ঢাকা | শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

চিকুনগুনিয়ার আর্থ্রাইটিস

MASUM | প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০১৭ ২১:৩৩

MASUM
প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০১৭ ২১:৩৩

চিকুনগুনিয়ার আর্থ্রাইটিসচিকুনগুনিয়ায় ব্যথার জন্য আলাদাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার নেই


চিকুনগুনিয়া অর্থ বাঁকা হয়ে যাওয়া। সাধারণত এডিস অ্যালবোপিকটাস ও এডিস ইজিপ্টি মশার কামড়ে তিন থেকে সাত দিনের মাথায় চিকুনগুনিয়া হতে পারে। পৃথিবীর ৪০টিরও বেশি দেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব হয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৮ সালে সীমিত আকারে প্রথম চিকুনগুনিয়া দেখা দেয়। এরপর বেশ কয়েকবার এই রোগের প্রাদুর্ভাব হলেও এ বছরের মতো এত ব্যাপক প্রাদুর্ভাব আর কখনো হয়নি। এডিস মশার জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করলে ৮৫ শতাংশেরই চিকুনগুনিয়া রোগটি হয়ে যায়। বাকি ১৫ শতাংশ মানুষ এই রোগজীবাণু প্রবেশ করার পরও রোগাক্রান্ত নাও হতে পারে।

 

উপসর্গ

চিকুনগুনিয়ায় সাধারণত প্রথমে তীব্র মাত্রার জ্বর হয়, যা  দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে এর ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। অন্য উপসর্গগুলোর মধ্যে চামড়া লাল বা চাকা হয়ে যাওয়া বা র‌্যাশ হতে পারে। মাথাব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, র‌্যাশ ইত্যাদি হতে পারে।

চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের অধিকাংশ রোগীই বাত-ব্যথায় আক্রান্ত হন।

 

 

ব্যথাই মূল সমস্যা

২০০৫-০৬ সালে ফ্রান্সে যখন চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব হয়, তখন ফ্রান্সের অন্তর্গত রি-ইউনিয়ন দ্বীপে তিন বছর পরও দেখা যায়, প্রায় ৬০ শতাংশের মতো রোগীর ব্যথা রয়ে গেছে। অস্থিসন্ধি বা গিঁটে ব্যথাই মূলত এ রোগের অন্যতম সমস্যা।

চিকুনগুনিয়া হলে শরীরের ১০ বা তারও বেশি জয়েন্টে আক্রমণ হতে পারে। এতে সাধারণত হাতের কবজি এবং অন্য ছোট গিটগুলো এবং পায়ের গোড়ালির জয়েন্টগুলোতে বেশি আক্রমণ করার প্রবণতা থাকে। প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের হাড়গুলোতে আক্রমণ করে। গিঁটগুলো ফুলে যায়, লাল হয়ে যায়, প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। ৭০ শতাংশের তিন সপ্তাহ পর ব্যথার প্রকোপ কমে যায়। বাকি প্রায় ৩০ শতাংশের ব্যথা দীর্ঘমেয়াদি হয়। একপর্যায়ে এটি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসের মতো রোগে উপস্থাপিত হতে পারে।

 

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ দেখে যদি কারো চিকুনগুনিয়া হয়েছে বলে সন্দেহ হয়, তবে প্রথমেই মহাখালীর রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট—আইইডিসিআর থেকে আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করিয়ে রোগটি নিশ্চিত করা উচিত। পাঁচ দিনের মধ্যে এই পরীক্ষা করাতে পারলে সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়। পরবর্তীতে রক্তের আইজিএম এবং আইজিজি পরীক্ষার মাধ্যমেও রোগটির আক্রমণ সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যেতে পারে। এ সময় ডেঙ্গু জ্বরের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করানো উচিত।

 

চিকিৎসা ও করণীয়

চিকুনগুনিয়া মূল চিকিৎসাই উপসর্গভিত্তিক। এটি প্রতিরোধের জন্য এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য জ্বর ও ব্যথা ব্যবস্থাপনা। চিকুনগুনিয়া জ্বরের চিকিৎসার জন্য প্রথমদিকে (দুই সপ্তাহ পর্যন্ত) শুধু প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ সেবন করা উচিত। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি, তরল খাবার খাওয়া ও বিশ্রাম নিতে হবে। চিকিৎসক এ সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করবেন যে এটা ডেঙ্গু জ্বরের বিপজ্জনক পর্যায় নয়। কেননা, যদি তা বিপজ্জনক পর্যায়ে থাকে, তবে শক্তিশালী ব্যথানাশক বা এনএসএআইডি গ্রুপের ও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করলে রোগীর বিপদ হতে পারে। চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে দুই সপ্তাহ পর থেকে ব্যাথানাশক ওষুধ দিতে পারেন।

চিকুনগুনিয়া আর্থ্রাইটিসকে সাধারণত একিউট পর্যায়, পোস্ট একিউট পর্যায় ও ক্রনিক পর্যায়—এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়।

 

একিউট পর্যায়

চিকুনগুনিয়ায় প্রথম ভাগের আক্রমণ সময়কে বলা হয় একিউট ফেইস বা প্রথম পর্যায়। যখন জ্বর ও র‌্যাশ কমে যায়, সে সময়টিই মূলত একিউট পর্যায়। সাধারণভাবে এটি হলো রোগটি আক্রমণের প্রথম দুই সপ্তাহ সময়কাল। এ সময় রোগীকে প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ সেবন, পর্যাপ্ত পানি পান ও পরিপূর্ণ বিশ্রাম করতে হবে।

 

পোস্ট একিউট পর্যায়

দুই সপ্তাহ থেকে তিন মাস সময়কে পোস্ট একিউট পর্যায় বলা হয়। এই পর্যায়ে গিঁটগুলো ফুলে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে। এর সঙ্গে ঝিন ঝিন বা শিন শিন এ ধরনের উপসর্গও থাকতে পারে। এ ধরনের উপসর্গ থাকলে গাবাপেন্টিন বা প্রি-গাবালিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে খুব স্বল্প সময়ের জন্য স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। এ সময় ফিজিওথেরাপিরও সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

 

ক্রনিক পর্যায়

তিন মাসের পরও যাদের বাতব্যথা ভালো হয় না বা ব্যথা রয়েই যায়, সেটি হলো ক্রনিক পর্যায় বা ক্রনিক আর্থ্রাইটিস। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে হবে। ভেতর থেকে বাধা প্রদানকারী ওষুধ, যেগুলো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস রোগে ব্যবহৃত ওষুধ যেমন—মেথোপ্রেক্সেট বা সালফার সেলাজিন-জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে। এ পর্যায়ে একজন রিউম্যাটোলজি বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিয়ে চিকিৎসা চালাতে হবে। বেশ কয়েক মাস ধরে যদি ব্যথা নিয়ন্ত্রণে থাকে তবে এই ওষুধগুলো পরিহার করা যেতে পারে।

 

জটিলতা

যাদের আগে থেকেই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিসের মতো রোগ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে চিকুনগুনিয়ার উপসর্গগুলো অনেক তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা যেমন : এনকেফালাইটিস, সেপটিসেমিয়া, স্ট্রোক ইত্যাদি হতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগ রয়েছে, তারা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে জটিলতা বৃদ্ধি পেতে পারে।  

 

অনুলিখন : আতাউর রহমান কাবুল



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: