


৯ জিলহজ্জ আরাফাতের ময়দানে পৃথিবীর নানা দেশের নানা বর্ণের নানা ভাষার লক্ষ লক্ষ মুসলমান ইহরামের পোশাক পরিধান করে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একই উচ্চারণে একই অনুভবে নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়ে হজের বিধি-বিধান একাগ্রচিত্তে যেভাবে পালন করেন, তাতে তাদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব মহামিলনের চিত্র পরস্ফুিটিত হয়ে ওঠে। লাখো লাখো কণ্ঠে একই সুর, একই আওয়াজ অভিন্ন প্রতিধ্বনিতে সমবেতকণ্ঠে তালবিয়া উচ্চারিত হয়, ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ হাজিদের দেশের দূরত্ব, ভাষার বৈচিত্র্য, রঙ ও বর্ণের ভিন্নতা, বয়সের তফাত্, নারী-পুরুষের বিভাজন, অর্থ-সামর্থ্যের বৈষম্য কোনো কিছুই মহামিলনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। হজ কেবল স্রষ্টাপ্রেমকে জাগ্রত করে না; এতে রয়েছে দুনিয়াবী অনেক কল্যাণ, হজ অনুষ্ঠানে সব দেশের লোকদের সাথে মেলামেশার সুবর্ণ সুযোগ লাভ হয়। পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে একাত্ববোধ সুদৃঢ় হয় এবং অন্য দেশের লোককে ভাই বলে গ্রহণ করার অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে। সকলের এক ধর্ম, এক উদ্দেশ্য এবং একই কর্মসূচি। সকলের গায়ে সেলাই বিহীন একই ধরনের ইহরামের সাদা পোশাক, একইভাবে জড়ানো। ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও সম্প্রীতির এক অনুপম দৃষ্টান্তের অনুপম মহড়া পরিলক্ষিত হয়।
আল্লাহর ঘরে সমবেত হওয়ার মাধ্যমে হাজিরা সরেজমিনে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পৃথিবীর সব মুসলিম অভিন্ন যোগসূত্রে আবদ্ধ, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ওপরে ইহজগতে আর কিছুই নেই- এটাই আরাফাতের প্রতিচ্ছবি। আত্মশুদ্ধি লাভের সঙ্গে প্রতিপালকের অপার সন্তুষ্টি অর্জন করে হাজিরা একনিষ্ঠ ভক্তি-বিশ্বাসে আবেগাপ্লুত হয়ে পরম করুণাময়ের দরবারে যাবতীয় পাপমুক্তির জন্য প্রার্থনা করেন। নবী করিম (স) বলেছেন, ‘যখন আরাফার দিনে হাজীরা একত্রিত হয়ে দোআ ও কান্নাকাটি করতে থাকেন, তখন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে ফেরেশতারা! আমার বান্দাদের অবস্থা দেখ। তারা কত দূর-দূরান্ত থেকে এসে, এলোমেলো বেশে মলিন চেহারায় রোদে জ্বলেপুড়ে (আমার প্রেমে) রোদন করছে। আমি তোমাদের সাক্ষী রেখে বলছি, অবশ্যই তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম।’ (বুখারি)
প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মুসলমান ইসলামের প্রাণকেন্দ্র কাবাগৃহ ও আরাফাতের ময়দানে সম্মিলিত হয়ে মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ লাভ করেন; সৌহার্দ্যের এমন অনুপ্রেরণা নিয়ে তারা আবার দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। ইসলামের ঐক্যের শিক্ষা অটুট রাখতে হজযাত্রীদের হজে গমন ও প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মানুষের মনেপ্রাণে অভিনব জাগরণ ও আলোড়ন উত্থিত হয়। মানব প্রেমময় সমাজ গড়ার প্রণোদনা সৃষ্টিতে হজ উজ্জীবনের নিয়ামক শক্তি, ধর্মে ধর্মে সমপ্রীতি, মানুষে মানুষে বৈষম্য চিরতরে দূরীভূত করে অভিন্ন চেতনা ধারণ করে শান্তির পথে এগিয়ে চলাই হজের মূল দর্শন ও অতুলনীয় শিক্ষা।
lলেখক: অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইনস্টিটিউট অব ল্যাংগুয়েজ স্টাডিজ, বাংলাদেশ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
সংগৃহীত
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: