odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Saturday, 6th December 2025, ৬th December ২০২৫
আজকের সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি যখন ভঙ্গুর, তখন লালনকে অপব্যবহার নয়—পুনরায় পাঠ দরকার। আর তাই ধর্মের নামে হানাহানি নয়, সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে বাউল সম্রাট লালন সাঁইয়ের মূল বার্তা কেন জরুরি? শুরু হচ্ছে ধারাবাহিক সিরিজ।

ভন্ডামী আর ব্যবসার বেড়াজালে লালন দর্শন: আসল সাঁইয়ের সন্ধানে ‘অধিকারপত্র’-এর নতুন দিগন্ত

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৬ December ২০২৫ ১৮:১৫

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৬ December ২০২৫ ১৮:১৫

 ফিচার আর্টিকেল সিরিজ: লালনকে জানুনবিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকুন

বাউলিয়ানা এখন ব্যবসার ফাঁদ, ধর্ম হচ্ছে ক্ষমতার হাতিয়ার। এই অস্থির সময়ে 'অধিকারপত্র' শুরু করেছে গবেষণাধর্মী ফিচার সিরিজ: “লালনকে জানুন: বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকুন লালন সাঁইয়ের মানবিক দর্শন সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে ভেদাভেদ ভুলে এক হওয়ার ডাক। পড়ুন, সচেতন হোন, আলোকিত সমাজ গড়ুন

বিভ্রান্তির ধোঁয়াশা কাটিয়ে: লালন দর্শনের ভেতরের মানুষটিকে খোঁজা

এক অদ্ভুত সময়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। চারপাশে এখন অনেক কোলাহল, অনেক চিৎকার—কিন্তু শান্তিনিকেতনের মতো নীরব হয়ে যাওয়া সত্যের খোঁজ আর মেলে না। বাউল গানের সুর এখন শহরের হাটে-বাজারে বিকোয়, কিন্তু সেই গানের ভেতরের কথাগুলো যেন কেবলই লোক দেখানো প্রথায় চাপা পড়ে গেছে। বাউল সেজে সোশাল মিডিয়ার এই যুগে লাইক-ফলো লাভের আশায় এখন অনেকে গণমানুষের মনোযোগ  আকর্ষণ করতে ব্যস্ত, আবার ধর্মের নামে হানাহানি আর অবিশ্বাস তৈরি করাও যেন একদল মানুষের নিত্যদিনের কাজ। আর এইরূপ দেখে লালন বলেন,

এসব দেখি কানার হাট বাজার
বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা
আর এক কানা মন আমার।।
পণ্ডিত কানা অহংকারে
মাতবর কানা চোগলখোরে।
সাধু কানা অন বিচারে
আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে,
চেনে না সীমানা কার।।

প্রিয় পাঠক, এই ঘোর লাগা পরিস্থিতিতে আপনার মনে কি কখনো প্রশ্ন জাগে—লালন সাঁইয়ের আসল বার্তাটি তবে কী ছিল? তাঁর দর্শন কি কেবলই কিছু গানে সীমাবদ্ধ?

আজকের দিনে যখন আবুল সরকারের মতো ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ভন্ডামীর ভয়াল রূপ, যখন ক্ষমতার খেলা মেতে ওঠে ধর্মের দোহাই দিয়ে—তখন 'অধিকারপত্র'-এর মনে হয়েছে, ঘরে ঘরে আলো জ্বালানো খুব জরুরি। আমরা কি কেবল বসে বসে দেখব, আর একদল ধর্মব্যবসায়ী লালনের সরল দর্শনকে বিকৃত করে নিজেদের পকেট ভরবে? এই অস্থিরতা, এই বিভ্রান্তি দূর করতেই আমাদের এই বিশেষ আয়োজন—এই গবেষণাধর্মী ফিচার সিরিজটির। লালন বলেন,

কি বৈদিকে ঘিরলো হৃদয়
হলো না সুরাগের উদয়।
নয়ন থাকিতে সদাই হলি কানা।।

আর এই হৃদয়কে গোড়ামির, ভন্ডামির অসুস্থতা থেকে আত্মার মুক্তির জন্য প্রকৃত তথ্য জানা জরুরি।একইসাথে বাউল ও সাধারণ মুসলিমদের ধর্মের শান্তির বাণী বুঝতে হবে। আর তাই লালন বিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন,

আসসালাতুল মেরাজুল মোমেনিনা
জানতে হয় নামাজের বেনা।
বিশ্বাসীদের দেখাশোনা
লালন কয় এই জীবনে।

আমরা বিশ্বাস করি, লালন কেবল একটি নাম নয়, লালন আমাদের বাঙালিত্বের, আমাদের মানবিকতার মহামূল্যবান শিকড় এই সিরিজের ফিচার নিবন্ধগুলো কেবল লালনকেই জানাবেন না, বরং লালন সাঁইয়ের মূল বার্তা দিয়ে এই সময়ের ভন্ডামী ও বিভ্রান্তির দেওয়াল ভেঙে ফেলার পথ দেখাবে। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় তাঁর দর্শন কীভাবে আজও প্রাসঙ্গিক, সেই আলো ফেলবে প্রতিটি পর্বে।

তাই, ভেদাভেদ ভুলে, সব সংশয় দূরে রেখে—আজ থেকেই শুরু হোক আপনার নতুন যাত্রা। এই ধারাবাহিক সিরিজের প্রথম পর্বের সাথে থাকুন। জানুন, বুঝুন, আর একটি সম্প্রীতির মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথে প্রথম পদক্ষেপ নিন অধিকারপত্রের সাথে থাকুন।

এখন আর শুধু গান নয়, লালনকে বোঝা বড় দায়!

চারিদিকে এখন যেন এক অস্থির সময়। গানের সুরে নয়, বরং ভিন্ন কোলাহলে অস্থির আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি। লোক দেখানো বাউল সেজে কেউ কেউ বিভ্রান্তির ফাদ পেতেছেন, আবার কেউবা অন্যের দাবার ঘুটি হিসেবে সমাজে অশান্তি সৃষ্টির পায়তারা করছে।  আবার অনেকে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে লালনের ভুল উপস্থাপন করে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করছে, লালনের সহজ সরল দর্শনকে বিকৃত করে রাতারাতি তৈরি করছে 'বাণিজ্যিক ফাঁদ'। আবার সেই "লালসালু" উপন্যাসের মজিদের মতোই একদল ধর্মব্যবসায়ী জন্ম নিয়েছে, যারা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করতে ওস্তাদ। আবুল সরকারের ঘটনার মতো বহু ঘটনা সেই সতর্ক ঘণ্টাই বাজিয়ে যাচ্ছে। লালন বলেন,

চক্ষু আঁধার দেলের ধোঁকায়
কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়।

কিন্তু এর চেয়েও ভয়ঙ্কর চিত্রটি হলো—যখন ক্ষমতার রাজনীতিতে ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ কেউ ‘গোলা পানিতে মৎস্য শিকারে’ ব্যস্ত হয়। ধর্মের নামে পারস্পরিক অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা আর হানাহানি সৃষ্টি করতে পারলেই যেন কারো কারো 'সিদ্ধি লাভ' হয়। কিন্তু এত কিছুর ভিড়ে আমরা কি ভুলে যাচ্ছি আমাদের বাঙলার সংস্কৃতির মহামূল্যবান উপাদানবাউলকে?

ভেতরের কথা: এক মহাকালের ডাক

বাউল শুধু একটি গানের ধারা নয়, বাউল একটি জীবনবোধ, একটি দর্শনের নাম। আর এই দর্শনের প্রাণপুরুষ হলেন ফকির লালন সাঁই। তিনি ছিলেন মানব-সম্প্রীতির এক জলজ্যান্ত প্রতীক। তাঁর গান আমাদের শেখায়, মানুষের চেয়ে বড় কিছু এই জগতে নেই। তিনি জাতিভেদ মানতেন না, হিন্দু-মুসলমানকে সমান চোখে দেখতেন। তাঁর কাছে সব ধর্মের লোকই ছিল 'আপন'। লালন তাই নবির তরিকতে দাখিল হতে বলেন, কেননা:

সকল জানা যায়।
কেনরে মন কলির ঘোরে
ঘুরছো ডানে বাঁয়।।
আউয়ালে বিসমিল্লাহ্‌ বর্ত
মূল জানো তার তিনটি অর্থ।
আগমে বলেছে সত্য
সে ভেধ ডুবে জানতে হয়।।

অথচ আজকের দিনে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল এই সত্যটিকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। নিজেদের ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য তারা সহজ সরল মানুষদের মনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বিদ্বেষের বিষ। যখনই দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়, তখনই বাউল দর্শনের উদার আকাশ ঢাকা পড়ে যায় মিথ্যার কালো মেঘে।

সাঁইজির মূল বার্তা: সম্প্রীতির বীজমন্ত্র

লালন সাঁইয়ের মূল বার্তা খুব সহজ— ধর্মের গোঁড়ামি ছেড়ে মানুষকে ভালোবাসো তাঁর গানে কোনো মন্দির-মসজিদের ভেদাভেদ নেই; আছে মানবাত্মার জয়গান। তাই কারো কথায় উত্তেজিত না হয়ে, কান না দিয়ে, আমাদের উচিত নিজেকে প্রশ্ন করা— আসলে ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় লালন সাঁইয়ের মূল বার্তা কী ছিল?

মানুষকে শুধু মানুষ বলেই গণ্য করা।সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব আশরাফুল মাখলুকাতের সম্মান। কারণ, তিনি মনে করতেন ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’ ধর্মের নামে মানুষে মানুষে যে ব্যবচ্ছেদের দেয়াল গড়ে উঠেছে, তা অনেক আগেই ভেঙে ফেলে মানুষের জন্য সুন্দর একটা পৃথিবী প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন লালন। লালন বলেন,

সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।।
ভজ মানুষের চরণ দু’টি
নিত্য বস্তু হবে খাঁটি।
মরিলে সব হবে মাটি
ত্বরায় এই ভেদ লও জেনে।।
শুনি ম’লে পাবো বেহেস্তখানা
তা শুনে তো মন মানে না।
বাকির লোভে নগদ পাওনা
কে ছাড়ে এই ভুবনে।।

লালন শুধু আমাদেরই নয়, বিশ্ব সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। লালনকে সঠিকভাবে বুঝতে জ্ঞানের অন্য স্তরে অবতরণ করা প্রয়োজন হয়। তাই না বুঝেই সাধারণ মানুষ প্রায়শই লালন সম্পর্কে ভ্রান্তিতে ভোগেন। লালন সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন:“লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন, আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

আর তাই লালনের মতবাদ, বাঙলার এই মহামূল্যবান সাংস্কৃতিক উপাদানকে রক্ষা করার সচেতনতা আজ আমাদের সবার দরকার। আর এই কঠিন কাজটিই হাতে নিয়েছে আপনাদের প্রিয় অধিকারপত্র

আহ্বান: অধিকারপত্রের নতুন উদ্যোগ

চারিদিকে যখন এত বিভ্রান্তি, এত বিকৃতি—তখন আলোর পথ দেখাতে 'অধিকারপত্র' শুরু করছে একটি গবেষণাধর্মী ফিচার সিরিজ। এই উদ্যোগের নাম: লালনকে জানুন: বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকুন। এই সিরিজের প্রতিটি নিবন্ধ হবে আপনার ভেতরের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য একটি আলোকবর্তিকা। এটি শুধু তথ্য নয়, এটি হবে সাহিত্যিক storytelling-এর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানো মানবিকতার আহ্বান। লালন তাইতো বলেন, "ফাঁক তালে দুনিয়াদারী হল দমের ঘরে বেদম ফাঁকি"। লালনের বার্তা হলো - পৃথিবীর এই জাগতিক ভোগ-বিলাস, ধন-সম্পদ, সম্পর্ক সবই ক্ষণস্থায়ী এবং মৃত্যুর পর (দম ফুরিয়ে গেলে) সবই বৃথা বা ফাঁকি হয়ে যায়; মানুষ কেবল বাড়ি-ঘর বানানোতেই ব্যস্ত, কিন্তু আসল সত্য (আত্মার মুক্তি বা আধ্যাত্মিক সাধন) ভুলে গেছে, তাই দিনের আলো থাকতে (জীবিত অবস্থায়) ভজন-সাধন করা উচিত, নতুবা সবকিছুই ফাঁকা।

প্রিয় পাঠক, এই অস্থির সময়ে সচেতনতাই আমাদের একমাত্র হাতিয়ার। পড়তে থাকুন এই ধারাবাহিক সিরিজের প্রতিটি ফিচার নিবন্ধ। অধিকারপত্রের সাথে থাকুন এবং একটি সম্প্রীতির মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা রাখুন।

মানুষ কেন বিভ্রান্ত হয়? লালন কি কেবলই গান, নাকি জীবনবোধ?

✍️ অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

বি.দ্র. এই গবেষণাধর্মী সিরিজের পরিকল্পনা ও রচনার দায়িত্ব নিয়েছেন অধিকারপত্র ডট কমের উপদেষ্টা সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক . মাহবুব লিটু। তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ এই সিরিজটিকে দেবে এক নতুন মাত্রা।

#লালন_দর্শন #অধিকারপত্র_সিরিজ #বাউল_সম্প্রীতি #ভন্ডামী_নয়_সচেতনতা #মানবিক_বাংলাদেশ #ড_মাহবুব_লিটু



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: