ঢাকা | শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অতীতের সব রেকর্ড টপকে পাঠান শাহরুখ খানকে নিয়ে গেল অন্য উচ্চতায়

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারী ২০২৩ ০৬:১১

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারী ২০২৩ ০৬:১১

পাঠান দেখতে কলকাতায় সিনেমা হলের সামনে দর্শকের ভিড় সমাজ হিরোগিরি আর দেখনদারির বেশরম রং শিশির রায় ৩ ঘণ্টা আগে ‘পাঠান' যা করল তাতে চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়৷ বুধবার ছবি মুক্তি, তা তো ঢের আগেই ঘোষিত, এবং দেখা গেল আগের সপ্তাহান্ত থেকেই আগাম টিকিট বুকিংয়ের বাঁধভাঙা স্রোত, কলকাতার সমস্ত হলে পাঠান, সমস্ত হলের সব টিকিটই বিক্রি সারা। নেহা ধুপিয়াকে কার মনে আছে? থাকার কথা নয়৷ বলিউডে খানকয় ছবি করেছেন, খুব মনে রাখার মতোও নয়৷ কিন্তু বছরকয়েক আগে এই একদা-নায়িকাই একটা মন্তব্য করেছিলেন, যা নিয়ে বেশ গুনগুন গুঞ্জন ছড়িয়েছিল ফিল্মি মহলে৷ নেহা বলেছিলেন, বলিউডে কেবল দুটো জিনিস ভালো বিকোয়— যৌনতা, আর শাহরুখ খান৷, বিশুদ্ধবাদীরা ছি-ছি করেছিলেন; ‘ফিল্ম' নয়, ‘সিনেমা'প্রেমী তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়ালরা মুখ বাঁকিয়ে হেসেছিলেন অবজ্ঞার হাসি; বাস্তববাদীরা, এবং অবশ্যই শাহরুখ খানের অনুরাগীকুল বুক বাজিয়ে বলেছিলেন— ঠিক কথা, প্রথমটার ক্ষেত্রে জানি না বাপু, তবে শাহরুখ খানের ব্যাপারটা সত্যি৷ আর তারও বড় কথা, শাহরুখ খান থাকলে ওতেই কাজ হয়ে যায়, যৌনতাও লাগে না৷ উনি ওরও উপরে! কিন্তু এ তো বেশ কিছু বছর আগের কথা৷ মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো, শাহরুখ খানও মধ্য-পঞ্চাশ পেরিয়েছেন, এবং কী আশ্চর্যের আর আতঙ্কের কথা, তার শেষ খানকয় ছবিই বলিউডে বিকোয়নি! ‘জিরো' না, ‘জব হ্যারি মেট সেজাল' না— দুটোই ট্রেড অ্যানালিস্টের ভাষায় ‘ফ্লপ', তার আগের ‘রইস' টেনেটুনে পাশ, ‘সেমি-হিট'৷ সবাই ভাবছিলেন, হিরোর দিন গিয়াছে৷ এখন ‘ক্যারেক্টার রোল'-এ মানে মানে ঢুকে পড়াই মঙ্গল, আলিয়া ভাটের সঙ্গে ‘ডিয়ার জিন্দেগি' ছবিতে যেমন অন্য রকম একটা চরিত্রে দেখা গিয়েছিল তাকে৷ ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস' বা ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার'-এর মতো ব্লকবাস্টার বা সুপারহিট আর এখন ওর কাছ থেকে আশা না করলেই মঙ্গল, তার বহু দিনের জুটি-সঙ্গী কাজলের সঙ্গে করা ‘দিলওয়ালে' ছবিটাও তো আসলে হিট হয়েছিল ওই ‘কামব্যাক কেমিস্ট্রি'র জোরেই! শাহরুখ-ভক্তরা সিঁদুরে মেঘ দেখছিলেন, নাকি অদৃশ্য অমোঘ দেওয়াল-লিখন পড়তে পারছিলেন? ওদিকে চলে এসেছে ওটিটি, বাজার কাঁপাচ্ছে নেটফ্লিক্স-অ্যামাজন প্রাইম ইত্যাদি আরো কত কী, সিঙ্গেল স্ক্রিন হলগুলো ভূতের বাড়ির মতো অন্ধকার, বেশির ভাগই বন্ধ, এমনকি মাল্টিপ্লেক্সগুলোতেও ছবি বুঝে গোনাগুনতি দর্শক... আর ক'টা দিন অপেক্ষা করলেই যা ওটিটি-তে পাবো, তা শুধুমুধু হলে গিয়ে কাঁড়ি পয়সা দিয়ে দেখবো কেন? নবযুগের নায়ক-নায়িকারাও যখন হল টানতে আর দর্শকের মন ভজাতে পারছেন না শাহরুখ-সালমান-আমির হেন সুপারস্টারদের মতো, ঠিক সেই সময় পৃথিবীতে ঝাঁপ নামিয়ে দিলো কোভিড৷ জীবনে, যাপনে, বিনোদনে৷ প্রাণরক্ষাই যেখানে ধর্ম, লাভের গুড় সেখানে অমানবিক বিলাসিতা৷ এক দিন গুটিগুটি সব খুললে দেখা গেল, অতিমারি-উত্তর এ যেন এক অন্য, অচেনা পৃথিবী৷ ছবি আসে, ছবি যায়, ছবি চলে না৷ কেমন যেন সব পাল্টে গেছে, মানুষের পছন্দ-অপছন্দও৷ কোথায় বলিউড, সিনেমার বাজার কাঁপাচ্ছে দক্ষিণ ভারত— এক অন্য ঘরানার, অন্য মেজাজ ও কিসিমের ছবিকুল, ‘কেজিএফ', ‘পুষ্পা'... যাদের নাম! খাঁড়ার ঘা হয়ে এল রাজনীতির মুষ্ট্যাঘাত, ‘বয়কট বলিউড' ট্রেন্ড! তিন খান বহু বছর বলিউড শাসন করেছেন, তামাম ভারত তাদের ছবি দেখেছে, পর্দায় তাদের সঙ্গে কেদেছে, হেসেছে এবং ভালোবেসেছে, কোনো দিন আলাদা করে কারো মনেও আসেনি এদের নামগুলো কী, পদবিই বা কী, অভিনেতার জাত-ধর্ম সে কোন বস্তু৷ এবার অভিনেতা-অভিনেত্রী ধরে ধরে, ছবি ধরে ধরে শুরু হলো পরিকল্পিত বিরুদ্ধপ্রচার৷ এক দিকে বাণিজ্যিক আকাল, তার উপরে ছবি বয়কটের জিগির তুলে অসুস্থ এক সেন্সরশিপ, ভারত যা আগে কখনো দেখেনি— অন্য দিকে দক্ষিণী ছবির বাড়বাড়ন্ত... এসবের মাঝে ছটফটানো বলিউড খুঁজছিল পরিত্রাণের পথ, যারপরনাই চাইছিল সেই হিরো আর হিরোগিরির আদিকল্প, তার পুনরাবির্ভাব এবং অধিষ্ঠান৷ ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে ধর্মা প্রোডাকশন্সের তৈরি রণবীর কাপুরের ছবি ‘ব্রহ্মাস্ত্র' মুখরক্ষা করল যত না নায়ক-নায়িকার কাঁধে ভর দিয়ে, তারও ঢের বেশি ফ্যান্টাসি-অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চারের ত্র্যহস্পর্শে, স্পেশাল এফেক্টের জাদুকরিতে৷ তত দিনে সেই বার্তা রটে গেছে ক্রমে, নতুন বছরে আসছেন তিনি, আসছেন শাহরুখ খান— ‘পাঠান' ছবি নিয়ে৷ আমির খানের ‘লাল সিং চড্ডা' যা পারেনি, ‘পাঠান' কি পারবে তা?  বুধবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩৷ ভারতে শুক্রবার করেই নতুন ছবি মুক্তি পাওয়াটা দস্তুর, তবে তার আগেই, বুধবারেও মুক্তির আলো দেখেছে এমন ছবিও আছে অনেক, সে তথ্য সন্ত গুগলই বলে দেবেন৷ অবশ্যই সে ছবি হতে হবে বড় প্রোডাকশন হাউসের এবং বড় নায়ক-নায়িকার, নইলে ওই কলার-তোলা কেরদানিটা দেখানো যায় না৷ কিন্তু ‘পাঠান' যা করল তাতে চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়৷ বুধবার ছবি মুক্তি, তা তো ঢের আগেই ঘোষিত, এবং দেখা গেল আগের সপ্তাহান্ত থেকেই আগাম টিকিট বুকিংয়ের বাঁধভাঙা স্রোত, কলকাতার সমস্ত হলে পাঠান, এবং সমস্ত হলের সব টিকিটই বিক্রি সারা৷ কলকাতা (ভারতও কি?) বোধহয় এ জিনিস এই প্রথম দেখল— মাল্টিপ্লেক্সে শো শুরু হচ্ছে ভোর সাড়ে ছ'টায়! মাল্টিপ্লেক্সে তো অনেকগুলো স্ক্রিন, অনলাইনে টিকিট কাটার অ্যাপে দেখা গেল তাজ্জব কাণ্ড, শো-টাইমগুলো এ রকম— ৭.৩০টা, ৮টা, ৮.১০, ৮.৪০, ৯.১৫, ৯.৩৫, ১০টা.... এমন করে দিনভর, দিন গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে ছাপিয়ে রাত৷ অফিসে এক সহকর্মী বললেন, শেষ শো নাকি রাত দেড়টায় এমনও আছে৷ নাগরিক মেট্রোপলিটান জীবনে বহু ব্যস্ত শহুরে মানুষ আজকাল মাল্টিপ্লেক্সে ছবি দেখেন রাত করে, তখন অফিসের পিছুটান থাকে না, বাইরেই ডিনার করে মুভিজীবনে ঢুকে পড়া, মধ্যরাতে গাড়ি চালিয়ে ঘরে ফেরা৷ কলকাতা বিরাট নিশাচর শহর নয় কোনো কালেই, এ শহর সাত তাড়াতাড়ি বরং ঘরে ফিরতে ভালোবাসে৷ কালের অমোঘ নিয়মে না হয় রাতে ছবি দেখাও মানা যায়, তা বলে মধ্যরাত্রেরও পরে শো শুরু হচ্ছে! মাল্টিপ্লেক্সের দর্শকচরিত্র আলাদা— সিঙ্গেল স্ক্রিন হলগুলোর থেকে৷ ‘পাঠান' দেখতে দেখতে মাল্টিপ্লেক্সেও হুল্লোড় হররা হিল্লোল উঠেছে, কিন্তু সিঙ্গেল স্ক্রিন হলগুলোয় যা হচ্ছে এবং হয়ে চলেছে, তা চোখে না দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হব৷ মনে হবে, এ-ও কি সম্ভব একটা ছবি ঘিরে! হলের সামনে বিরাট পোস্টার, ব্যানার, হোর্ডিং এসব তো হয়েই থাকে, ব্যানারে প্রাণপ্রিয় হিরোর ছবিতে বিশাল মালা পরানো, সে-ও ঠিক আছে৷ কিন্তু এ যে ‘আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান', ভক্তদের মধ্যে সেই নিয়ে হুড়োহুড়ি৷ ‘জয় শাহরুখ' ধ্বনিতে বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠছে৷ হোর্ডিংয়ে কারা এসে দুধের পাত্র থেকে দুধ ঢেলে দিলেন... হোর্ডিং থেকে দুধ গড়াচ্ছে৷ শিবের মাথায় দুধ ঢালার মতো ব্যাপার! হলের সামনে তাসা ও ব্যান্ড পার্টি এসে হাজির, প্যাঁ-পোঁ বাজছে সুরে-বেসুরে৷ হলের সামনে, রাস্তায় পটকা ফাটছে, একের পর এক তুবড়ির মুখে ছোঁয়ানো হচ্ছে আগুন, আতশবাজির ফুলকিতে যেন দিনের বেলাতেই দীপাবলি৷ হিরোদের ফ্যান ক্লাব কতই থাকে, শাহরুখের দুই ফ্যান ক্লাব— ‘কিং এসআরকে'জ আর্মি' আর ‘কিং খান লাভার্স'-এর শত শত ফ্যান হাজির৷ পাগলের মতো হাত-পা ছুড়ছে সবাই, গলার শির ফুলিয়ে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, কিংবা স্রেফ চেঁচাচ্ছে ‘শাহরুখ, শাহরুখ' বলে৷ ড্রাম, মালা, বেলুন, রঙিন কাগজে চারদিক পাগলপারা৷ বুধবার দিনের সকালে এক-একটা হলের সামনের রাস্তা জ্যাম, কলকাতার পুলিশ যানজট সরাবেন কী, তাঁরাও বিহ্বল, ভ্যাবাচ্যাকা৷ শেষ কবে একটা হিন্দি ছবির জন্য এমনটা হয়েছে, কেউ মনে করতে পারছেন না৷ বুধবার দিনের সকালে হলের সামনের রাস্তায় জ্যাম বেধে যায়বুধবার দিনের সকালে হলের সামনের রাস্তায় জ্যাম বেধে যায়।  তা হলে নিশ্চয়ই ছবিটাতেই এমন কিছু আছে, যার জন্য এত কিছু! নইলে তো শাহরুখের ছবি হলেই এ কাণ্ড ঘটতো সব সময়, তা তো হয়নি! মাঝে চার বছর ছবি বেরোয়নি কিং খানের, সেই অপেক্ষা জমতে জমতেই কি এমন আবেগের বিস্ফার? শুধুই ওই আবেগ, হিরোর জন্যই— ছবিটার জন্য নয়? মাত্র দু'দিন গিয়েছে ছবি মুক্তির পর, সচরাচর যে কোনো ছবির প্লটের ভালো-মন্দ, অভিনয়ের দোষ-গুণ, নাচ-গানের ঠিক-বেঠিক, কারিগরি বাহাদুরির কম-বেশি, এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার বান ডাকে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ার চণ্ডীমণ্ডপেও৷ ‘পাঠান'-এর ক্ষেত্রে তো মন্তব্য-তরজা ইত্যাদির সুনামি বয়ে যাওয়ার কথা৷ তাজ্জব ব্যাপার, এসব কিছুই হচ্ছে না, যত কথাবার্তা আবেগ-উচ্ছ্বাস সবই শুরু ও শেষ হচ্ছে ‘অহো কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিবো না' মর্মে, এবং এক্ষেত্রে ‘কী দেখিলাম'টা ছবি নয়, ছবি ঘিরে এই হুলস্থুলটা৷ মিডিয়াতে পোশাকি রিভিউ আসার পর এবার জানা ও বোঝা যাচ্ছে ও আচ্ছা, এ হলো ‘পাঠান'-এর প্রযোজনা সংস্থা ‘ওয়াইআরএফ' তথা ‘যশরাজ ফিল্মস'-এর নব-দেখনদারি ‘ওয়াইআরএফ ইউনিভার্স'-এর ছবি, যে ইউনিভার্সে ‘পাঠান'-এর দোসরদের দেখা গিয়েছে আগেই: ‘এক থা টাইগার' বা ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়'-এ টাইগাররূপী সালমান খান, কিংবা ‘ওয়ার' ছবিতে কবীর— হৃতিক রোশন! অর্থাৎ ‘অ্যাভে়ঞ্জার্স' সিরিজের ভারতীয় অবতার এরা— টাইগার-কবীর-পাঠান! মেজাজে, চরিত্রে বা নির্মাণসাদৃশ্যেও এই ‘ওয়াইআরএফ'বিশ্ব অ্যাভেঞ্জার্স-দুনিয়ার মতো, সেখানে একা হিরোয় আর কাজ হচ্ছে না তাই সময়ে সময়ে অন্য হিরো এসে পড়ে ছবিতে, সে এসে এই হিরোকে বাঁচায় বা সাহায্য করে, আবার ওই হিরোর ছবিতে হাত বাড়িয়ে দেয় এই হিরো৷ এ একটা নেটওয়ার্ক, চরিত্রের, প্লটের, ছবির, একটা ছবি আসলে একক ছবি নয়, একটা ছবি-সিরিজের অচ্ছেদ্য অংশ৷ এখন জানা যাচ্ছে এ ছবিতে তাই ওরকম অ্যাভেঞ্জার্স-প্রতিম ধুমধাড়াক্কা অ্যাকশন৷ হলিউডের স্পেশাল এফেক্ট ও সিজি-র জাতে উঠতে একুশ শতকের বলিউডেরও ঢের সময় লাগবে এখনও, সেই অর্থ ও পরিকাঠামোর কমতি মিটিয়ে দেবেন... হিরো ছাড়া আবার কে! সেই হিরো শাহরুখ খান ছাড়াই বা আর কে, এই আকালে! ‘পাঠান'রূপী শাহরুখ খান, লম্বা ঢেউ-খেলানো চুলের, এইট-প্যাকের হিরো— এই ছবির প্রাণ, আর তাঁকে প্লটে অভিনয়ে সঙ্গত করছেন দীপিকা পাডুকোন-জন আব্রাহাম-ডিম্পল কাপাডিয়া-আশুতোষ রানা-দেশপ্রেম-ষড়যন্ত্র-শত্রু দেশ-স্পেশাল এজেন্ট-আফ্রিকা-দুবাই-স্পেন-প্যারিস-আফগানিস্তান-বরফ-জীবাণুঅস্ত্র-মিসাইল-ট্রেন-প্লেন-রকেট লঞ্চার... কী নয়! দীপিকা এ ছবির নায়িকা, খোদ পাঠানের ‘লাভ ইন্টারেস্ট', আবার প্লটের মোচড়ে আর অ্যাকশনের ভাগজোখেও যথেষ্ট গুরুত্বের, জন আব্রাহাম তো ভিলেনের ভূমিকায় পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন এবং বলতে নেই যথেষ্ট সফলও— তবু, এ ছবি শুরু থেকে শেষ ফ্রেম অব্দি অবিসংবাদিত ভাবে ‘পাঠান'-এর৷ শাহরুখের৷ ক্যামেরা যখনই তাকে ক্লোজ শটে ধরে, বয়সের বাস্তবটা ধরা পড়ে তাতে৷ কিন্তু তিনি তো শাহরুখ খান— পোড়খাওয়া স্পেশাল এজেন্টের মুখ আর শরীরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন এই সাতান্ন বছর বয়সেই, এবং ছবির অন্তিমে ওই বয়স নিয়েই ইয়ার্কি করেন বয়স্য এং বয়স্ক ‘টাইগার'-এর সঙ্গে: এই বয়সেও তারা ছাড়া কে আর বাঁচাতে পারেন দুনিয়াকে, ফিল্মি দুনিয়াকে— মানে বলিউডকেও! ভবিষ্যৎ কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের কথা বাদই দিলাম৷ বিদেশেরও মোট ২৫০০ হলে নাকি মুক্তি পেয়েছে ‘পাঠান'৷ প্রথম দিন, মুক্তির দিন ভারতীয় মুদ্রায় ৩৫ কোটির ব্যবসা, পরের দিন তার দ্বিগুণ— দিনটা জাতীয় ছুটির দিন ছিল, সাধারণতন্ত্র দিবস ও সরস্বতীপুজো একসঙ্গে, সকলে পাগলের মতো হলে ভিড় করেছিলেন ছবি দেখতে৷ সামনেই আসছে সপ্তাহান্ত, প্রথম দু'দিনে যে ছবি প্রায় ১১০ কোটি টাকা তুলে নেয়, শনি-রবির অবকাশে তার ব্যবসা কোথায় পৌঁছবে তা সহজেই অনুমেয়৷ ট্রেড অ্যানালিস্টরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এ ছবির ব্যবসার একটা সুপারসাইক্লোনের গতি নেওয়া সময়ের অপেক্ষা, ছাড়াতে পারে যাবতীয় রেকর্ড৷ পশ্চিমবঙ্গে একটা বিরূপতার ঝড়ও উঠেছে৷ ‘পাঠান' এসে সব হল থেকে আর সব ছবিকেই স্রেফ উঠিয়ে দিয়েছে, বাংলা ছবিও তার ‘শিকার'৷ কলকাতার পরিচালকেরা— বিশেষত যাঁদের নতুন ছবি মুক্তি পেয়েছে ‘পাঠান'-এর সঙ্গে বা গায়ে গায়েই— প্রমাদ গনেছেন৷ আপত্তিটা সঙ্গত, বাংলায় বাংলা ছবি চলবে না, একটা হিন্দি ছবি এসে দাদাগিরি ফলিয়ে যাবে, সমস্ত হল নিয়ে— এ তো মানা যায় না কিছুতেই৷ টলিউড ছোট্ট একখান আঞ্চলিক ইন্ডাস্ট্রি, তার ছবিগুলোই দেখানো না গেলে তো রুটিরুজিতে টান পড়ার আশঙ্কা! হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্য বাড়ছে বাংলা তথা কলকাতার রোজকার জীবনে, ‘পাঠান'-ঝড় এসে সেই আধিপত্যকে আরও একটু গেড়ে বসিয়ে দিয়ে গেল কি না, প্রশ্ন উঠছে৷ উল্টো দিকে বহুলাংশের যুক্তি, খোলাবাজারে প্রতিযোগিতা হবেই, এবার কে বেশি ক্রেতা টানবে সেটা তার নিজস্ব কৃতিত্ব৷ তোমার সাধ্য থাকলে তুমিও করে দেখাও! অনেকে বলছেন, ‘পাঠান' এসে যে ধুঁকতে-থাকা সিঙ্গল স্ক্রিন হলগুলোকে নবজীবন দিল, কই সে কথা তো বলছো না! সিনেমাটা কেবল হলের মধ্যে ঘটে না, তার বাইরেও ঘটে— পান সিগারেট লজেন্স বাদামভাজা চিপস পপকর্নের বিক্রিবাটাটাও সিনেমারই ব্যবসা৷ ‘পাঠান' এসে মাল্টিপ্লেক্সের হল-কর্মীদের রাতের ঘুম ছুটেছে, তাঁদের নাকি আগামী অমুক দিন পর্যন্ত ছুটি ক্যানসেল, ভোরবেলা থেকে ডিউটি শুরু হচ্ছে৷ এ দৃশ্য যেমন নাড়িয়ে-দেওয়া, তেমনই ধুলো-ঝুলে ভরা, শতচ্ছিন্ন রেক্সিন-ফোমের আসনের হলগুলো যে আলোয়-মায়ায় হেসে উঠেছে, সে ছবিটাও কাঁপিয়ে দেওয়া৷ এই লেখা যখন লিখছি তখন একটি ভারতীয় রাত সপ্তাহান্তের নতুন দিনের অপেক্ষায়, ‘পাঠান'ময় দিন— বললে অত্যুক্তি হবে না৷ আর এই সবই সম্ভব করেছেন তিনি— শাহরুখ খান৷ এই একটু আগেই দেখছিলাম টুইটারে জ্বলজ্বল করছে কিং খানের একটা টুইট, ২৭ জানুয়ারি ভারতীয় সময় দুপুর ৩.০৭-এ করা: ফিরে-আসাটা অমন প্ল্যান-ট্যান করে হয় না৷ আসল কথা এগিয়ে যাওয়া, সামনের দিকে৷ পিছনে ফিরো না, তুমি যা শুরু করেছ, সেইটে শেষ করো আগে— এই হল সাতান্ন বছরের এক ‘বুড়ো'র পরামর্শ'৷ বুড়ো? বটেই তো৷ সাধারণ মানুষ অবশ্য তা দেখে না৷ তার ‘হিরো' চাই৷ ‘পাঠান' ছবির গান ‘বেশরম রঙ' আলাদা করে সুপারহিট হয়েছে ছবি মুক্তির বিস্তর আগেই, যে গানে দীপিকার লাস্যের পাশে ‘ফিমেল গেজ'-এ আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন শাহরুখ নিজেও৷ বেশরম হিরোগিরি আর দেখনদারি এ ছবিতে তাঁর আসল দুই হাতিয়ার৷ বের্টোল্ট ব্রেশট তার নাটকে যতই লিখুন ‘দুর্ভাগা সে দেশ, যে নায়কের জন্য হেদিয়ে মরে'... ‘পাঠান' জানে, তার মতো হিরো-ই বাঁচাতে পারে দেশকে ৷ দশকে। 

ডয়চে ভেলের



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: