
অবশেষে সকল ভয় আর দুশ্চিন্তাকে জয় করে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলো দেশের বৃহত্তম ঈদের জামাত। এবারের ১৯০ তম ঈদ জামাতকে কেন্দ্র করে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। জামাতে ইমামতি করেন বাংলাদেশ ইসলাহুল মুসলেমিন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।
দূরের মুসল্লিদের জন্য দুটি বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু করে রেলওয়ে। সকাল ৬টায় ভৈরব ও ময়মনসিংহ থেকে শোলাকিয়া এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেন ছেড়ে আসে। নামাজের পর ট্রেন দু’টি মুসল্লিদের নিয়ে আবারও ফিরে যায়।
ঈদ জামাত শুরু হয় সকাল ১০টায়। এর আগে ভোর থেকে মুসল্লিরা দলে দলে ঈদগাহে আসতে থাকেন। সকাল ৯টা নাগাদ প্রায় ৬ এক আয়তনের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান ভরে যায় কানায় কানায়। তখনও শোলাকিয়ার পথে হাজার হাজার মুসল্লির ঢল। নামাজ শুরুর আগ মুহূর্তে মাঠ ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তায় অবস্থান নেন মুসল্লিরা। জামাত শুরুর ১৫ মিনিট আগে তিনবার, ৫ মিনিট আগে ২ বার ও ১ মিনিট আগে একবার বন্দুকের গুলি ছুড়ে জামাতের চূড়ান্ত প্রস্তুতি ঘোষণা করা হয়।
জামাত শুরুর আগে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আজিম উদ্দিন বিশ্বাস, পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন খান ও কিশোরগঞ্জ পৌর সভার মেয়ার মাহমুদ পারভেজ ও কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসউদ।
ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি বাবুল আহমেদ, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাড. মো. জিল্লর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এ মাঠে নামাজ পড়েন।
এ দিকে ঈদকে ঘিরে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বল গড়ে তোলা হয়। মোতায়েন করা হয় বিজিপি, র্যা ব-পুলিশসহ সহস্রাধিক নিরাপত্তা বাহিনী। মাঠে প্রবেশের সময় সর্বোচ্চ ১০ বার নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয়। নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকায় অনেক মুসল্লি মাঠে প্রবেশ করতে না পারায় ঈদগাহের সামনের রাস্তায় নামাজ পড়েন।
নামাজ শেষে মুসলিম উম্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত করেন মাঠের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।
গত বছর ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় নতুন করে ঢেলে সাজানো হয় নিরপত্তা ব্যবস্থা। মাঠের ভেতরে ও বাইরে মোতায়েন করা হয় ৫ প্লাটুন বিজিবিসহ র্যা ব-পুলিশের সহস্রাধিক সদস্যকে। ঈদগাহ এলাকা ছাড়াও মাঠের এক কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা নিয়ে আসা হয় সিসি ক্যামেরার আওতায়। মুসল্লিদের ৬ থেকে ১০ বার দেহ তল্লাশি করে মাঠের ভেতর প্রবেশ করতে হয়। আর নিরাপত্তার স্বার্থে দু’টি প্রধান সড়ক খোলা রেখে বাকি রাস্তাগুলি বন্ধ করে দেয়া হয়।
নামাজ শুরুর আগে পুরো মাঠ মেচাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি করা হয়। মিম্বর থেকে মাঠের একটি অংশ বাঁশের বেড়া দিয়ে খালি রাখা হয়। মুসল্লিদের জায়নামজ ছাড়া ব্যাগ, ছাতা, লাঠি এমনকি মোবাইল ফোন নিয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। তবে অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য মুসল্লিদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেক মুসল্লি মাঠে প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে যান। অনেকে সামনের রাস্তা ও সেতুতে নামাজ আদায় করেন।
জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দীন বিশ্বাস জানান, ব্যাপক প্রস্তুতির জন্য শান্তিপূর্ণভাবে ঈদের জামাত শেষ হয়েছে।
পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান জানান, ঈদ জামাত নির্বিঘ্ন করতে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। র্যা ব-পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও সাদা পোশাকের নিরাপত্তা বাহিনী কাজ করেছে।
জনশ্রুতি আছে কোনো এক ঈদের জামায়াতে শোলাকিয়া ঈদগাহে মুসল্লি সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে সোয়া লাখে (১ লাখ ২৫ হাজার) পৌঁছেছিল। সেই থেকে এ মাঠের নামকরণ হয় `সোয়ালাখিয়া।’ পরে কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক উচ্চারণে এর নামকরণ দাঁড়ায় সোয়ালাখিয়া থেকে শোলাকিয়া।
শোলাকিয়া ঈদগাহে জমির পরিমাণ ৬.৬১ একর। চারদিকে দেয়াল ঘেরা মাঠের পশ্চিম সীমারেখা উত্তর-দক্ষিণে ৩৩৫ ফুট এবং পূর্ব সীমারেখা উত্তর-দক্ষিণে ৩৪১ ফুট, উত্তর সীমারেখা পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৪ ফুট। ঈদের সময় মাঠের উত্তর-দক্ষিণে ২৬৫টি কাতার বা সারি হয়। প্রতি সারিতে ৫শ করে স্বাভাবিকভাবে মুসল্লি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারেন। সে হিসেবে মুসল্লির সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৫শ।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাঠের ভেতর-বাইরে প্রতিবছর ঈদুল ফিতরে মুসল্লির সংখ্যা হয় দ্বিগুণ বা তারও বেশি। গত বছর ঈদুল ফিতরের জামায়াতে রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লিরা অংশ নেন। বর্তমানে মাঠের পশ্চিম দিকে নির্মিত দ্বিতল মিম্বরটি সংস্কার করা হয়েছে। সাউন্ড সিস্টেমেরও উন্নয়ন করা হয়েছে। নতুনভাবে নির্মিত হয়েছে অজুখানা।
গত বছর ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহের কাছে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। তাই এবার মানুষের মধ্যে ছিল আতংক। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শেষ হলো ঈদের জামাত।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: