ঢাকা | শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২
টেক্সটাইল কালার শরীরে প্রবেশের পর আমাদের জরুরি অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর যেসব ক্ষতি করে, তার বিবরণ দীর্ঘ।

জীবনধারণের জন্য খাবার প্রয়োজন।

odhikar patra | প্রকাশিত: ২৫ মে ২০১৯ ২৩:৪২

odhikar patra
প্রকাশিত: ২৫ মে ২০১৯ ২৩:৪২

জীবনধারণের জন্য খাবার প্রয়োজন। এই খাবারকে উপাদেয় ও আকর্ষণীয় করার জন্য ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন রকমের অনুষঙ্গী উপাদান, যাদের আমরা বলি 'ফুড এডিটিভস্‌'। বিশেষ করে হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা কারখানায় তৈরি খাবারে হরেক রকমের এ ধরনের অনুষঙ্গী উপাদান মেশানো থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব উপাদান ব্যবহার করতে গিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যাপক হারে ভেজাল মেশানো শুরু করেছে। 

খাবারকে দেখতে আকর্ষণীয় করার জন্য বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করার প্রচলনও দীর্ঘদিনের। ভোক্তারাও রঙিন খাবারের প্রতি আকৃষ্ট বলে আমাদের দেশে অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রায় খাবারেই রঙ মিশিয়ে দিচ্ছে। খাবারে কোনো রঙ মেশাতে হলে তাকে হতে হবে ফুড কালার। কিন্তু এর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি বলে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা এতে ফুড কালারের বদলে মেশাচ্ছে টেক্সটাইল কালার, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। উন্নত বিশ্বে খাবারে টেক্সটাইল কালার ব্যবহারের কথা উৎপাদকরা চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে খাবারে টেক্সটাইল কালারের বদলে ফুড কালার ব্যবহারটিই এখন হয়ে গেছে অত্যন্ত বিরল একটি ঘটনা। খাবারে অন্যান্য ভেজালের সঙ্গে ভেজাল রঙ ব্যবহার তাই এখন আর উদ্বেগের পর্যায়ে নেই; বর্তমানে এটি হয়ে গেছে উৎকণ্ঠার কারণ।

টেক্সটাইল কালার শরীরে প্রবেশের পর আমাদের জরুরি অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর যেসব ক্ষতি করে, তার বিবরণ দীর্ঘ। আরও মুশকিল হলো, টেক্সটাইল কালার সহজে বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয় বলে শরীরের এই ক্ষতি হতে থাকে সুদীর্ঘ সময় ধরে। সুযোগ হলে লক্ষ্য করে দেখুন, কাপড়ের কারখানাগুলোর আশপাশে নদী-খাল বা অন্য জলাশয়গুলোর পানি রঙিন। এসব কারখানার নির্গত রঙিন বর্জ্যে আশপাশের জলাশয়গুলোর পানিও রঙিন হয়ে ওঠে এবং বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয় বলে এসব রঙ প্রকৃতিতে গিয়েও দীর্ঘদিন সহজে পরিবর্তিত হয় না। ফলে এসব জলাশয়ের মাছ ও অন্যান্য কীট-পতঙ্গ মরে যায়, মরে যায় শৈবালসহ সব ধরনের জলজ উদ্ভিদ। অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ক্ষতি হয় মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী। এই টেক্সটাইল কালারগুলো খাদ্য ও পানীয়ের সঙ্গে শরীরে প্রবেশের পর এমন কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই, যার ক্ষতি করে না। তবে সবচেয়ে বেশি ও দৃশ্যমান ক্ষতিগুলো হয় আমাদের লিভার, কিডনি, হূৎপিণ্ড ও অস্থিমজ্জার। এগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চা ও বৃদ্ধদের বেলায় নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি, তরুণ-তরুণীদের কিছুটা দেরিতে। আজকাল আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি ও বিভিন্ন ধরনের এলার্জি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। সব বয়সী লোকজনই এতে আক্রান্ত হচ্ছে; তবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বৃদ্ধ ও বাচ্চারা।

এভাবে চলতে পারে না। জনস্বাস্থ্য রক্ষার খাতিরেই এ নৈরাজ্য থামানো প্রয়োজন। আমাদের দেশে এ সমস্যা দীর্ঘকালের হলেও সম্প্রতি সরকার এর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। ফলে এখন খাবারের কারখানাগুলোতে বিপুল পরিমাণ ভেজালসামগ্রীর সঙ্গে ধরা পড়ছে বিপুল পরিমাণ টেক্সটাইল কালার।

তবে অসাধু ব্যবসায়ীদের সৃষ্ট এই সংকটের পেছনে ভোক্তাদের দায়ও কম নয়। ইফতারির বাজারে গিয়ে বেশি ভাজা হয়েছে মনে করে অধিকাংশ ভোক্তাই কেনে লাল পেঁয়াজু-বেগুনি-চপ। জিলাপি কেনার সময় কেনে লালচে মচমচে ও চকচকে জিলাপি। শরবত পছন্দ করে গাঢ় লাল বা হলুদ রঙের। কিন্তু তারা বুঝতে চায় না যে, বেশি করে ভাজা পেঁয়াজু-বেগুনি-চপে বাদামি রঙ আসতে পারে, কখনোই লাল নয়। ওগুলো লাল হয় লাল টেক্সটাইল কালার ব্যবহারের কারণে। শত ভাজলেও জিলাপি লাল হয় না। লাল হয় রঙ দেওয়ার ও চকচকে হয় গাড়ির ফেলে দেওয়া মবিল ফিল্টার করে ব্যবহার করার কারণে। সয়াবিন, পাম, সরিষা বা তিলের তেলে ভাজা জিলাপি এত চকচকে ও মচমচে হয় না। প্রায় সব শরবত কনসেনট্রেট ও শরবত পাউডারে ফুড কালারের বদলে থাকে এসব ক্ষতিকারক নিষিদ্ধ রঙ। আম ও কমলার ছবি লাগানো অধিকাংশ তথাকথিত ফ্রুট জুসের প্যাকেটে সত্যিকারের আম-কমলার বদলে থাকে কাপড়ের রঙ আর কৃত্রিম গন্ধ। ভোক্তা কেন চিন্তা করে না যে, এত কম দামে এক প্যাকেট সত্যিকারের আম-কমলার রস বিক্রি করা অসম্ভব।

ইফতারি বাজারের বাইরেও দেখবেন অসংখ্য খাদ্যে টেক্সটাইল কালারের উপস্থিতি। হরেক রকম মিষ্টি, দই, বিস্কুট, কেক, জ্যাম, জেলি, সস, কেচাপ, আচার, লজেন্স, টফি, চানাচুর, লাচ্ছা সেমাই, ড্রিংকস্‌, আইসক্রিম, গুঁড়া হলুদ, গুঁড়া মরিচ, হাওয়াই মিঠাই সর্বত্রই টেক্সটাইল কালার। যত ভালো ও ঘন দুধই হোক না কেন, দই গাঢ় হলুদ হবে না, বড়জোর হলদেটে লাল হতে পারে। যত যত্ন নিয়েই ঘরে কেক বানানো হোক, তা কখনও এত হলুদ হয় না। কিন্তু এগুলোর বিক্রি কি থেমে আছে? দোকান ছোট না বড়, ব্র্যান্ড স্বল্প পরিচিত না অতি বিখ্যাত, কিছুই যায়-আসে না। মুনাফালোভীরা খাবার রঙের বদলে কাপড়ের রঙ মিশিয়েই যাচ্ছে। কোনো কোনো বড় ব্র্যান্ড বড়াই করে যে, তারা ফুড কালার ব্যবহার করে। তাহলে মোবাইল কোর্ট তাদের কারখানায় গিয়ে টেক্সটাইল কালারের বাক্স-ডিব্বা উদ্ধার করে কীভাবে?

অনেকে ঘরে তৈরি খাবারেও জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে টেক্সটাইল কালার ব্যবহার করছেন। পোলাও, বরফি, ফালুদা, জর্দা ইত্যাদি এর উদাহরণ। জাফরান পৃথিবীতে অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য বলে এর সামান্য একটুখানি রঙও অত্যন্ত দামি। ফলে দোকান থেকে ২০, ৫০ বা ১০০ টাকার জাফরানের নামে আমরা যা কিনছি, তা আসলে জাফরান নয়, সম্ভবত কোনো খাবার রঙও নয়, তা হলো অত্যন্ত ক্ষতিকর টেক্সটাইল কালার। জনগণ সচেতন নয় বলেই তারা নিজেরা ঘরে খাবার তৈরি করার সময় যেমন রঙ ব্যবহার করা পছন্দ করে, তেমনি বাজার থেকে তৈরি খাবার কেনার সময়ও রঙিন খাবার কেনে। 

অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেবে দেখছে না যে, তারা অন্যায় ও বিবেকহীন মুনাফা অর্জনের জন্য টেক্সটাইল কালারের নামে মানুষের যে প্রাণঘাতী ক্ষতি করছে, তা থেকে তারাও ঝুঁকিমুক্ত নয়। এসব ক্ষতিকর রঙ ব্যবহারের ফলে ক্ষতি যা হচ্ছে তা শুধু অন্য ভোক্তারই তা নয়, অসৎ ব্যবসায়ীর পরিবারের লোকজনও অন্য কোনো খাবারে এগুলো খাচ্ছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমাদের উদ্বেগ তাই অসৎ ব্যবসায়ীর পরিবারের লোকজনসহ সব ভোক্তাকে নিয়েই। দল-মত নির্বিশেষে সবার পেটেই যাচ্ছে খাদ্যের অনুষঙ্গী উপাদানের নামে টেক্সটাইল কালারের এই বিষ। 

গত দুই দশক ধরে গবেষণার মাধ্যমে আমাদের দেশের খাদ্যে কী কী ভেজাল রঙ ব্যবহার করা হয়, তার একটি খসড়া তালিকা আমরা প্রস্তুত করেছি, যা উল্লেখ করা হলো। হৃদয়বান পাঠকদের কাছে অনুরোধ, এই তালিকার বাইরে আরও কোনো নাম জানা থাকলে অনুগ্রহ করে তা আমাদের জানান। দেশের জনস্বাস্থ্য রক্ষায় আপনার এ অবদানটুকু খুব কাজে লাগবে।

বাংলাদেশের খাদ্যে ভেজাল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত টেক্সটাইল কালারের নামগুলো হলো : ওরামিন, অরেঞ্জ টু, মেটানিল ইয়েলো, রোডামিন বি, ব্লু ভিআরএস, ব্ল্যাক এসবি, সান ইয়েলো আরসিএইচ, স্কাই ইয়েলো এফবি, ইয়েলো ৩জিএক্স, অরেঞ্জ এসই, অরেঞ্জ জিআর পিওপি, স্কারলেট ৪বিএস, গ্রিন পিএলএস, বরদু বিডব্লিউ, ফাস্ট রেড ৫বি, টুর্ক ব্লু জিএল, ব্রাউন সিএন ইত্যাদি। তবে এ দেশে লাল রঙ পাওয়ার জন্য রোডামিন বি এবং হলুদ রঙের জন্য মেটানিল ইয়েলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের এ ছাড়া মরিচের গুঁড়া মসলায় টকটকে লাল রঙ আনার জন্য সুদান রেড ব্যবহার করার উদাহরণ আছে। এই সুদান রেড ক্যান্সার সৃষ্টি করে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক গত প্রায় ৫০ বছর ধরে পৃথিবীতে নিষিদ্ধ। 

উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার খাতিরে অনুমোদিত খাবারের রঙগুলোও নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। এভাবে এফডিএন্ডসি রেড নং ২, এফডিএন্ডসি ইয়েলো নং ৫, এফডিএন্ডসি অরেঞ্জ নং ১, এফডিএন্ডসি রেড নং ৪, এফডিএন্ডসি রেড নং ৩২, এফডিএন্ডসি ইয়েলো নং ১, এফডিএন্ডসি ইয়েলো নং ২, এফডিএন্ডসি ইয়েলো নং ৩, এফডিএন্ডসি ইয়েলো নং ৪ এবং এফডিএন্ডসি ভায়োলেট নং ১ নামের ফুড কালারগুলোকেও মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএ কয়েক দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করেছে। নিজের নিরাপত্তার জন্যই কোনো রঙিন খাবার বা পানীয় কেনার আগে আপনি পণ্যের গায়ে লেখা বা দোকানির দেওয়া রঙের নামের সঙ্গে ওপরের দুটি তালিকা মিলিয়ে দেখতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ যে, নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত অঙ্গীকার অনুযায়ী তিনি খাদ্যের ভেজাল প্রতিরোধে নিরাপদ খাদ্য ও ফর্মালিন বিষয়ে কার্যকর আইন প্রণয়ন করেছেন। এই রমজানের প্রাক্কালে খাদ্যে ভেজালকারী অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি তিনি কঠোর বার্তা দিয়েছেন এবং আরও বেশি করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ব্যবস্থা করেছেন। এ বিষয়ে তার আন্তরিকতাটুকু প্রশংসনীয়। সেই সঙ্গে আইনগুলোকে কঠোর করে সংক্ষিপ্ত বিচার ও ভেজালকারীদের মৃত্যুদণ্ডের মতো দৃষ্টান্তমূলক কঠোর সাজা প্রদানের ব্যবস্থা করার জন্য আবেদন করছি। সরকারপ্রধানের সদিচ্ছা যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তার জন্য বাধাগুলোকেও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা জরুরি প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। 

সাবেক চেয়ারম্যান, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ সাবেক চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ; সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

abmfaroque@yahoo.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: