
বাংলাদেশে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কি না, তা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই ভারতের আরও একটি শিল্প সংস্থার বিরুদ্ধে বিশ্বের আরও একটি অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করার অভিযোগ উঠেছে।
আর এই নতুন বিতর্কের পটভূমি হল অস্ট্রেলিয়া উপকূলের 'গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ' - যা পৃথিবীর বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর বা কোরাল রিফ সিস্টেম হিসেবে পরিচিত।
অস্ট্রেলিয়ার সুপরিচিত কয়েকজন নাগরিক ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠীকে লেখা এক খোলা চিঠিতে অনুরোধ করেছেন তারা যেন সে দেশের কুইন্সল্যান্ড প্রদেশে তাদের শত শত কোটি ডলারের কয়লা খনি প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেন - কারণ তা গ্রেট ব্যারিয়ার রিফকে শেষ করে দেবে।
যারা এই চিঠি লিখেছেন তাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত দুই ক্রিকেটার ভাই, ইয়ান ও গ্রেগ চ্যাপেলও রয়েছেন। তারা পরিষ্কার বলেছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দুদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক - এমন কী ক্রীড়া-সম্পর্কেও বিরূপ প্রভাব পড়বে।
প্রায় ২২০০ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলার (সাড়ে পনেরোশো কোটি মার্কিন ডলার) খরচ করে আদানি গোষ্ঠী কুইন্সল্যান্ডে যে 'কারমাইকেল কোল মাইন প্রজেক্ট' হাতে নিয়েছে তা বিশ্বের সবচেয়ে বড় কয়লা খনি প্রকল্পগুলোর একটি।
এই প্রকল্পে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ মেরিন পার্কের কাছের সমুদ্রে প্রায় ১১ লক্ষ ঘনমিটার এলাকা ('স্পয়েল') ড্রেজিং করার পরিকল্পনা রয়েছে - যা পরে ডাঙাতে ফেলা হবে। এ বছরেই প্রকল্পটির কাজ শুরু হওয়ার কথা।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সুশীল সমাজের বহু সদস্যই মনে করছেন এই কয়লা খনি প্রকল্প পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করবে এবং গ্রেট ব্যারিয়ার রিফকে বাঁচাতে হলে এই প্রকল্প বাতিল করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
এই গোটা বিতর্কের সঙ্গে বাংলাদেশে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কের প্রচুর মিল রয়েছে।
দুটি ক্ষেত্রেই প্রকল্প রূপায়ন করছে ভারতীয় সংস্থা - রামপালে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনটিপিসি (ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন) এবং কুইন্সল্যান্ডে ভারতের বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আদানি।
উভয় ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য পরিবেশ দূষণের মূল উৎস হল কয়লা। রামপালে কাঁচামাল হিসেবে আনা কয়লা ও প্রকল্পের ছাই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে - অস্ট্রেলিয়াতেও কয়লা তুলতে গিয়ে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে বলা হচ্ছে।
সুন্দরবন ও গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ দুটোই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম - এবং ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় দুটোরই নাম রয়েছে।
রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্পকে যেমন বাংলাদেশ সরকার সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করছে, ঠিক একই ভাবে কারমাইকেল প্রোজেক্টকেও অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকার ও কুইন্সল্যান্ডের প্রাদেশিক সরকার সবুজ সংকেত দিয়ে দিয়েছে।
তবে রামপালকে ঘিরে যেমন বাংলাদেশে জনমত দ্বিধাবিভক্ত বলা যেতে পারে, তেমনি অস্ট্রেলিয়াতেও আদানিদের এই কয়লা খনির পক্ষে ও বিপক্ষে দুরকম মতই শোনা যাচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক যেমন এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আদানি গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান গৌতম আদানিকে খোলা চিঠি লিখেছেন, তেমনি সে দেশের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল কিন্তু এই প্রকল্পকে সমর্থনও করছেন।
অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির নেতা কার্টিস পিট যেমন বলেছেন, "চ্যাপেল ভাইদের এই প্রকল্প নিয়ে নিজস্ব মত থাকতেই পারে, কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন এতে কুইন্সল্যান্ড প্রদেশে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
এমন কী বিরোধী লিবারেল ন্যাশনাল পার্টির মুখপাত্র স্কট এমারসনও জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের পেছনে সরকার ও বিরোধীপক্ষ - উভয়েরই সমর্থন আছে।
রামপাল প্রকল্পের সঙ্গে কুইন্সল্যান্ডের কারমাইকেল প্রোজেক্টের বড় ফারাক অবশ্য এখানেই, কারণ বাংলাদেশে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও বামপন্থী দলগুলো সুন্দরবনের কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার তীব্র বিরোধিতা করেছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: