
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষার আলোয় আলোকিত ব্যক্তি ও জাতি উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করে। সে কারনেই যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। উন্নত জাতিগুলোর শিক্ষার হার ও গুনগত মান কাক্সিক্ষত ও আশাব্যঞ্জক। আমাদের দেশের শিক্ষার হার নিয়ে সুশীল সমাজ ও সরকারের উচ্চ মহল আশাব্যঞ্জক বাণী শোনালেও শিক্ষার গুনগত মান নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে বিগত এক-দুই দশক ধরে শিক্ষার হার আশানুরুপ বৃদ্ধি অবশ্যই মঙ্গলজনক তবে পরীক্ষায় পাস কিংবা জি.পি.এ ৫ এর হার বৃদ্ধিই যে শিক্ষার কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য বা মানসম্মত শিক্ষা অর্জন করছে তা নয়।
কোভিড-১৯ এর প্রভাবে সারা বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ ও বিপর্যস্ত। বাংলাদেশে এ অবস্থা আরো ভয়াবহ। ২০২১ সালের অক্টোবরে ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো প্রকাশিত ‘কোভিড-১৯ এর প্রভাব ও মোকাবেলা কার্যক্রম বিষয়ক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ি, বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ব্যহত হয়। সরকারি কর্মসূচীর আওতায় স্কুল-কলেজ সমূহে অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস হলেও সেটির সার্বিক সফলতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাছাড়া কোভিড পরবর্তীতে স্কুল-কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা চালু হলেও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হারও নগণ্য নয়। তাই কোভিডের ক্ষতি পুষিয়ে শিক্ষার হার ও মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে সরকার সহ সবাইকে ভাবতে হবে নতুন আঙ্গিকে।
মানসম্মত শিক্ষা কী?
মান বলতে কোন ব্যক্তি বা বস্তুর আদর্শ বা কাক্সিক্ষত অবস্থা বুঝায়। আর মানসম্মত শিক্ষা বলতে বুঝায়, শিক্ষার আদর্শ বা কাক্সিক্ষত অবস্থা, যা অর্জিত শিক্ষা থেকে প্রত্যাশা করা হয়। অর্থাৎ অর্জিত শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ, নতুন নতুন জ্ঞানের আবিস্কার; পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণকামী শিক্ষাই মানসম্মত শিক্ষা।
মানসম্মত শিক্ষার অন্তরায় সমূহ:
- শিক্ষাখাতে সরকারি বরাদ্দ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম অথচ আমাদের দেশে শুধু স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি।
- শিক্ষকতা পেশায় সামাজিক অবস্থান, ক্ষমতা, বেতন ও সুযোগ সুবিধা অন্য সকল পেশার তুলনায় কম। তাই উপযুক্ত ও মেধাবীরা এ পেশার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না।
- শিক্ষার্থীদের মোবাইলের যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে তাদের পড়াশোনা, শরীর ও মনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
- কিশোর অপরাধের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলার অবনতি হয় এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হয় ।
- দলীয় লেজুর ভিত্তিক রাজনীতির কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষমতার দাপট প্রদর্শন করতে চায় এবং ক্লাস বিমুখ থাকে।
- রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যেমন- হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উত্তপ্ত থাকে এবং বন্ধ করে দেওয়া হয়।
- শিক্ষকদের নিজস্ব বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণের অভাব ।
- ক্লাসের পূর্বে পাঠদানকারী বিষয়ের উপর শিক্ষকদের জ্ঞানগর্ভ ধারনা না নিয়ে যাওয়া।
- শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়ানো, পদ-পদবীর লোভ, নিজেদের মধ্যে পরচর্চা, সমালোচনা।
- শিক্ষার ব্যবসায়িকরণ ও শিক্ষা উপকরণের ঘাটতি ও দাম বৃদ্ধি।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অপ্রতুলতা।
- সুস্থ মেধাবিকাশ যোগ্য শ্রেণীকক্ষ ও শিক্ষাঙ্গনের অভাব।
- অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব ও শুধু পরীক্ষার ফলাফলের পিছনে ছুটা।
মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে পদক্ষেপ সমূহ:
- আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ি শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ করা।
- আলাদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে উচ্চ বেতন কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা, যাতে উপযুক্ত ও মেধাবীরা এ পেশায় আসতে আগ্রহী হয় ।
- আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা।
- প্রতিষ্ঠান প্রধানদের হতে হবে বিজ্ঞ,দক্ষ, ত্রিকালদর্শী এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারি ।
- শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহারের নির্দিষ্ট বয়সসীমা বা অধ্যয়নকৃত শ্রেণি নির্ধারণ করে দেয়া।
- যে সময়ে কিশোরেরা ক্লাসে বা বই নিয়ে টেবিলে থাকার কথা, সে সময়ে গলির মুখে, রাস্তা-ঘাটে ইভ টিজিং ও আড্ডামেরে সময় পার করে। তাই কিশোর অপরাধ লাঘবে সামাজিক শাস্তি বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া ।
- দলীয় অন্ধ আনুগত্যের রাজনীতি ত্যাগ করে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব এবং রাষ্ট্রের কল্যাণকামী উদ্দেশ্যে রাজনীতি করা উচিত।
- শিক্ষকবান্ধব মনিটরিং টিম গঠন করা। এক্ষেত্রে স্থানীয় শিক্ষিত ও আর্দশবান ব্যক্তিদের উক্ত টিমে সংযুক্ত করা ।
- বছরে অন্তত দু’বার অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করা। শিক্ষা ও ক্লাসের গুরুত্ব, প্রযুক্তির ব্যবহার ও অপব্যবহার, কিশোর অপরাধ প্রভৃতি বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনা ও মতামত গ্রহন করা।
- সৎ, নিষ্ঠাবান, কর্মতৎপর, দক্ষ শিক্ষক বাছাই ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা । এতে অন্যান্য শিক্ষকরাও দায়িত্ব ও সততার ব্যাপার আগ্রহী হবে ।
- ক্লাসে সিলেবাসভুক্ত পড়াশোনার পাশাপাশি অনুপ্রেরনামূলক বক্তব্য, কৌশলী, উদার, পরমতসহিষ্ণু ও উচ্চ নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন মানসিকতা তৈরির পদক্ষেপ গ্রহন করা ।
- শিক্ষা উপকরণের ঘাটতি পূরণ ও দাম কমানো এবং আর্থিক লাভের উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত ভূঁইফোড় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করা ।
- সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সুকুমার বৃত্তির উন্মেষ ঘটে । তাই নাচ, গান ,আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, খেলাধুলা প্রভৃতি কর্মকান্ডের আয়োজন করা ।
- ক্লাসরুমগুলো প্রযুক্তি নির্ভর করা এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ।
- ক্লাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপাত কমিয়ে আনা ।
- শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের মাধ্যমে উপযুক্ত, দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। এক্ষেত্রে জাতীয়করণ হলে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যও বন্ধ হবে।
মানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে সমসাময়িক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি খাতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আগামী ৮ বছরে জাতিসংঘের ২০৩০ সালের এজেন্ডা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রার শিক্ষা বিষয়ক লক্ষ্য অর্জন করতে এবং কোভিড-১৯ এর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার সহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় কেবল এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
মো. মোবারক হোসেন
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,মালখানগর কলেজ।
মালখানগর, সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: