

ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ তথা ‘মুজিববর্ষ’ উদ্যাপনের মহতী কালপর্বে ভাষার মাস ‘ফেব্রুয়ারি’ আমাদের জাতীয় জীবনে নবরূপে আবির্ভূত হয়েছে। বছরব্যাপী ‘মুজিববর্ষ’ পালনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি ক্ষণ আজ নতুন প্রজন্মসহ সবাই জানতে পারছেন। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে মহত্তর মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে তাঁর ঐতিহাসিক অবদান পরম শ্রদ্ধায় সবাই স্মরণ করছেন।
এই ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখটি প্রতি বছর গভীরভাবে স্মরণ করি। দিবসটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। ১৯৬৯-এর এই দিনে বাংলার দুঃখী মানুষের বন্ধু, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতাকে জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বাঙালির জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে ’৬৯-এর গণআন্দোলন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, কালপর্বটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ‘ড্রেস রিহার্সেল’। জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফা দেওয়াকে অপরাধ গণ্য করে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সর্বমোট ৩৫ জনকে ফাঁসি দেওয়ার লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ তথা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয় এবং নির্বিঘেœ পুনরায় ক্ষমতায় আরোহণের এক ঘৃণ্য মনোবাসনা চরিতার্থে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। আগরতলা মামলার বিচার যখন শুরু হয় তখন আমরা উপলব্ধি করি বঙ্গবন্ধুকে যদি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয় তাহলে চিরদিনের জন্য বাঙালি জাতির কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে। কেননা এই একটি কণ্ঠে কোটি কণ্ঠ উচ্চারিত হয়। তাই আমরা ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন এবং ৬ দফাকে হুবহু যুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করি। ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় এবং পূর্ব ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়।
শুরুতেই বলেছি, ২৩ ফেব্রুয়ারি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না সেই জনসমুদ্রের কথা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছি, তখন রেসকোর্স ময়দানে মানুষ আর মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমার বোঝাই হয়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে। ঢাকার মানুষ তো আছেই। অভিভূত হয়ে পড়লাম। এর আগে এত বড় জনসভা দেখিনি। সেই জনসমুদ্রে লাখ লাখ লোক এসেছে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে একনজর দেখতে। প্রিয় নেতাকে নিয়ে আমরা মঞ্চে উঠলাম। সেদিন সেই মঞ্চে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছিলেন। চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আগেই সভাপতির ভাষণ দেওয়ার জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ মানুষকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলাম, ‘সবার শেষে বক্তৃতা করার কথা থাকলেও আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আগেই বক্তৃতা করতে চাই। ’ ১০ লাখ লোকের সম্মতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আগেই বক্তৃতা করি। সেদিন যে ভালোবাসা মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলাম, ‘প্রিয় নেতা তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী।
বাংলাদেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে- ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ। একেকটি আন্দোলনের একেক রকম চরিত্র্য-বৈশিষ্ট্য ছিল। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যে, তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিচারের কাজ চলছিল। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে ’৬৮-এর ১৯ জুন বিচারের কাজ শুরু হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাবার জন্য আইয়ুব খান পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আইয়ুব খানের তথ্য সচিব আলতাফ গওহর ‘আইয়ুব খান’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে উল্লেখ আছে কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু ’৬৯-এর গণআন্দোলনের শহীদদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ সেই ষাড়যন্ত্রিক প্রচেষ্টাকে সমাধিস্থ করে এবং আসাদ, মতিউর, মকবুল, রুস্তম, আলমগীর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, আনোয়ারা ও ড. শামসুজ্জোহার জীবনের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আন্দোলন সফল হয়। জানুয়ারির শেষের দিকে নারায়ণগঞ্জের এক জনসভায় দম্ভোক্তি করে আইয়ুব খান বলেছিলেন, তিনি আবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবেন। অথচ ১৭ জানুয়ারি আন্দোলন শুরু হলো, ২০ জানুয়ারি আসাদ শহীদ হলেন, ২৪ জানুয়ারি শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হলে সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং সেই আইয়ুব খান এক দিন পরই বলেছেন, ‘আমি আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না। ’ একটি আন্দোলন সাত দিনের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়- ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে, ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে! এর তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ, যাদের রক্তঋণে গোটা জাতি ঋণী, তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ভোলায় নিজ গ্রামে ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই জাদুঘরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে শহীদ সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের স্মৃতি, মহান ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন, শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনকের দুর্লভ সব আলোকচিত্র সেখানে স্থান পেয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববরেণ্য মহান নেতা। তাঁর কোনো তুলনা হয় না। তিনি জন্মেছিলেন বলেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তিনি যদি না জন্মাতেন আমরা আজও পাকিস্তানের দাসত্বের নিগঢ়ে আবদ্ধ থাকতাম। সেই মহান নেতা তাঁর জীবদ্দশায় সব সময় এই দিনগুলোর কথা সংবাদপত্রে বাণী, বিবৃতি দিয়ে শহীদদের কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতেন। কেননা, তিনি জানতেন ৬ দফা আন্দোলন না হলে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হতো না; ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান না হলে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারতাম না; বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্ত না হলে ’৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানে আমরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারতাম না; আর পাকিস্তানে যদি আমরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারতাম তাহলে নয় মাস যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করতে পারতাম না। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রসমাজের যে ভূমিকা তা গৌরবোজ্জ্বল।
বছর ঘুরে এমন একটি মধুর দিন যখন ফিরে আসে হৃদয়ের মানসপটে কত স্মৃতি ভেসে ওঠে। আমরা সংখ্যাসাম্যের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুর অবস্থান থেকে ‘এক মাথা এক ভোট’-এর দাবি তুলে তা আদায় করেছিলাম। ফলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাধিক্য আসন আমরা লাভ করেছিলাম। এদিনের প্রতিটি মুহূর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে মনে পড়ে। সেদিন বক্তৃতায় আরও বলেছিলাম, ‘৬ দফা ও ১১ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা ফিরে পেয়েছি। তাদের সে রক্ত যেন বৃথা না যায়, তার জন্য জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সব মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। ’ বক্তৃতা শেষ করে ঘোষণা করেছিলাম, ‘এখন বক্তৃতা করবেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ’ তুমুল করতালির মধ্যে তিনি বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেন। চারদিকে তাকিয়ে উত্তাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে বললেন, ‘রাতের অন্ধকারে সান্ধ্য আইনের কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করে যে মানুষ ‘মুজিবকে ফিরিয়ে আনতে হবে’ বলে আওয়াজ তুলে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তাদের দাবির সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। ’ সংগ্রামী ছাত্রসমাজকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ছাত্রদের ১১ দফা শুধু সমর্থনই করি না, এর জন্য আন্দোলন করে আমি পুনরায় কারাবরণে রাজি আছি। ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে আমার ৬ দফা দাবিও নিহিত রয়েছে। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি যদি এ দেশের মুক্তি আনতে ও জনগণের দাবি আদায় করতে না পারি, তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে যাব। ’ সেদিন বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘আমি গোলটেবিল বৈঠকে যাব, সেখানে আমার ৬ দফাও পেশ করব, ১১ দফাও পেশ করব। ’ তিনি জীবদ্দশায় কোনো দিন ১১ দফার কথা ভোলেননি। তাঁর বক্তৃতায় সব সময় ’৬৯-এর গণআন্দোলনের কথা থাকত। এমনকি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে আছে, ‘১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। ’
পরিশেষে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞস্বরে বলেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, তোমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছ, যদি কোনো দিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাব। ’ তিনি একা রক্ত দেননি- ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিন। যত দিন বেঁচে থাকব হৃদয়ের গভীরে লালিত এ দিনটিকে স্মরণ করব।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: