-2025-08-22-20-39-10.jpg)
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের (CWDs) জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ”একীভূত শিক্ষা” এখনও নীতির কাগজে সীমাবদ্ধ। যদিও সালামাঙ্কা স্টেটমেন্ট (১৯৯৪) এবং জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী অধিকার সনদ (CRPD, ২০০৬) শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্যহীন অংশগ্রহণের নীতি প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অনেক স্কুলে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব এবং অভিভাবকদের আর্থসামাজিক সীমাবদ্ধতা - সব মিলিয়ে অন্তর্ভুক্তি কেবল প্রতিশ্রুতির মধ্যেই আটকে আছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের কাংখিত শিক্ষায় অধিকার বঞ্চনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। যে শিশুটি এই মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সে সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুর মত সমাজ ও রাষ্ট্রে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না; যার প্রেক্ষিতে সমাজ ও রাষ্ট্রে তার অবস্থান হয় সবচেয়ে দুর্বল। এই দুর্বলতার দায়ভার আজন্ম শুধু তাকে নয়, বরং বয়ে বেড়াতে হয় তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও।
একজন প্রতিবন্ধী শিশুর ক্ষেত্রে শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগহীনতা একজন অপ্রতিবন্ধী স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে কতটুকু বৈবষম্য, পীড়ন আর দুর্বিষহ হতে পারে, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। এই দায়ভার থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হতে পারে তাকে শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা। এ প্রক্রিয়ার সফল বাস্তবায়নে কার্যকর মহৌষধ হতে পারে একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম, যা সরকারের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ও সংবিধানের আলোকে বিভিন্ন আইন দ্বারাও স্বীকৃত। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, আইনী বাধ্যবাধকতার পরেও কেন তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না? কেন আজও ৮৯% প্রতিবন্ধী শিশু থেকে যাবে শিক্ষার অন্তরালে? এর সবচেয়ে সহজ উত্তর আমাদের জ্ঞানীয় সীমাবদ্ধতা ও অবহেলা তথা প্রতিবন্ধীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তাহলে এবার দেখি একীভূত শিক্ষা আসলে কি?
আধুনিক শিক্ষা গবেষণায় সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষা চাহিদা পূরণে একীভূত শিক্ষা সবচেয়ে ফলপ্রসূ উপায় হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, একীভূত শিক্ষা ‘সবার জন্য বিদ্যালয়’ দর্শনে বিশ্বাসী। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিদ্যালয়গুলোতে যদি সকল শিশুর সাথে প্রতিবন্ধী এবং সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সমসুযোগ প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষাদান নিশ্চিত করা যায়, তবেই এ দর্শনের বাস্তবায়ন সম্ভব। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীসহ সমাজে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় একীভূত করার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একীভূত শিক্ষার বিকল্প নেই। একীভূত শিক্ষা হলো এমন একটি কৌশলগত প্রক্রিয়া যা ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সকল ধরণের শিক্ষার্থীর জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ শিখন চাহিদার স্বীকৃতি দেয়। শিক্ষার্থীদের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ চাহিদা পূরণ করার মাধ্যেমে মানসম্পন্ন শিক্ষার নিশ্চয়তা দেয় এবং শিক্ষার্থীর শিক্ষা অর্জনের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে সহায়তা করে। একীভূত শিক্ষার সর্বজন গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেয়া কঠিন হলেও একটি আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, Inclusive education means that: Schools should accommodate all children regardless of their physical, intellectual, social, emotional, linguistic or other conditions. এবার তাহলে বিদ্যমান সমস্যা ও বাস্তবতার দিকে আলোকপাত করি।
চ্যালেঞ্জ: নীতির ভাষা বনাম শ্রেণিকক্ষের বাস্তবতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান তার গবেষণায় “Critical Eye” নামক একটি সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ নীতিপত্রে ব্যবহৃত অলঙ্কারময় শব্দচয়ন ও বাস্তব শ্রেণিকক্ষের পরিস্থিতির মধ্যে ব্যবধান উদঘাটন করে। মাঠপর্যায়ের শিক্ষকদের অনেকেই অন্তর্ভুক্তিকে দায়িত্বের পরিবর্তে বোঝা হিসেবে দেখেন। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রায়ই “গড়ের নিচে” বা অপারগ বলে আখ্যায়িত করা হয়—যা আসলে বৈষম্যমূলক শ্রেণিকক্ষ পরিবেশ থেকে উদ্ভূত।
অধিকারভিত্তিক শিক্ষা: বৈষম্য নয়, অংশগ্রহণ চাই
শুধু ভর্তি করানোই একীভূত শিক্ষা নয়, বরং প্রতিটি শিশুকে অর্থবহ অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী শিক্ষা হলো একটি মৌলিক অধিকার, যা প্রদান করতে হবে বৈষম্যহীনভাবে। গবেষণায় দেখা যায়, অভিভাবকদের সীমিত সম্পৃক্ততা, অপর্যাপ্ত সহায়ক সেবা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের ঘাটতি প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাকে কার্যকর হতে দিচ্ছে না। ফলে, অংশগ্রহণের বদলে তারা প্রান্তিকতায় বন্দী থাকছে।
সমাধানের পথ: কাঠামোগত সংস্কার ও জবাবদিহিতা
সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, কেবল অবকাঠামো তৈরি করলেই হবে না; অন্তর্ভুক্তিমূলক এই একীভূত শিক্ষা সফল করতে হলে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, সহায়ক সেবা, এবং সমন্বিত নীতি বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এখানে সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজের সম্মিলিত ভূমিকা অপরিহার্য। প্রতিবন্ধী শিশুদের শুধু “সেবাপ্রার্থী” হিসেবে নয়, বরং অধিকারভিত্তিক নাগরিক হিসেবে দেখতে হবে, যাতে তারা নিজের শিক্ষাজীবনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, একীভূত শিক্ষা কেবল নীতির অলঙ্কার নয়—এটি একটি সামাজিক চুক্তি, যেখানে ন্যায়বিচার, সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে শিক্ষা সবার জন্য উন্মুক্ত হতে হবে। যতক্ষণ না কাঠামোগত সংস্কার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হচ্ছে, ততক্ষণ অন্তর্ভুক্তিমূলক একীভূত শিক্ষা দক্ষিণ এশিয়াসহ গ্লোবাল সাউথে কেবল প্রতিশ্রুতির গণ্ডিতেই আটকে থাকবে।
লেখক: অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে একীভূত শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা সংস্কার ও শিক্ষানীতি উন্নয়নে গবেষণা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করে আসছেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: