
সময়ের ঘুলঘুলি দিয়ে সেই দিনটা দেখা যায় স্পষ্ট। বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেক যে ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর, তা আর কতই বা দূরে? দেড় যুগও তো পেরোয়নি এখনো। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার পথচলা শুরুর ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ যেন দূর সুদূরের। সময়ের দুরবিনে চোখ রাখলেও তাই আবছা আবছায়া ছাড়া দেখা যায় না তেমন কিছু।
অভিজ্ঞতায় তাই অন্তত অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার উপায় নেই বাংলাদেশের। শতাব্দী শুরুর সেই আশ্চর্য সকালে নাঈমুর রহমান যখন সৌরভ গাঙ্গুলীর সঙ্গে টস করছেন, তত দিনে ১২৩ বছরে ৬০৯ টেস্ট খেলা সারা অসিদের। তাদের ৩৮৩ জনের মাথায় উঠে গেছে বিখ্যাত ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ। আর বাংলাদেশের শুরু শূন্য থেকে। অভিজ্ঞতার সেই শূন্যতা সময়ের নিয়মে ভরছে একটু একটু করে। দলের যেমন, তেমনি ক্রিকেটারদের। তবু প্রত্যাশিতভাবেই ২০০৬ সালে সর্বশেষ যে টেস্ট সিরিজে মুখোমুখি বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া, তখনো দুই দলের খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতা-সাফল্যে বিস্তর ফারাক।
এক দল ক্রিকেটার পায়ের নিচে মাটি খুঁজছে। অন্যরা সেই মাটিতে সাফল্যের প্রাসাদ গড়ে তুলেছে কবে!
২০১৭ সালের ছবি কিন্তু দিচ্ছে ভিন্ন বার্তা। এখন অভিজ্ঞতা কিংবা সাফল্যের ব্যবধানটা আর সেই আকাশ-পাতাল নেই। কোথাও কোথাও বরং অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ!
২০০৬ সালের ফতুল্লা টেস্ট এ দেশের ক্রিকেটের এক অনন্ত আক্ষেপ। জিততে জিততেও যে জেতা হয়নি! হারানো যায়নি সর্বকালের অন্যতম সেরা অস্ট্রেলিয়ার ওই টেস্ট দলকে। তবে মাঠে নামার আগে রিকি পন্টিংদের হারানোর বিশ্বাস যে হাবিবুল বাশারের দলের ছিল না, তা স্বীকারে অকপট সেই স্কোয়াডের সবাই। করবেন না কেন? প্রতিপক্ষে যে ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরাদের মিছিল। তত দিনে তাঁদের প্রায় সবাই অভিজ্ঞতা-সাফল্যের চূড়ায়। তুলনায় বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ছিলেন আলোকবর্ষ পিছিয়ে।
কতটা? বুঝতে হলে দুই দলের তুলনামূলক বিশ্লেষণে চোখ রাখুন। ১১ বছর আগে সিরিজের প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার যে ১১ জন, তাঁদের সামগ্রিক অভিজ্ঞতা ছিল ৬৬১ টেস্টের। বাংলাদেশ একাদশের সাকল্যে ২২৬ ম্যাচের। পরিসংখ্যানের ঐশ্বর্যমাখা পাতায় তখনই ১১ অসির ৩২৪০৮ রান। স্বাগতিকদের মেরেকেটে হাজার দশেকও হয়নি, ৯৩৪৩ রান। এক পন্টিংয়ের টেস্ট রানই তত দিনে পুরো বাংলাদেশ একাদশের কাছাকাছি, ৮৬০১। বাংলাদেশের সর্বোচ্চও অধিনায়ক হাবিবুলের, তবে তা মোটে ২৬৯৭। ওদের ৮৯ টেস্ট সেঞ্চুরির বিপরীতে স্বাগতিকদের মোটে ৯টি, ১২৭ হাফসেঞ্চুরির বিপরীতে ৪৭টি। আর উইকেট? শেন ওয়ার্ন, ব্রেট লি, জ্যাসন গিলেস্পি, স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলরা মিলে তত দিনেই ঝুলিতে পুরেছেন ১৩৫১ টেস্ট উইকেট। মোহাম্মদ রফিক, মাশরাফি বিন মর্তুজা, শাহাদাত হোসেনদের মিলিত শিকার সেখানে ১৮০! ও-পক্ষে সর্বোচ্চ ওয়ার্নের ৬৭৪ উইকেট, এ-পক্ষে রফিকের ৭৬। বাংলাদেশের বোলাররা ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ১০ বার, সেখানে এক ওয়ার্নই ৩৫ বার। সব মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সংখ্যাটি ৬৩।
এবার চলে আসা যাক ২০১৭ সিরিজের আবহে। এখানে কিন্তু দুই দলের অমন দুর্লঙ্ঘ্যনীয় দূরত্ব নয়। সমানে সমানে পাল্লা তাদের, কোথাও বাংলাদেশ এগিয়ে তো অন্য কোথাও অস্ট্রেলিয়া। অসি স্কোয়াডের সামগ্রিক অভিজ্ঞতা ২৯৩ টেস্টের, বাংলাদেশের মোটে ২০ টেস্ট কম। রানের দিক দিয়ে তো এগিয়েই স্বাগতিকরা। মুশফিকুর রহিমের স্কোয়াডের সম্মিলিত টেস্ট রান ১৬১২০, স্টিভেন স্মিথের দলের ক্ষেত্রে তা ১৫৮৬৭। সর্বোচ্চর ব্যক্তিগত হিসেবে অবশ্য পিছিয়ে কিছুটা। ওয়ার্নারের ৫৪৫৪ রানের বিপরীতে তামিম ইকবালের ৩৬৭৭। সেঞ্চুরিতে আবার বেশ এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের ১৪ জনের মিলিত সেঞ্চুরি ২৬টি; সেখানে স্মিথের একারই ২০টি, ডেভিড ওয়ার্নারের ১৮টি। সব মিলিয়ে ওদের ৪৯ টেস্ট শতরান। ফিফটিতে আবার বেশ এগিয়ে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার ৬৩-র চেয়ে ২৮টি বেশি।
২০০৬ সালে দুই দলের উইকেট শিকারের তুলনাই ছিল হাস্যকর। এবার পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। না হয় এখনো এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া, তবে সেবারের মতো ব্যবধান ১১৭১ উইকেটের না। বাংলাদেশ স্কোয়াডের সামগ্রিক টেস্ট উইকেটসংখ্যা ৩০৩-এর চেয়ে ১৪১টি বেশি অস্ট্রেলিয়ার। স্বাগতিকদের সবচেয়ে বেশি ১৭৬ উইকেট সাকিব আল হাসানের, ২৪৭ শিকারে সফরকারীদের অফস্পিনার নাথান লিয়নের মাথায় সেই মুকুট। ইনিংসে ৫ উইকেটের হিসাবে আবার এগিয়ে বাংলাদেশ। সাকিবের ১৫ বারের সুবাদে দলের সংখ্যাটি গিয়ে পৌঁছেছে ২১-এ। অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের এই কৃতিত্ব ১৬ বার।
ম্যাথু হেইডেন, রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, শেন ওয়ার্ন, ব্রেট লি, জ্যাসন গিলেস্পি, স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল— ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সফরে আসা অস্ট্রেলিয়া দল যেন ক্রিকেট ইতিহাসের এক রত্নভাণ্ডার। মাইক হাসি, মাইকেল ক্লার্কদের মতো কিংবদন্তিদের পথচলার শুরুর দিন সেগুলো। এবারের অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে অমনটা বলা যাবে না কিছুতেই। স্মিথ, ওয়ার্নার, সঙ্গে হয়তো বা লিয়ন—এই তো ওদের সেরা রত্ন। তুলনায় বাংলাদেশের তামিম, সাকিব, মুশফিকরা কত দ্যুতিময়! কত জ্বলজ্বলে!
অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে তাঁরা পরীক্ষিত। সাফল্যের দীপ্তিতেও উজ্জ্বল। শুধু শুধুই তো সিরিজের আবহে বাংলাদেশের আকাশে স্বপ্নঘুড়ি উড়ছে না!
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: