
পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের পাশে কলাপাড়া উপজেলার অঝোরা গ্রামে যখন গাড়ি পৌঁছাল তখন মাঝদুপুর। পৌষের দুপুরে রোদের তেমন তেজ নেই। মিঠে রোদে সড়কের পাশের চা দোকানে এক কাপ চায়ের স্বাদ নিতে নিতে কথা হলো স্থানীয় মকবুল হোসেনের সঙ্গে। খানিক দূরেই তার বাড়ি। ২৫ বছর বয়সী উদ্যমী যুবক শোনালেন তার এলাকার বদলে যাওয়ার গল্প। বললেন, এলাকার লোকজনের মূল পেশা কৃষি। এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। এখানে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে তা তারা কল্পনাই করেননি। কিন্তু গত কয়েক বছরে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তাদের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। দক্ষিণের এই অজপাড়াগাঁয়ে গড়ে উঠবে বিশ্বমানের শিল্প প্রতিষ্ঠান। পরিকল্পিত উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে এলাকাবাসীসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চল।
মকবুলদের এই স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছে পায়রা সমুদ্র বন্দর ও কাছাকাছি নির্মিতব্য এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই এলাকায় মোট ৯ হাজার মেগাওয়াটের বৃহৎ বিদ্যুৎ বা পাওয়ার হাব গড়ে তুলবে সরকার। এ জন্য সব মিলিয়ে ১২ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ করা হবে। হবে এলএনজি টার্মিনাল। নির্মাণাধীন এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০১৯-এর এপ্রিলে এবং একই বছরের অক্টোবরে উৎপাদনে আসবে সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট। এর মধ্যেই প্রকল্পের ৩৪ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমান অগ্রগতি অনুসারে পায়রার এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিই দেশের প্রথম বৃহৎ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র হতে যাচ্ছে।
নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের উন্নয়ন কার্যক্রম দেখতে সংবাদ কর্মীদের একটি দল ঢাকা থেকে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। গত শুক্রবার অঝোরা গ্রামে মহাসড়ক ছেড়ে গাড়ি যখন গ্রামের মেঠোপথ ধরে এগিয়ে চলল তখন মকবুলের কথার সত্যতা চোখে পড়ছিল। মাটির সড়কটির চারপাশে দিগন্তজুড়ে কোথাও ফসলের ক্ষেত, কোথাও পতিত জমি। মাঝে মাঝে দু'একটি ঘরবাড়ি। এই বিরান প্রান্তরেই যে দেশের প্রথম কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ জোরেশোরে এগিয়ে চলছে, তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ধানখালী গ্রামে প্রায় এক হাজার একর জমি মাটি ভরাট করে উঁচু করা হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজ এগিয়ে চলছে। প্লাইলিংয়ের কাজ প্রায় শেষ। প্রথম ইউনিটের বয়লার বসানোর জন্য ইস্পাত কাঠামো সগৌরবে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রধান ভবন, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ভবনসহ অন্যান্য কাজও এগিয়ে চলছে। প্রকল্পের একজন প্রকৌশলী জানালেন, এখন তো এই এলাকায় গাড়ি নিয়ে আসা যাচ্ছে। আড়াই বছর আগে তারা যখন প্রথম আসেন তখন গাড়ি আসার রাস্তাও ছিল না। আলপথ মাটি ভরাট করে ইট বিছিয়ে তারা চলাচলের উপযোগী করে নিয়েছেন। এখন মূল সড়কের সঙ্গে প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত একটি সড়ক উন্নয়নের কাজ চলছে। কাজ করছে সেনাবহিনীর ডিজেল প্ল্যান্ট। বিদ্যুৎকেন্দ্রর কয়লা আনতে অস্থায়ী জেটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। স্থায়ী জেটি নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ১২০ পরিবারের পুনর্বাসন কাজও শেষ পর্যায়ে। দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার প্রকৌশলী ও কর্মী দিন-রাত কাজ করছেন।
নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বাংলাদেশ এবং চীনের সমান অংশীদারিত্ব রয়েছে। দেশীয় নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) যৌথ বিনিয়োগে গঠিত বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিআইএফসিএল) কেন্দ্রটির মালিক। প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক বিনিয়োগ করছে। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই বিলিয়ন ডলার বা ১৬ হাজার কোটি টাকা। ৮০ শতাংশ ঋণ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। বাকি অর্থ সিএমসি ও নর্থ ওয়েস্ট এনডব্লিউপিজিসিএল সমান ভাগে বিনিয়োগ করবে। প্রকল্পের ঠিকাদারও চীনের। দেশটির এনইপিসি ও সিইসির যৌথ কনসোর্টিয়াম নির্মাণ করছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্পে চীনের দেড় হাজার কর্মী কাজ করছে।
পায়রা বিদ্যুৎ হাবে এনডব্লিউপিজিসিএল ৬ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। এর মধ্যে সিএমসির সঙ্গে সমান অংশীদারিত্বে আরও একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক এবং জার্মানির সিমেন্স এজির সঙ্গে তিন হাজার ৬০০ মেগাওয়াট এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হবে। এ ছাড়া এই স্থানে ১০০ মেগাওয়াটের একটি সৌর ও ৫০ মেগাওয়াটের একটি বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে এনডব্লিউপিজিসিএল। কলাপাড়ায় রুরাল পাওয়ার কোম্পানি-আরপিসিএল একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট এবং আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন লিমিটেড আরও একটি সমান ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে।
শুক্রবার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে আসেন। তিনি জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। এতে এই এলাকায় অন্তত ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হবে। পায়রা থেকেই ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এ জন্য এখানে মোট ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে, যা চারটি পদ্মা সেতুর বিনিয়োগের সমান। এক প্রশ্নের জবাবে নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণে চীন এবং ইউরোপ থেকে ঋণ নেওয়া হবে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ নেওয়া হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে উন্নতমানের কয়লা আনা হবে।
জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়ার পিটি বারতাবাং এবং অস্ট্রেলিয়ার ইয়ানকোল কোম্পানির সঙ্গে কয়লা সরবরাহের বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্রের জন্য প্রতিদিন ১০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা পোড়াতে হবে।
এনডব্লিউপিজিসিএলের ব্যবস্থাপনা পচরিচালক এএনএম খোরশেদুল আলম জানান, কেন্দ্রটিকে নির্ধারিত সময়ে উৎপাদনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। চলতি মাসেই কেন্দ্র নির্মাণে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণের অর্থ ছাড় করবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: