 
                                ১৪ বছরের কিশোর হারুন রশীদ।  খাবারে কোন রুচি নেই তার। ছোটবেলা থেকেই  সে দুধ-ডিম ও মাছ-মাংস খেতে পছন্দ করতনা। নানা ধরনের ফাস্টফুড, কোমল পানীয় তথা জাঙ্ক ফুডই  ছিল তার  পছন্দের খাবার। তার মা জানান, ‘বয়স অনুযায়ী তার উচ্চতা কম এবং সে পড়ালেখায় ভীষণ অমনোযোগী। চিকিৎসক বলেছেন,  ঠিকভাবে খাবার না খাওয়ার জন্য এ ধরনের সমস্যা হয়। তবে এখনো সময় আছে। তার অভ্যাস পাল্টাতে হবে।’   
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, শিশুদের কৈশরকালীন সময়ে শারিরীক ও মানসিক যত্ন প্রয়োজন। নইলে তারা ঠিকভাবে গড়ে উঠতে পারেনা। দেশের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশের বেশি অর্থাৎ ৩৪ মিলিয়ন কিশোর-কিশোরি। যাদের বয়স ১০-১৯। বাংলাদেশ জনতাত্ত্বিক ও স্বাস্থ্য জরিপ  অনুযায়ী, শহর ও গ্রামের ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরির পুষ্টি ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিশেষ করে কিশোরিদের খর্বাকৃতির হার শহর ও গ্রামাঞ্চলে যথাক্রমে ৩৯.৯ এবং ৩৪.৫% এবং রক্তস্বল্পতার হার ৪০% এবং ৩৬%।
এ বয়সে শিশুরা শারিরীক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠে। এ বিষয়ে বারডেমের প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান শামসুন্নাহার মহুয়া বলেন, ‘সাধারণত ১৬ বছর পর  মেয়েদের এবং ১৭ বছর বযসের পর ছেলেদের উচ্চতা আর বাড়েনা। সেজন্য কৈশরকালীন সময়ে তাদের বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত ক্যালরী সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। তাদের আইকিউ বা স্মৃতিশক্তির জন্য প্রোটিন, ভিটামিন বিশেষ করে ভিটামিন বি, ভিটামিন ১২, আয়রন ও মিনারেলস বেশি প্রয়োজন। তাদের শক্তির জন্য কার্বহাইট্রেড প্রয়োজন। অবশ্যই তাদের হাড়ের গঠন ও হাড় মজবুত করার জন্য ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার খেতে হবে।’   
এ সময় চারপাশের অনেক কিছুর সাথে তারা পরিচিত হয়। নানা বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ তাদেরকে খানিকটা বদলে দেয়। এই বদলে দেয়াকে বাবা-মার ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা উচিত এবং তাদেরকে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর বিষয়টিকে শেখানো প্রয়োজন। এজন্য তাদের মানসিক গঠনকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছেন মনোরোগবিদরা। এ বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলা,  তাদের সুবিধা অসুবিধা জানা প্রয়োজন। অনেক সময় এ বয়সে কোনো শিশু সহিংসতার শিকার হতে পারে। সেক্ষেত্রে তার সমস্যা থেকে তাকে বের করে আনতে হবে। প্রয়োজনে মনোরোগবিদের সাহায্য নিতে হবে বলে তারা বলছেন। সাবেক আর্মড ফোর্সড মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এ সময় তাদের স্বকীয়তা ও পরিচয় গড়ে ওঠে এবং তাদের নৈতিকতা ডেভলপ করে। এ সময় তারা সমবয়সীদের কথা বেশি শোনে। এজন্য বাবা-মাকে সতর্ক হতে হবে তারা যেনো কোনো ভুল না করে। এ সময় তাদেরকে শেখানো প্রয়োজন কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। যদি তাদের সাথে বন্ধন অটুট থাকে তাহলে তারা কথা শুনবে, নইলে শুনবেনা। এজন্য অবশ্যই তাদেরকে রাগ করে নয়, ভালোবাসা-আদর দিয়ে বোঝাতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, “এক্ষেত্রে স্কুলের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষকরাও তাদেরকে নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ সম্পর্কে শেখাবেন। এ সময় তাদেরকে গান-বাজনা, খেলাধূলা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত রাখলে তাদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটবে এবং তাদের গড়ে ওঠায় এসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে। এজন্য সাইবার জগতের অবাধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।’ 
শিশুর কৈশরকালীন যত্ন ও সুরক্ষার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে বলছেন ইউনিসেফ-এর পুষ্টি বিষয়ক কর্মকর্তা ডা. আইরিন আখতার চৌধুরি। তিনি বলেন, ‘এসময় অনেক শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। তারা ঠিকভাবে পুষ্টিকর খাবার না খেলে শারিরীক এবং মানসিকভাবে অনেক ঘাটতি থেকে যায়। এমনকি এজন্য তারা বিষন্নতায় ভুগতে পারে। এ সময় কিশোরিদের মাসিকচক্র শুরু হয় এবং এ বিষয়ে তাদেরকে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা এবং বিশেষ যত্ন নেয়া শেখানো প্রয়োজন। অনেক পরিবার এ সময় তাদেরকে প্রোটিন জাতীয় খাবার দিতে চায়না। অথচ মাসিকের জন্য তাদের শরীরে যে ঘাটতি হয় সেটা প্রোটিন জাতীয় খাবার দিয়ে পূরণ করতে হয়। এতে যে আয়রন, ভিটামিন ও মিনারেলস থাকে তা তার ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে। নইলে ধীরে ধীরে তার রক্তশূণ্যতা হতে পারে।’
 তিনি আরো বলেন, ‘মাসিকের সময় তারা কীভাবে নিজের যত্ন নেবে তা তাদেরকে জানানো ও শেখানো প্রয়োজন। স্কুলগুলোতে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট প্রয়োজন। এমনকি স্কুলে কোনোও কিশোরির হঠাৎ মাসিক হলে সে যেনো ঐ মুহুর্তে স্কুল থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন পায় তার ব্যবস্থাও করা প্রয়োজন। এসব বিষয় নিয়ে ইউনিসেফ সরকারের সাথে কাজ করছে।’
কৈশরকালীন যত্ন ও শিক্ষা এমন হওয়া প্রয়োজন যা তাদের সমগ্র জীবনকে সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং জীবনকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করতে পারে এমনই বলছেন অভিজ্ঞজনেরা।
এ বিষয়ে এমিরেটস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরি বলেন, ‘ ১০-১৪ বছরের এ সময়টিতে  শিশুদের পরিবর্তনটা বেশি হয়। এ সময় অনেকে বড়দের মতো আচরণ করে। ভালোমন্দ বুঝতে পারেনা। তারা ভুল পথে চলে যায়। সেজন্য তাদেরকে ভালো আচরণ শেখানো প্রয়োজন এবং গাইড ও মনিটর করা উচিত। তাদেরকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার নিয়ম-কানুনগুলো শেখাতে হবে। তাদের আনন্দ বিনোদনের বিষয়েও যতœবান হওয়া প্রয়োজন। তাদেরকে ভালো বই পড়তে দেয়া, ভালো সিনেমা দেখানো, আত্তীয়-বন্ধুদের সাথে মিশতে দেয়া, মাঝে মধ্যে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, নতুন কিছু করতে উৎসাহিত করাও প্রয়োজন।’

 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                             
                                             
                                             
                                            
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: