ঢাকা | রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২

চোখের দেখায় রোহিঙ্গাদের দিনলিপি

MASUM | প্রকাশিত: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ২২:৩৩

MASUM
প্রকাশিত: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ২২:৩৩

মিয়ানমারের বৃদ্ধ আবুল হাশিম তাঁর স্বজনদের সঙ্গে দীর্ঘ সাত দিনের পথ পাড়ি দিয়ে আজ টেকনাফে পৌঁছান। সোমবার দুপুরে হারিয়াখালী এলাকা থেকে তোলা ছবি। ছবি: আশরাফুল আলম


সাবরাংয়ের হারিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিচের তলায় ১৪ মাসের ছেলে কোলে দাঁড়িয়ে ছিলেন হুমায়ারা বেগম। টেকনাফের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো তৈরি করা হয়েছে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও স্কুল হিসেবে। ওপরের তলায় স্কুল, নিচে খোলামেলা চত্বরে আশ্রয়কেন্দ্র। সেখানে এসে সাময়িক যাত্রাবিরতি দিয়েছেন হুমায়ারার মতো তিন শতাধিক রোহিঙ্গা।

আজ সোমবার বেলা দুইটার দিকে কথা হলো হুমায়ারার সঙ্গে। তাঁর বয়স ১৮ বছর। কোলের মেয়েটির নাম সুফিয়া। ঈদের দুই দিন আগে অর্থাৎ ৩১ আগস্ট তাঁদের গ্রামে হামলা করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও স্থানীয় আরাকানিরা। গুলিতে হুমায়ারার স্বামী মো. হাশেম মারা যান। হুমায়ারা মেয়েকে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান তাঁর মা-বাবার সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গেই নাফ নদী পার হয়ে গতকাল রোববার রাতে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে এসে পৌঁছান। সেখান থেকে সাবরাংয়ের এই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে।

রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুরা ট্রাকে করে টেকনাফ শহরের দিকে যাচ্ছে। সোমবার হারিয়াখালী সাইক্লোন সেন্টারের সামনে থেকে তোলা ছবি। ছবি: আশরাফুল আলম


মানবিক কারণে বিজিবি বাংলাদেশের জলসীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ একটু শিথিল করেছে। সে কারণে প্রতিদিনই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাড়ছে। টেকনাফের উত্তর দিকে নাফ নদী ক্রমে সরু। দক্ষিণে প্রশস্ত হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে। উত্তর দিকে পাহারা কড়াকড়ি রাখা হয়েছে। যে কারণে দক্ষিণ দিক দিয়েই নৌকায় করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। জেলেরা মাছ ধরার নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের এপারে নিয়ে আসছে যার কাছে যেমন পাচ্ছে (জনপ্রতি দুই হাজার থেকে দশ হাজার বাংলা টাকা) তেমন ভাড়ায়। এসব নৌকা এসে ভিড়ছে মূলত দেশের দক্ষিণ অংশের শেষ মূল ভূখণ্ড শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং এবং সেন্ট মার্টিনে। পরে সেখান থেকে রোহিঙ্গারা সাবরাং এসে সমবেত হচ্ছে। সাবরাংয়ে বিজিবির তত্ত্বাবধানে তাদের ট্রাক, ট্রাক্টর বা চাঁদের গাড়িতে (বড় আকারের ফোরহুইল গাড়ি) করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে টেকনাফ ও উখিয়ার নতুন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে।

মিয়ানমার থেকে আসা এই হুমায়ারা বেগম বলছিলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাঁর স্বামী মো. হাশিমকে হত্যা করেছে। সোমবার তিনি কন্যা সুফিয়াকে নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। ছবিটি টেকনাফের হারিয়াখালীর সাইক্লোন সেন্টার থেকে তোলা। ছবি: গিয়াস উদ্দিন


এ ছাড়া স্থানীয় লোকজনও বড় জিপগাড়ি ভাড়া করে রোহিঙ্গাদের টেকনাফে পৌঁছে দিচ্ছেন। আবার অনেকে রোহিঙ্গা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় টেকনাফে আসছে। ফলে টেকনাফ শহরটি এখন রোহিঙ্গাদের মূল জমায়েতের স্থানে পরিণত হয়েছে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু-নর-নারীর সমাগমে টেকনাফ সরগরম হয়ে আছে।

আজ দুপুরে সাবরাং থেকে শাহপরীর দ্বীপে গিয়ে দেখা গেছে, কিছু সময় পরপরই একটি করে জেলে নৌকা এসে নোঙর করছে। নৌকা থেকে লাফ দিয়ে প্রায় হাঁটুপানিতে নামছে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। এরপর লবণের খেতের ভেতর দিয়ে একপাশ ভাঙা পাকা সড়ক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাজারের দিকে।

চোখে পড়ল দোলনার মতো করে একটি ইজি চেয়ারে এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। তাকে দড়ি ও বাঁশ বেঁধে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দুই যুবক। তাঁরা জানালেন, বৃদ্ধ আবুল হাশিম পক্ষাঘাতগ্রস্ত। যুবক দুজনের মধ্যে যিনি সামনে, তিনি বৃদ্ধের মেয়ের জামাতা নূর ইসলাম ও পেছনের জন ছেলে আনোয়ার হোসেন। তাঁদের পেছন পেছন হাঁটছে বাড়ির নারী ও শিশুর দল। আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে ২২ জনের দল। তাঁদের বাড়ি ছিল মংডুর খাইন্দার পাড়ায়। ঈদের দুই দিন আগে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। নাফ নদীর তীরে জলসীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ি জঙ্গলে তাঁরা লুকিয়ে ছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন নদী পার হওয়ার। এক বেলা করে শুকনো খাবার খেয়ে তাঁদের প্রায় এক সপ্তাহ কেটেছে। আজ সকালের দিকে তাঁরা নৌকায় রওনা দিয়েছিলেন নদী পার হতে।

দ্বীপের ছোট্ট নিরিবিলি বাজারটি এখন শত শত মানুষের হাঁকডাক, শিশুদের কান্না, নানা রকমের গাড়ির আওয়াজে সরগরম। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মী, ক্যামেরা ক্রু, নিরাপত্তারক্ষী, স্বেচ্ছাসেবক এসেছেন এখানে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ দেখতে বা তাদের সহায়তা দিতে।

সীমান্ত পেরিয়ে দলে দলে আসছে রোহিঙ্গা নর-নারী। সোমবার দুপুরে হারিয়াখালী এলাকায় থেকে তোলা ছবি। ছবি: আশরাফুল আলম


সড়কটি নদীর তীর থেকে এসে যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানেই স্থানীয় মসজিদ। এক বয়স্ক নারীকে দেখা গেল, বছর দেড়েক বয়সী এক শিশুকে নিয়ে বসে আছেন মসজিদের প্রাচীরে ঠেস দিয়ে। তাঁর পাশে বছর তিনেকের আরেকটি শিশু দাঁড়িয়ে। বড়ই বিপন্ন, বেদনার্ত মুখ। তাঁর নাম জামিলা খাতুন, ৪৫ বছর বয়স। স্বামী রশীদ আহমেদ অনেক আগেই রোগে ভুগে মারা গিয়ে রক্ষা পেয়েছেন। মেয়ে ছিল একটি। শরিফা। বিয়ে দিয়েছিলেন একই পাড়ার বশিরউল্লার সঙ্গে। মেয়ে-জামাই দুজনকেই খুন করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। খুনের আগে শরিফাকে ধর্ষণ করা হয়। পরে চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরা ফেলা হয় তাঁকে। শরিফার দুই মেয়ে ইয়াসমিন ও তাসমিনকে নিয়ে আজই বাংলাদেশে এসেছেন জামিলা খাতুন।

শাহপরীর দ্বীপের বাজারের মসজিদের পাশ দিয়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে পুরোনো কাপড় দিয়ে। নদী পেরিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সেখান থেকে তাদের মাপের কাপড় বেছে নিচ্ছে। কারণ, অধিকাংশ রোহিঙ্গাই আসছে বলতে গেলে এক কাপড়ে। হাতে একটি ছোট পোঁটলা বা প্লাস্টিকের বস্তা। তাতে কয়েকটি থালাবাসন বা শুকনো খাবার—এসবই হয়তো আছে। চট করে যাতে তারা বস্ত্রের অভাব মেটাতে পারে, সে জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করে সারা টেকনাফেই রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণ করছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের ত্রাণ তৎপরতা হিসেবে এই বস্ত্র বিতরণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সদ্য অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দেখা গেল নাফ নদীর পূর্ব পাড়ে মিয়ানমারের মংনিপাড়া, সুদাপাড়া ও জেলপাড়ার গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলে উঠেছে। শাহপরীর দ্বীপ থেকে খালি চোখেই বেশ স্পষ্ট আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা গেল। এ ছাড়া আজ সকালেও টেকনাফের নে-টং পাহাড় থেকে মংডুর শীলখালী, পেরাপুরু, নাকপুরা, রাইক্ষ্যা বিল গ্রামে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: