নিউজ ডেস্ক | অধিকারপত্র
ইউক্রেন রাশিয়ার জ্বালানি খাতে চাপ বাড়াতে তাদের দীর্ঘ-পাল্লার ড্রোন হামলা আরও বিস্তৃত করেছে। এবার কাস্পিয়ান সাগরের ফিলানোভস্কি অফশোর অয়েল প্ল্যাটফর্মে হামলার মাধ্যমে প্রথমবার ওই অঞ্চলের রুশ জ্বালানি স্থাপনায় আঘাত হানল কিয়েভ। নিরাপত্তা সূত্র CNN-কে জানিয়েছে রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রকে চালিত করা যেকোনো জ্বালানি স্থাপনাই এখন বৈধ লক্ষ্য।
লক্ষ্যবস্তুর প্রসার: রিফাইনারি থেকে পাইপলাইন, বন্দর থেকে ট্যাংকার
২০২৪ সালের শুরুতে শুরু হলেও আগস্ট থেকে ইউক্রেনের গভীর স্ট্রাইক অভিযান জ্বালানি অবকাঠামোর আরও বিস্তৃত অংশে আঘাত হানছে। রিফাইনারি, পাইপলাইন, সমুদ্রবন্দর, তেলবাহী ট্যাংকার এমনকি অফশোর ড্রিলিং রিগেও। ACLED তথ্য অনুযায়ী আগস্ট থেকে নভেম্বর মাত্র চার মাসেই রাশিয়ার অন্তত ৭৭টি জ্বালানি স্থাপনায় হামলা হয়। যা বছরের প্রথম সাত মাসের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। শুধু নভেম্বরেই ১৪টি রিফাইনারি ও ৪টি রপ্তানি টার্মিনাল লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। রাশিয়ার সারাতভ রিফাইনারির মতো স্থাপনাগুলো বারবার হামলার মুখে পড়ে মেরামত ব্যাহত হচ্ছে। জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড ধাতব কাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয় ডেকে আনছে যা ভবিষ্যতে রাশিয়ার রিফাইনিং সক্ষমতায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
কেবল ঘরোয়া বাজার নয়, রপ্তানি বাজারেও চাপ:
ইউক্রেন এখন রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন নয় রপ্তানিমুখী জ্বালানি শৃঙ্খলকেও টার্গেট করছে। কৃষ্ণসাগরের নোভোরোসিস্ক, তুয়াপসে এবং বাল্টিকের উস্ত-লুগা বন্দরে একের পর এক স্ট্রাইক হয়েছে। পাঁচবার হামলার শিকার হয়েছে দ্রুজবা পাইপলাইন। যা দিয়ে রাশিয়া এখনও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে তেল পাঠায়। হাঙ্গেরি ইতোমধ্যেই এ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কাস্পিয়ান পাইপলাইন কনসোর্টিয়ামের (CPC) টার্মিনালে হামলায় কয়েক দিনের জন্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়, যা কাজাখস্তানকেও অস্বস্তিতে ফেলেছে।
তেলবাহী ট্যাংকারেও ড্রোন হামলা:
কৃষ্ণসাগরে রুশ ট্যাংকার টার্গেটে নেওয়ার কৌশল বাড়িয়েছে ইউক্রেন। তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনবার এ ধরনের হামলা হয়েছে। প্রথম দুই হামলার পর বিরলভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন একে জলদস্যুতা বলেন আর তুরস্ক দুই দেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে।
পশ্চিমা সমর্থনের সর্বোচ্চ মাত্রা এস্কেলেশনের পেছনে দুটি বড় কারণ-
১. যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তন: আগস্টে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ্যে জানান, অভিযানকারী দেশের ভেতরে হামলা ছাড়া যুদ্ধ জেতা কঠিন। তারপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আঘাত হানার বিষয়ে ইউক্রেনকে অতিরিক্ত গোয়েন্দা সহায়তা দিচ্ছে।
২. ইউরোপীয় মনোভাবের পরিবর্তন: ইউরোপীয় দেশগুলো এখন মনে করছে—ইউক্রেনের পরাজয় হলে তাদের নিরাপত্তাই বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। ফলে লক্ষ্যবস্তু সীমাবদ্ধতার মতো আলোচনা ধীরে ধীরে উঠে গেছে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক তেলের বাড়তি সরবরাহের কারণে দাম কম থাকায় ইউক্রেনের এসব হামলায় বিশ্ববাজারে তেমন অস্থিরতা তৈরি হয়নি যা পশ্চিমা সমর্থন আরও দৃঢ় করেছে।
রাশিয়ার ভেতরে চাপ:
রাশিয়ার রিফাইনারিগুলো গত বছরের তুলনায় প্রায় ৬% কম তেল প্রক্রিয়া করছে যা তাদের তুলনামূলক কম গ্যাসোলিন মজুত ব্যবস্থাকে চাপের মুখে ফেলছে। আগস্ট-অক্টোবর জুড়ে কয়েক অঞ্চলে জ্বালানি সংকট দেখা দেয় এবং সরকার সাময়িকভাবে গ্যাসোলিন রপ্তানি বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার নতুন দফায় রোসনেফট ও লুকোইলে পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর উরালস ক্রুডের দাম নেমে গেছে, ফলে রাশিয়ার তেল-গ্যাস আয়ে নভেম্বর মাসে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩৪% কমেছে। তবে রুশ বিশেষজ্ঞরা মনে করে রাশিয়া প্রয়োজনে তার জ্বালানি রপ্তানির অর্ধেক নিয়ে করেও দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে সক্ষম।
কোথায় গিয়ে থামবে এ যুদ্ধ?
বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেনের এই জ্বালানি কেন্দ্রিক আক্রমণ কৌশল দ্রুত ফল দেবে না এটি দীর্ঘমেয়াদি চাপের খেলা। এর মাধ্যমে রাশিয়াকে আলোচনায় ফিরিয়ে আনার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো সময় নিচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একই সঙ্গে ইউক্রেনকে সমঝোতায় চাপ দিচ্ছে যা এই কৌশলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
---মো: সাইদুর রহমান (বাবু), বিশেষ প্রতিনিধি. অধিকারপত্র

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: