেটরদের চ্যানেলগুলো এসব নিয়মের তোয়াক্কা করছে না।
গত দুই মাসে এ প্রতিবেদক ঢাকার আজিমপুর, শান্তিনগর, গুলশান ১, মিরপুর এলাকার স্থানীয় কেব্‌ল চ্যানেলে একটানা ৩০ মিনিটের মধ্যে প্রচারিত গড়পড়তা বিজ্ঞাপনগুলো খুঁটিয়ে দেখেন। আজিমপুরে দেখা ১৪টি বিজ্ঞাপনের মধ্যে ছয়টি ছিল নীতিমালার বরখেলাপ। সব কটিই মুশকিল আসানের বিজ্ঞাপন। চারটি তন্ত্রমন্ত্র করে ভাগ্য বদলের। দুটি যৌন ও শারীরিক সমস্যার হারবাল বা হোমিও সমাধানের।
শান্তিনগর এলাকার গৃহিণী তহুরা আহমেদের কথা, ‘এমন কিছু প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন দেখায়, বাচ্চাদের সামনে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। আর তাবিজ-কবজের বিজ্ঞাপন তো গরিবদের ঠকানোর ফন্দি।’
বেইলি রোড এলাকায় দেখা সাতটির মধ্যে পাঁচটিই নীতিমালার বরখেলাপ। এগুলোর বিষয়, জ্যোতিষ শাস্ত্র ও জিন-কালী সাধনার মাধ্যমে সব ধরনের সমস্যা সমাধান আর ওজন কমানোর চিকিৎসা।
মিরপুর ১০ নম্বরে আধঘণ্টায় ১২টি বিজ্ঞাপন দেখা গেল। তিনটিই তদবির-তাবিজ এবং স্থানীয় মানসিক রোগের চিকিৎসাকেন্দ্রের বিজ্ঞাপন।
গুলশান ১ নম্বরে পর্যবেক্ষণের সময় কোনো নিয়মবহির্ভূত বিজ্ঞাপন ছিল না। তবে এলাকার বাসিন্দা নাইমা হক বলেন, তিনি বিভিন্ন সময় সক্ষমতা বাড়ানোর ওষুধ এবং তদবির-তাবিজের বিজ্ঞাপন প্রচার হতে দেখেছেন।
আজিমপুরের স্থানীয় ফিড অপারেটর এমপি কেব্‌ল নেটওয়ার্কের মো. জাকির বলেন, বিজ্ঞাপন প্রচারের কোনো নীতিমালার কথা তিনি জানেন না। আর দর্শকদের প্রিয় ছবিগুলো মূল অপারেটরের চ্যানেল থেকে আসে। শান্তিনগরের এসটি ভিশনের ফিড অপারেটরও বলছে, সব অনুষ্ঠান মূল অপারেটরের নেটওয়ার্ক থেকেই চালানো হয়। তারা শুধু বাড়িতে বাড়িতে সংযোগটা পৌঁছে দেয়।
ঢাকায় এখন ১৮টি বড় কেব্‌ল অপারেটিং প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোর একটি ডট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আল মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সংগঠন অনেক দিন থেকে এসব অনুষ্ঠানকে বৈধতা দিয়ে আইনের সংশোধন দাবি করে আসছে। অবশ্য ছয় বছর ধরে কেব্ল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) কোনো নির্বাচিত কমিটি নেই।
চোরাই ছবি দেখানো সম্পর্কে সেলিম আল মাহবুব বলেন, বাংলাদেশি কোনো চলচ্চিত্র তাঁরা দেখান না। আর বিদেশি চলচ্চিত্রগুলো দর্শক দেখতে চায়, তাই চালান। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ভালো বিজ্ঞাপন চাই, কিন্তু পাই না। বাধ্য হয়েই কিছু দিতে হয়। না হলে খরচ কুলানো যায় না।’ তবে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনগুলোর দায়দায়িত্ব তিনি পুরোপুরি স্থানীয় অপারেটরদের ওপর চাপালেন।
আইন অনুযায়ী, জেলা প্রশাসক অথবা তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তা কেব্‌ল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের লাইসেন্স কর্তৃপক্ষ হবেন। ঢাকায় এখন এর দায়িত্বে আছেন ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মজিবর রহমান। তিনি বলেছেন, আইনত এই চ্যানেলগুলো অবৈধ। তথ্য মন্ত্রণালয় কয়েকবার এগুলো বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু মালিকেরা বন্ধ করেননি। তাঁর মতে, হঠাৎ এগুলো বন্ধ করা কঠিন হবে, তবে অসম্ভব নয়।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: