নিউজ ডেস্ক │অধিকারপত্র
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে হাইপারলুপ ওয়ান (Hyperloop One) এর কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে একটি প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দেয়! হাইপারলুপের স্বপ্ন কি তবে শেষ? বাতাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ করা টিউবের মধ্যে দিয়ে ৭০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা গতিতে ট্রেন ছোটার এই উচ্চাভিলাষী ধারণাটিকে অনেকেই তখন মৃত বলে ধরে নিয়েছিলেন। তবে প্রায় দুই বছর পর সেই ধারণা বদলে যাচ্ছে। ভার্জিন গ্রুপের বিনিয়োগ পেয়েও টিকে থাকতে না পারা হাইপারলুপ ওয়ান ব্যর্থ হলেও। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। চীন এবং ইউরোপের হাতেগোনা কয়েকটি সংস্থা এখনও হাইপারলুপ প্রকল্প নিয়ে কাজ করে চলেছে। বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) এই গবেষণায় আর্থিক সমর্থন দিচ্ছে এবং আগামী এক দশকের মধ্যে প্রথম বাণিজ্যিক লাইন চালু করার আশা রাখছে। হাইপারলুপ প্রযুক্তির উত্থান ঘটে ২০১৩ সালে যখন এলন মাস্ক এটি একটি উন্মুক্ত পরিবহন ধারণা হিসেবে প্রস্তাব করেন। এটি মূলত ম্যাগলেভ (Maglev) প্রযুক্তিকে নিম্ন-চাপের শূন্য টিউবের (vacuum tubes) সঙ্গে একত্রিত করে ঘর্ষণ ও বায়ু টেনে ধরার পরিমাণ (drag and turbulence) কমিয়ে ৭৬০ মাইল প্রতি ঘণ্টা গতি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। মাস্কের এই ধারণা বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে এবং ২০১৭ সালের মধ্যে ১৭টি দেশে ৩৫টি রুট প্রস্তাব করা হয়। হাইপারলুপ ওয়ান এই রেসের প্রধান খেলোয়াড় হলেও শেষ পর্যন্ত এটি ব্যবসায়িক মডেলকে লাভজনক করতে পারেনি। এমনকি রিচার্ড ব্র্যানসনের ভার্জিন গ্রুপ বিনিয়োগ করার পরও পাঁচ বছরের মধ্যে তারা সরে আসে।
রেল বিশেষজ্ঞ ও লেখক ক্রিশ্চিয়ান ওলমার মনে করেন, হাইপারলুপ অকার্যকর। তিনি এর উচ্চ নির্মাণ ব্যয়, বিদ্যমান পরিবহন ব্যবস্থার সাথে একীভূত হওয়ার সমস্যা, নগণ্য যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা (capacity) এবং উচ্চ গতিতে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যাত্রী নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলিতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তার মতে মাস্ক এবং ব্র্যানসন সরে এসেছেন কারণ এর অর্থনীতি কাজ করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগ্রহ কমলেও ইউরোপ হাইপারলুপের নতুন কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইউরোপে হার্ডট হাইপারলুপ (Hardt Hyperloop) সহ চারটি সংস্থা এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। নেদারল্যান্ডসের রটারডাম ভিত্তিক হার্ডট হাইপারলুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোল ভ্যান ডি পাস এই ধারণার ওপর দৃঢ় বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, এটি ৩০০ মাইলের বেশি দূরত্বের জন্য স্বল্প-দূরত্বের বিমান ভ্রমণ প্রতিস্থাপনের একমাত্র কার্যকর, টেকসই সমাধান। হাইপারলুপ প্রচলিত উচ্চ-গতির রেলকে প্রতিস্থাপন নয়, বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। হার্ডট হাইপারলুপ সম্প্রতি ট্র্যাক স্যুইচিং (যা পডকে বিভিন্ন টিউবের মধ্যে সহজে গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে) সফলভাবে পরীক্ষা করেছে। যা দীর্ঘদিন ধরে হাইপারলুপের জন্য একটি টেক কিলার বা প্রযুক্তিগত বাধা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। তারা আরও দাবি করেছে, তাদের পরীক্ষামূলক যান ০ থেকে ৫৩ মাইল প্রতি ঘণ্টা গতি অর্জন করতে পেরেছে মাত্র ৪৫০ ফুট দূরত্বে। ইইউ-সমর্থিত হাইপারলুপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (HDP) ২০৩৫-৪০ সালের মধ্যে প্রথম বাণিজ্যিক লাইন চালু করার এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১৫,০০০ মাইলের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। যার আনুমানিক খরচ ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার। এই নেটওয়ার্কটি শর্ট হল বিমান যাত্রীদের ৬৬% হাইপারলুপে স্থানান্তর করতে পারলে তা বিশাল পরিমাণ কার্বন নির্গমন কমাতে সাহায্য করবে। ইতালিও পিছিয়ে নেই হাইপারলুপ ইতালিয়া ভেনিস ও পাডুয়ার মধ্যে একটি ডেমোনস্ট্রেশন লাইন তৈরির জন্য কাজ করছে। যা ২০২৯ সালের মধ্যে প্রস্তুত হতে পারে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেয়েনও হাইপারলুপের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিকাশকে ইউরোপের কৌশলগত অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
হাইপারলুপের পাশাপাশি, ম্যাগনেটিক লেভিটেশন বা ম্যাগলেভ প্রযুক্তি এশিয়ায়, বিশেষ করে জাপান ও চীনে ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রযুক্তিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চুম্বক ব্যবহার করে যানকে ট্র্যাকের উপর থেকে শূন্যে তুলে দেওয়া হয়, যার ফলে ঘর্ষণ প্রায় শূন্য হয়ে যায়। জাপানের সেন্ট্রাল জাপান রেলওয়ে কোম্পানির পরীক্ষামূলক ট্রেন L0, যাত্রী পরিবহনকারী ট্রেনের ক্ষেত্রে ৩৭৫ মাইল প্রতি ঘণ্টা গতিতে বিশ্ব রেকর্ড ধারণ করে। চীনও তাদের উচ্চ-গতির রেল নেটওয়ার্কের পরিপূরক হিসেবে ম্যাগলেভকে দেখছে এবং ব্যস্ততম করিডোরগুলিতে এটি বিমান যাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করে। তবে ম্যাগলেভের উচ্চ নির্মাণ ও জ্বালানি খরচ, বিদ্যমান রেল নেটওয়ার্কের সাথে সংযোগের অভাব এবং ইন্ট্রুসিভ (intrusive) এলিভেটেড ট্র্যাকের বিরোধিতা এর বিশ্বব্যাপী প্রসারে বাধা দিচ্ছে। যদিও প্রথাগত রেলওয়ে তার খরচ, ক্ষমতা, এবং বিদ্যমান নেটওয়ার্কের সাথে সামঞ্জস্যের কারণে এখনও অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু হাইপারলুপ এবং ম্যাগলেভের মতো বিকল্প প্রযুক্তিগুলো গতিতে এগিয়ে আছে। ইউরোপ যদি হাইপারলুপ প্রযুক্তির সীমানা ঠেলে দিতে থাকে এবং জাপান ও চীন তাদের ম্যাগলেভ লাইনগুলি আগামী দুই দশকের মধ্যে সম্পন্ন করে। তবে ডানা ছাড়াই উড়ে যাওয়া লাখ লাখ ভ্রমণকারীর জন্য দৈনন্দিন বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে। হাইপারলুপ হয়তো তার প্রথম দৌড়ে হোঁচট খেয়েছে কিন্তু বিশ্বব্যাপী গবেষণা এবং বিপুল বিনিয়োগের উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে, এই প্রযুক্তি সহজে তার আশা ছাড়তে নারাজ। এই স্বপ্ন পুরোপুরি মৃত নয় বরং একটি নতুন দিগন্তে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
-মো: সাইদুর রহমান (বাবু), বিশেষ প্রতিনিধি. অধিকারপত্র

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: