
সম্পাদকীয়
মানুষকে মানুষ পণ্য বানায়—এই দুঃসহ সত্য আজ কোনো কল্পকথা নহে, বরং সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে অঙ্কিত এক কালো অধ্যায়। প্রাচীন দাসবাজারের বাঁশি বাজিতেছিল একদিন, যেখানে মানুষ ছিল ক্রয়বিক্রয়ের দ্রব্য, মুদ্রার দাসত্বে বন্দী ছিল মানব আত্মা। সময় গড়াইল, শতাব্দী পেরাইলো, কিন্তু দৃশ্যপট কতটুকুই বা বদলাইল? নাম পাল্টাইল, পদ্ধতি পাল্টাইল, অথচ শোষণের মর্মকথা একই রহিয়া গেল।
আজকের পৃথিবীতে মানূষই মানুষকে পণ্য বানাইতেছে। আর এই বানানো প্রক্রিয়া বহুমুখি, যা করা হয় নানা উপায়ে। কারখানার ধোঁয়াশায় ঘামে ভেজা শ্রমিক, যাহার পরিশ্রম বহুজাতিক কোম্পানির অট্টালিকা নির্মাণ করে, সেই মানুষই পরিণত হয় সস্তা কাঁচামালে, তাদের শ্রম নিম্নদরে বিক্রয় হয় বাজারে। দারিদ্র্যের অন্ধকারে পতিত নারী কিংবা যুবক কখনো দেহের ব্যবসায় পণ্য, কখনো পাচারের মাল। আবার প্রযুক্তির চকচকে প্রলোভনে ব্যক্তির ছবি, কণ্ঠ, অভ্যাস, এমনকি চিন্তারও হাট দেখা যায় ডিজিটাল অঙ্গনে।ক্লাউডে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য, যোগাযোগ, স্ট্রাটাস ইত্যাদি নিয়ে চণছে ব্যবসা। অদৃশ্য অ্যালগরিদমের খপ্পরে মানুষ নিজের অজ্ঞাতসারে রূপান্তরিত হইতেছে “ডাটা প্রোডাক্টে”—এক নতুন কায়দার দাসত্ব।
মানুষ কেন মানুষকে পণ্য করে? এই প্রশ্ন সেই দাস প্রথার সময় থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু উত্তর জানসা থাকলেও প্রতিষেধক অজানা। মানুষ মানুষকে পণ্য করার পিছনে মুনাফার অন্ধ লোভই প্রথম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। অর্থের খাতায় মানুষকে হিসেব করা হয় যন্ত্রের ন্যায়, আর আত্মা হারায় মূল্যহীন গণনায়। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার মোহ—শক্তিশালী গোষ্ঠী দুর্বলকে বন্দী করে, নিজেদের লাভে বিশেষ পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করে, যেন এই মানুষ কেবল হুকুম তামিলের যন্ত্র, এক রোবট। তৃতীয়ত, বৈষম্যের গভীর ক্ষত—জাতি, লিঙ্গ, শ্রেণি, অভিবাসন পরিচয়ের আড়ালে নির্ধারিত হয় মানুষের বাজারমূল্য।
কিন্তু মানুষ যখন মানুষকে পণ্য করে, তখন সমাজের হৃদয় শূন্য হয়, শান্তির বাণী ব্যর্থ হয়, মানুষের অদিকার হয় পদদলিত। মানবতার এই আলোহীনতায় মানবজাতিই যেন লজ্জিত হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে ঘোষিত “মানব মর্যাদা” কেবল পুস্তকের অক্ষরেই তখন সীমাবদ্ধ থাকে; বাস্তবে মানুষ মানুষকেই বিক্রি করে, শোষণ করে, কিংবা বাজারে নামিয়ে দেয় তথ্যের পণ্য বানাইয়া।
অতএব, প্রশ্ন কেবল নৈতিকতার নহে, অস্তিত্বেরও। যদি সমাজে মানুষ মানুষকেই আর কেবল লেনদেনের দ্রব্য ভাবিয়া চলে, তবে একদিন মানবসভ্যতা হইবে শুধু বাজারের যান্ত্রিক কাঠামো, যাহাতে দমবন্ধ হইবে আত্মার স্বাধীনতা। সেই অমানবিক ভবিষ্যৎ প্রতিহত করিতে হইবে আজই—সচেতনতার জাগরণে, ন্যায়ের আন্দোলনে, আইনের সঠিক প্রয়োগে। নতুবা, মানুষের বাজারে মানুষই হারাইবে মানুষকে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: