
এ বছরের গত জুন মাসে বিশ্ববিখ্যাত নেচার মেড নামের মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা জানিয়েছিল যে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা তেমন স্থায়ী হয় না, দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। সংবাদটি ছিল মর্মান্তিক। একবার কেউ চিকেন পক্স বা জলবসন্তে আক্রান্ত হলে সারা জীবনে এই অসুখটি আর হবে না। কারণ জলবসন্তের ভাইরাসের কারণে তার শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা চিরস্থায়ী। এটি নষ্ট হয় না। কিংবা একবার এর টিকা নিলে তাকে আর কখনোই এর টিকা নিতে হবে না। হাম ও হেপাটাইটিসের বেলায়ও ব্যাপারটা তাই। ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি শরীরে টিকে থাকে প্রায় এক বছর। সে জন্য ফ্লুর বিরুদ্ধে সুরক্ষা পেতে তাকে প্রতিবছর টিকা নিতে হয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা যদি সারা জীবন টিকে থাকত, তাহলে কতই না ভালো হতো। সারা জীবনে আর করোনার ভয় থাকত না। যদি কয়েক বছরও স্থায়ী হতো কিংবা নিদেনপক্ষে এক বছর স্থায়ী হলেও আমরা বছরে একবার করোনার টিকা নিলেই চলত। কিন্তু আলোচ্য গবেষণাটি তা বলছে না। খবরটি মর্মান্তিক তো বটেই।
এরপর সেপ্টেম্বরে আরেকটি বিখ্যাত জার্নাল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একদল গবেষকের এ রকম আরেকটি কাজ প্রকাশ করেন। তাঁরা পূর্বোক্ত কাজের অনুরূপ ফলাফল পান এবং বলেন যে যাঁরা সার্স-কভ-২ ভাইরাসের মৃদু সংক্রমণে আক্রান্ত হন, তাঁদের বেলায় হিউমোরাল ইমিউনিটি দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং কভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে মৃদু আক্রান্তদের সংখ্যাই বেশি। প্রতি ৩৬ দিনে তাদের অ্যান্টিবডির পরিমাণ অর্ধেক হারে কমতে থাকে। এই হারে কমতে থাকলে শরীরে করোনার পুরো অ্যান্টিবডি নষ্ট হতে সময় লাগতে পারে সর্বোচ্চ, তবে তাঁরা তাঁদের গবেষণার সীমাবদ্ধতার কথাও জানান যে তাঁরা রোগীদের তিন মাসের বেশি পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন না, যদিও তিন মাস পর তাঁদের অ্যান্টিবডি নষ্ট হওয়ার বর্তমান হার কমতেও পারে।ব্রিটেন ও স্পেনের এ বিষয়ক গবেষণাগুলোতেও মোটামুটি একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। সেখানেও অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে ছিল পাঁচ সপ্তাহ থেকে তিন মাস। এ রকম আরো কিছু গবেষণার ফলাফল পরিবেশটাকে মোটামুটি গুমট করে ফেলেছিল।
তবে এতে খুব বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন না। তাঁদের মতে, শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা শুধু অ্যান্টিবডির স্থায়িত্বচিত্র দিয়েই নির্ধারিত হয় না। প্রতিরক্ষার জন্য শরীরে আরো অনেক শর্ত কাজ করে। এটি আবার আশার কথা।
তাই করোনা আক্রান্ত রোগী সেরে ওঠার পর বি ও টি-সেলগুলো ভাইরাসটিকে মনে রাখে এবং আবার শরীরে এটি প্রবেশ করলে এরাই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ফলে রোগের তীব্রতা অনেক কম হয়।
আবার এখানেই শেষ নয়। কোনো কোনো কভিড-১৯ রোগীর শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরিই হয় না। কিন্তু একসময় সে ভালো হয়। এ ক্ষেত্রে বলতেই হয় যে তার বেলায় হয়তো শরীরে অন্য কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি হয়, যার সব কার্যকারণ আমাদের এখনো জানা নেই। বিজ্ঞান যখন আরো এগোবে, তখন নিশ্চয়ই আমরা এই অপার রহস্যময় শরীর নিয়ে আরো জানব। কিন্তু তত দিন মন খারাপ করে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে আইসল্যান্ডের সংস্থা ডিকোড জেনেটিক্সের পাওয়া সাম্প্রতিক সময়ে একটি মন ভালো করা তথ্য দেখাচ্ছে যে পরীক্ষাধীন এক হাজার ২০০ রোগীর মধ্যে ৯০ শতাংশের শরীরে চার মাস পরেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। আরো দেখা যায় যে যাদের সংক্রমণের তীব্রতা বেশি ছিল এবং হাসপাতালে থাকতে হয়েছে, তাদের শরীরে অ্যান্টিবডির পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে। এমনকি পুরুষ ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা গেছে, যদিও করোনার ক্ষেত্রে এই দুটি গ্রুপই খুব ঝুঁকির মধ্যে আছে।
গত অক্টোবরে ইমিউনিটি জার্নালে ইউনিভার্সিটি অব আরিজোনার এক গবেষকদলের বাঙালি দলনেতা ভাইরোলজির সহযোগী অধ্যাপক দীপ্ত ভট্টাচার্য জানিয়েছেন যে করোনার অ্যান্টিবডি শরীরে কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাত মাস টিকে থাকতে পারে। তারা ছয় হাজার কভিড-১৯ রোগী নিয়ে বড় আকারের পরীক্ষা করেছিলেন। তাতে তাঁরা অ্যান্টিবডির এই স্থায়িত্ব পেয়েছেন।
যাঁদের শরীরে অ্যান্টিবডি মাত্র কয়েক মাস স্থায়ী হয়, তাঁদের কেউ কেউ কভিড-১৯ থেকে আরোগ্য হওয়ার পর আবার আক্রান্ত হন। কিন্তু অতি সম্প্রতি (১৭ নভেম্বর ২০২০) প্রকাশিত চারটি বিখ্যাত ল্যাবরেটরির গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে বেশির ভাগ রোগীর শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি ছয় থেকে ১২ মাস, এমনকি আরো বেশি সময় স্থায়ী হয়। তদুপরি আবার আক্রান্তের হার অত্যন্ত নগণ্য। এই চারটি ল্যাবরেটরি হলো—ইয়েল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব আরিজোনা, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো এবং ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোল্লা ইনস্টিটিউট অব ইমিউনোলজির বিভিন্ন গবেষণাগার। এই ব্যাপক গবেষণা থেকে আরো দেখা যায় যে রক্তের শ্বেতকণিকার মেমোরি বি-সেলগুলোর উৎপাদন ও স্থায়িত্ব প্রথম মাসের চেয়ে ছয় মাস পরে আরো বেশি দেখা গেছে। তা ছাড়া সিডি৪+ টি-সেল এবং সিডি৮+ টি-সেলগুলোর হাফ লাইফ দেখা গেছে তিন থেকে পাঁচ মাস।
এই গবেষণাগুলো থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে মানবশরীরে করোনাভাইরাসের প্রবেশের পর কারো কারো শরীরে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর স্থায়িত্ব প্রায় এক বছর। তা ছাড়া অ্যান্টিবডি কমে গেলেও সমস্যা নেই। শরীরের ভাইরাসবিরোধী বিকল্প কার্যক্রম তখন কাজ করে। তা হলো ভাইরাসের চেহারা চিনে রাখা শ্বেতকণিকার বি-সেল এবং ভাইরাসকে আক্রমণকারী টি-সেল। আরোগ্যের কয়েক মাস পরও যখনই শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তখনই এরা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং অ্যান্টিবডি না থাকলেও বেশি বেশি করে বি-সেল ও টি-সেল তৈরি করতে থাকে। ফলে নতুন প্রবেশ করা ভাইরাস পর্যুদস্ত হয়। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরের এই চমকপ্রদ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কথা আগে বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল। তাই অ্যান্টিবডির কম স্থায়িত্ব নিয়ে তাঁরা খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। এখন সেই উদ্বেগ আর নেই। ‘মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তিরি বানাইয়াছে’। সেই মিস্তিরি আমাদের মন ভালো করে দিয়েছে।
করোনাকালে চারদিকে মানুষের অসহায় মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম মন ভালো করা খবরটি ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকটি টিকার আবিষ্কার। আর দ্বিতীয় ভালো খবরটি এই অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব ও বি-সেল-টি-সেল সমন্বয়ে শরীরের প্রতিরক্ষার বিষয়টি।
আর এর মাজেজা হলো প্রথমত, করোনায় একবার আক্রান্ত হওয়ার পর আবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে অল্পসংখ্যক মানুষের। কিন্তু ভাইরাল লোড অবহেলা করলে চলবে না। অর্থাৎ করোনা প্রতিরোধের স্বাস্থ্যবিধিগুলো, যেগুলোর নামকরণ হয়েছে ‘নিউ নরম্যাল’ বা ‘নতুন স্বাভাবিকতা’, সেগুলো পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। দ্বিতীয়ত, যাঁরা মৃদু আক্রান্ত হয়েছেন বা লক্ষণহীন, তাঁরা সাবধান। তাঁদের শরীরে অ্যান্টিবডি খুবই কম বা নেই। তাঁরা আবার আক্রান্তের ঝুঁকিতে আছেন তা বলা যায়। আর আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই এ রকম মৃদু বা লক্ষণহীন। তাই আমাদের দেশের বিপদ কিন্তু থাকছেই। দ্বিতীয় ঢেউ চলার পুরো শীতকালের সময়টা আমাদের সবাইকে খুবই সাবধানে থাকতে এবং মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধিগুলো কঠোরভাবে মানতে হবে। কারণ কোনো অবস্থায়ই আমরা আগামী দিনগুলোতে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যু মেনে নিতে পারি না। তৃতীয়ত, এত দিন করোনার টিকার কার্যকারিতা বলতে আমরা শুধু তার অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষমতা ও স্থায়িত্ব নিয়েই ভাবতাম। কিন্তু এখন বি-সেল ও টি-সেল তৈরির ক্ষমতা ও স্থায়িত্ব বিবেচনা না করলে ভুল হবে। চতুর্থত, এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে করোনার যত টিকা আবিষ্কৃৃত হয়েছে তার সবই এই মানদণ্ডে কমবেশি উতরে গেছে। তাই এই সবগুলো টিকাই করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর। অর্থাৎ টিকাগুলো নিলে আমরা আসলেই উপকৃত হব। এখন গবেষণা চলছে সত্যিকার অর্থে টিকা প্রতিবছর একবার নিলেই চলবে কি না। পঞ্চমত, হার্ড ইমিউনিটি তৈরিতে এই খবরটি খুব সাহায্য করবে। ষষ্ঠত, আমাদের দাবি অনুযায়ী টিকা যদি বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনভাবে বিনা মূল্যে পাওয়া যায়, তাহলে এই তথ্যাদি সহযোগে সমন্বিত উদ্যোগে করোনাকে আমরা গুটিবসন্তের মতো পৃথিবী থেকে চিরতরে নির্মূল করতে পারব বলে বাস্তবায়নযোগ্য স্বপ্ন দেখা শুরু করতে পারি।
এখন অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন করোনার এই নব-আবিষ্কৃত টিকাগুলো নিরাপদ হবে কি না। আমার মতে, যেকোনো নব-আবিষ্কৃত জিনিস সম্পর্কেই নিরাপত্তার প্রশ্ন থাকা মানুষের সচেতনতারই প্রতিফলন। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য বিষয়ে এই সচেতনতা বাড়ছে, দেখে ভালো লাগছে। আগামী দিনে টিকার নিরাপত্তা নিয়ে লেখার ইচ্ছা রইল।
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার এবং
সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
abmfaroque@yahoo.com
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: