
বাংলাদেশের দুর্যোগ ও শেখ হাসিনা
বাংলাদেশ দুর্যোগ প্রবণ দেশ । প্রতি দুর্যোগে জান মালের ক্ষতি হয়। এই দুর্যোগের সাথে রাজনীতি ব্যাপকভাবে জড়িত। পাকিস্তান আমলে যে দুর্যোগ হয় এবং পাক সরকারের অবহেলা বাংলার রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে , সেদিন স্পষ্ট হয় বাঙ্গালীর জীবনের মূল্য নাই! কিন্তু একজন বুঝেছিলেন তিনিই জাতির অন্তর এর ডাক শুনেছিলেন এবং সে দুর্যোগের আবির্ভূত হন ত্রাণ কর্তা হিসেবে। গর্জে উঠে বজ্র কণ্ঠ বঙ্গবন্ধুর বাংলার দুঃখী মানুষের অধিকার চাই। মানব সৃষ্ট ও রাজনৈতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে অনবরত ব্রিটিশ আমল থেকেই তিনি সংগ্রাম করে শেষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন করে বাঙালিকে স্বাধীন বাংলা উপহার দেন। বিশ্ব দেখেছে একটি স্বাধীন জাতি যারা হাজার হাজার বছর ধরে শোষিত বঞ্চিত ছিল তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
জাতির পিতা জাতিকে রক্ষা করার জন্য শাসন জারি করে যুদ্ধোত্তর দাঙ্গা হাঙ্গামা থেকে দেশকে রক্ষা করে উন্নয়নের গতি আনেন বাংলার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.৩% যা আজও কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। তিনি সুরক্ষা দিলেন জাতিকে সংবিধান দিয়ে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার স্বীকৃতি এনে ।
কিন্তু জাতির পিতাকে হত্যার পরে বাংলাদেশে নেমে এলো দুর্যোগের ঘনঘটা, শাসনে , উন্নয়নে ও রাজনীতিতে। যে জাতির স্বাধীনতার মূল ছিল রাজনীতি সেই রাজনীতি নিষিদ্ধ হল অর্থাৎ জাতি ঘোর দুর্যোগে নিমজ্জিত হল।
২। এরপর শুরু হল অন্ধকার সময় অর্থাৎ রাজনীতি নিষিদ্ধ , কোথাও মিছিল মিটিং করা যায় না। যেমন স্বাধীনতা পূর্বকালে আওয়ামীলীগের উপর সরকারের জুলুম, নির্যাতন ও দু:শাসন তথা মামলা, গ্রেফতার জেল বিনা বিচারে জেলে বন্দি রাখা হয়েছে ঠিক একই রকম বিনা বিচারে জেলে রাখা হয়েছে অনেক অনেক নেতাকে, কর্মী এবং আওয়ামীলীগের সমর্থকদের। এদের মধ্যে অনেকে ৩/৪ বছর পর্যন্ত বিনা বিচারে জেলে বন্দি ছিল, অনেকে চুপসে গেছিলেন মান সম্মানের ভয়ে! কারণ তখন রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক দুর্যোগের মূল অনুঘটক কিছু চক্রান্তকারী এবং বাস্তবায়নকারী হিসেবে আবির্ভূত হয় সমাজের খারাপ লোকটি যার হাত মুক্তিকামী জনতার রক্তে রঞ্জিত, মুক্তিকামী সংগ্রামে ও যুদ্ধেরত মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন কারী ( একাত্তর সালে যুদ্ধের মধ্যেও যারা সম্পদ লুণ্ঠন করেছে তাদের বিচার করা জরুরি), যুদ্ধকালে পাকিস্তানের দোসর নেতা হয় এবং আওয়ামীলীগের জন্য সত্যিকারেই রাজনীতি কঠিন হয়ে যায়। এ অন্ধকার আরো গভীর হয় যখন জাতির পিতার জীবিত দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে তাঁদের প্রিয় জন্মভূমিতে আসতে দেওয়া হয় নি, যখন দু:খি বাঙ্গালীর ত্রাণ কর্তাকে হত্যা করে চেপে বসা দু:শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ ছিল না , যখন সবল দূর্বলেকে নির্যাতন করে ( সেই প্রাচীন কালের মৎসন্যায়ের মত) তখন দূর থেকে এই দু:খি বাঙ্গালীর জন্য যার হৃদয়ের গভীরে কান্না করেছে সেই শেখ হাসিনাকে বাংলার মাটিতে পা দিতে দেয় নি। যেমন পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে আটকে রেখেছিল যখন বাংলার মানুষ তারই ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার জন্য শহীদ হচ্ছেন, সম্পদ খুইয়েছেন, শরণার্থী হয়েছেন, যেন শেখ হাসিনাকেও সেভাবে বাংলায় আসতে দেওয়া হয় নি। শাসকরা জানত শেখ হাসিনা এই বাংলার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ত্রাতা। দুঃশাসন এর শৃঙ্খল ক্রমশঃ দুর্বল হলে সত্যিকারের ত্রাতা হিসেবেই শেখ হাসিনা দুঃখী বাংলার জমিনে রাখেন। সেদিন বাংলার আকাশে দুর্যোগের মেঘের আড়ালে হেসেছিল সূর্য।
স্বাধীনতার সুফল বাঙ্গালী কখনোই পায়নি। সবসময় আন্তর্জাতিক, জাতীয়, আঞ্চলিক, গ্রামের কুচক্রী মহল এদের শাসন ও শোষণ করেছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার হাজারো মহা দুর্যোগের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে ও উন্নোয়নে পূর্ণশক্তির নিয়োগ করলেন, প্রস্তুত করলেন প্রথম পরিকল্পনা ( পঞ্চবার্ষিক) শুরু হলো কর্মযজ্ঞ। তখন বাংলার উন্নতির গতি প্রবলভাবে বেগবান। সে সময় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় এবং সরকারের পতন ঘটানো হয়। সকল পরিকল্পনা বিকৃত, পরিবর্তিত এবং বাতিল হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের উন্মেষ পথ হারিয়ে যায়, জাতির স্বাধীনতার স্বাদ ও স্বপন নষ্ট হয়ে যায়। এটি জাতির জন্য আরেক দুর্যোগ। এই দুর্যোগ চলেছে গণতন্ত্র না আসা পর্যন্ত। ততদিন বাংলার সামাজিক পরিবর্তন হয় যেমন পিতা তার সন্ত্রাসী সন্তানের পরিচয়ে পরিচিত হতে গর্ব করেছেন, মুরব্বিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানো লুপ্ত হয়ে গেছে, সমাজের মাথা হয়েছে দুষ্টু ও পয়সাওয়ালা, সামাজিক রীতি ও শিক্ষা তিরোহিত, শিক্ষা ক্ষেত্রে অরাজকতা যেন জাতি মেরুদন্ডহীন হয়, শিক্ষা পদ্ধতি ও বাস্তবের সাথে মিল না থাকা ইত্যাদি, সাজানো নির্বাচন, ইত্যাদি অর্থাৎ দুর্যোগের ঘনঘটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ দুর্যোগ থেকে বাঁচানোর জন্য নির্ভর করা যায় এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না বিভ্রান্তি ও নিষ্পেষিত জাতি। কোন রাষ্ট্রিয় দিক নির্দেশনা নেই জাতির জন্য, যে যেভাবে পার করে খাও। বাবাও ছেলেকে বলে , যেভাবে পার করে খাও। অর্থাৎ ছেলে বা নাগরিক অশিক্ষা, কু কুশিক্ষা , সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ইত্যাদি হয়েছে। হয়েছে রাতারাতি পয়সাওয়ালা।
৪। ১৯৭০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যখন স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল বাংলা তখন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)
আঘাত হবে মারাত্মক ঘূর্ণঝড়টি এতে সরকারী হিসাব অনুসারে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লক্ষ কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি ধারনা করা হয়। ক্ষতির মধ্যে আনুমানিক ২০,০০০ মাছ ধরা নৌকা, শস্য ও সম্পদ। গবাদিপশু মৃত্যু প্রায় ১০ লক্ষে, বাড়িঘর ৪ লক্ষ এবং ৩,৫০০ শিক্ষাকেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়। সর্বোচ্চ বাতাসের গতিবেগ: ২২২ কিমি/ঘণ্টা। এত ক্ষয়ক্ষতির পরেও তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কোন সাহায্য করে নি , আওয়ামীলীগ নিজস্ব উদ্যোগে e দুর্যোগ মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখনই নিশ্চিত হয় এ বাঙ্গালীর জীবনের কোন মূল্য নেই! দুর্যোগ শিক্ষা দিল স্বাধীনতা অর্জন এর বিকল্প নাই।
এরপর প্রায় প্রতিবছর বন্যা ও ঘূর্ণি ঝড় হয়েছে। সবচে কিন্তু এসব মোকাবেলা করার বা দীর্ঘ মেয়াদি কোন পরিকল্পনা তখনও নজরে আসেনি।
১৯৮৮ সালের বড় বন্যার সময় শেখ হাসিনা সমগ্র বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছুটে গিয়ে নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে অসহায় দু:খি বাঙ্গালীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। একদিকে তৎকালীন স্বৈরশাসকের নেতা কর্মীদের ত্রাণ চুরির মহোৎসব অপরদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসহায় দুর্গত মানুষের জীবন রক্ষার লড়াই চলেছিল।
১৯৯৬ সালে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় নবমাত্রা যোগ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার , অনিয়ম এবং অপরাজনীতির কালো দুর্যোগ বাংলার আকাশ থেকে সরিয়ে দিতে ব্যস্ত ঠিক সে সময় ১৯৯৭ সালে তীব্র ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ভোলার নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। সরকার তথা আওয়ামীলীগের দুর্যোগ মোকাবেলা করার পুরাতন অভিজ্ঞ দল হিসেবে সফলভাবে মোকাবেলা করে। দুর্যোগ মোকাবেলায় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যে অভিজ্ঞতা উপমহাদেশে বা বিশ্বে সে রকম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনীতিক দল বা সংগঠন দু একটির বেশি নাই।
এরপর আসে বাংলার সর্বকালের ইতিহাসে সবচে ভয়াবহ বন্যা ১৯৯৮ শুধু বন্যা নয় এ বছর দুটি ঘূর্ণিঝড় হয়।
বন্যার স্থায়ীত্ব ও দেশের ৭৭% এলাকা প্লাবিত হয়। সমগ্র বিশ্ব ভেবেছিল বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি হবে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের সফল মোকাবেলায় মাত্র ১০৫০ জন মারা যায় ওপর দিকে ১৯৮৮ সালের বন্যায় ২৩৭৯ জন মারা যান। এত কম জীবন এবং ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ায় পৃথিবী দেখেছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামর্থ্য।
৫।
বাঙ্গালী জাতির জীবনে চক্রান্তের ঘূর্ণঝড়টি বারবার এসেছে তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করতে পারেনি। জাতির জীবনে আবারও রাজনৈতিক দুর্যোগ নেমে আসে। এ দুর্যোগের ফলে অনেক জান মালের অনেক ক্ষতি হয়। এভাবে দীর্ঘ লড়াই, বিনা বিচারে আটকে রাখা । দেশকে মানবতার মা শেখ হাসিনা মুক্ত করার চক্রান্ত ইত্যাদি কোন কিছুই শেখ হাসিনাকে দমাতে পারেনি। অবশেষে মুক্তি আসে মানবতার । ২০০৯ সালে বিপুল বিজয় নিয়ে তখন দেশ পরিচালনার দ্বায়িত্ব নিলেন শেখ হাসিনা । বাংলার আকাশ থেকে অন্ধকারের অমানিশা তিরোহিত হতে শুরু করে। কিন্তু
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় বিজলি এবং তীব্র ঘূর্ণিঝড় আইলা বাংলাদেশের উপর আঘাত করে সফল মোকাবেলার ফলে ১৫০ জন মারা যায়।
২০১৩ সালে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন আসে ১৭ জন মারা যায়। ২০১৫ সালে ঘূর্ণিঝড় কোমেন আঘাত হানে। ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু এর আঘাতে চট্টগ্রামের উপকূল বরাবর। ২০১৬ সালে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় ডিয়ামু এর আংশিক আঘাত বাংলাদেশের উপর দিয়ে যায়। এসব ঘূর্ণি ঝড়ে প্রাণহানী এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম । পরবর্তী পুনর্বাসন চলেছিল নির্ভুল এবং দ্রুত গতিতে ।
২০২০ সালে সদ্য আম্পান ঘূর্ণিঝড় ছিল বিগত যে কোনো ঘূর্ণি ঝড়ের তুলনায় প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং এক রোখা। সেটিও শেখ হাসিনা সরকার সফলতার সাথে মোকাবেলা করেছে। প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার কারণ হলো ততদিনে শেখ হাসিনা সরকার দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশ্বে মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিশ্ব দেখেছে দ্রুত পূর্বপ্রস্তুতি , দুর্যোগ রেসপন্স টিম, প্রশাসনিক সক্ষমতা ইত্যাদি ব্যাবস্থা কিভাবে জন মাল রক্ষা করতে পারে।
প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় এবং সম্ভাব্য পরবর্তী দুর্যোগ বিষয়ে শেখ হাসিনার পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা বিশ্বে এক অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে সেই সাথে বাংলাদেশকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্রশাসনিক ব্যাবস্থা গ্রহন করেছেন এমনকি ২১০০ সালে কি করতে হবে সে নির্দেশনাও ডেল্টা প্লান করে তিনি দিয়েছেন ইতোমধ্যে। (চলবে)
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: