odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৭ আশ্বিন ১৪৩২
পদ্মা নদীর জেলে (অধিকারপত্র ডকুমেন্টারি) পর্ব ০৩ – জানুন আজ তারা কেমন আছে।

জীবিকা অনিশ্চিত, অধিকার বিলুপ্ত: পদ্মা নদীর জেলেদের জীবন সংগ্রাম ও সত্যের গল্প

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৩ অক্টোবর ২০২৫ ০৪:১৮

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৩ অক্টোবর ২০২৫ ০৪:১৮

- বিশেষ প্রতিবেদন: পদ্মা নদীর জেলে (অধিকারপত্র ডকুমেন্টারি)– পর্ব ০৩

জীবিকা অনিশ্চিত, অধিকার বিলুপ্ত: পদ্মাপাড়ের জেলেরা আজও বাঁচে সংগ্রামে

পদ্মা নদীর জেলেদের বাস্তব জীবন, দারিদ্র্য, লড়াই ও অধিকারহীনতার গল্প উঠে এসেছে সাহিত্যমূলক বর্ণনায়। জানুন আজ তারা কেমন আছে।

নদী যেমন ভাত দেয়, তেমনি কেড়ে নেয় অধিকার

পদ্মা নদীর জেলেদের জীবন যেন এক স্থায়ী দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। এ পর্বে উঠে এসেছে তাদের যন্ত্রণার বাস্তব চিত্র—জীবনের অনিশ্চয়তা, পেশা পরিবর্তনের বাধ্যবাধকতা এবং নিঃসঙ্গ সংগ্রাম।

পদ্মার পাড়ে বসে শ্রী কৃষ্ণ আজও তাকিয়ে থাকেন নদীর বুকের দিকে।
৩৪ বছর আগে তিনি জাল ছুঁড়ে ফেলেছিলেন নদীতে শেষবারের মতো। তখন থেকেই তাঁর জীবন বদলে যায়। কিন্তু বদলায়নি চারপাশ। মাছ ধরা ছেড়েছেন, তবু মাছের ব্যবসা ছাড়তে পারেননি। নদীকে তিনি ত্যাগ করেননি, নদীও তাঁকে ছাড়েনি। 

“জীবনটা ঠিক নদীর মতো,” বলেন তিনি, “একদিকে দেয়, আরেকদিকে সবটুকু কেড়ে নেয়।”

পদ্মার পাড়ে তাঁর ছোট্ট ঘর। আশেপাশে জেলে পল্লী। শিশুদের কান্না, বউদের অশ্রু, বৃদ্ধদের দীর্ঘশ্বাস আর খালি পাতিলের শব্দ—এই হল সেই পাড়ার চেনা সুর। শ্রী কৃষ্ণ জানেন, তাঁর দেখা জেলেদের যন্ত্রণা কেবল তাঁর একার নয়।

যে কথাগুলো তিনি বলেন, সেগুলো যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি-র পৃষ্ঠা ছিঁড়ে উঠে আসে। নব্বই বছর আগেও এই পাড়ায় ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর অবহেলাই ছিল জীবন। নব্বই বছর পরেও একই ছবির পুনরাবৃত্তি।

ঋতুচক্রে সময় পাক খায়... চর জাগে আবার বিলীন হয়... জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে শিশুর কান্না থামে না,”—যেন এই কথাগুলো আজও নদীর হাওয়ায় ভেসে আসে।

শুধু নদীর বদল নয়, বদলেছে আবহাওয়ার ধরনও। জলবায়ু পরিবর্তন, পানি প্রবাহের কমে যাওয়া, অকাল নদীভাঙন—সব মিলিয়ে মাছ এখন আর আগের মতো ধরা পড়ে না। আর যখন প্রজননের মৌসুম আসে, তখন সরকার মাছ রক্ষায় জেলেদের হাতে জাল তোলার অনুমতি দেয় না।

ঠিকই করেছে সরকার, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—জীবনের দায় কে নেবে?
জেলেরা বলেন, “মাছ ধরা বন্ধ, কিন্তু ক্ষতিপূরণ কোথায়? সংসার কি শব্দ দিয়ে চলে?”

এ পাড়ার জীবন মানেই যুদ্ধ।
ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ।
দাদনের সঙ্গে যুদ্ধ।
প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ।
আর যুদ্ধ নিজেরই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।

অগ্রিম ঋণের ফাঁদে পড়ে অনেক সময় জেলেরা কমদামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হন। মদ্যসত্ত্বভোগীদের আধিপত্য আর দাদনদারদের শোষণে একরকম বন্ধক রাখা জীবন তারা বয়ে বেড়ান।

“শ্রমিক তো আমরাও,” বলেন এক জেলে, “কিন্তু আমাদের শ্রমের কোনো স্বীকৃতি নেই। নেই কোনো নিরাপত্তা। আমাদের অসুখ হলে আমরা নিঃশব্দে মরি।”

শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই, বই নেই, আশার আলোও নেই।
বাড়ি বলতে কাঁচা মাটির ঘর, মাথার উপর টিন, আর দেয়ালে ধরা স্যাঁতসেঁতে।
স্বাস্থ্যসেবা? সেটা যেন গল্পের কোনো চরিত্র। তারা শুধু শুনে, ছুঁতে পারে না।

শুধু শ্রী কৃষ্ণ নন, এমন গল্প পদ্মাপাড়ের প্রায় প্রতিটি জেলে পরিবারেই আছে। একেকটা পরিবার মানে একেকটা নদী-ছেঁড়া যন্ত্রণার গল্প।

আজকের বাস্তবতা আরও কঠিন। জলবায়ু পরিবর্তন, পানি প্রবাহ হ্রাস ও নদীভাঙনের কারণে মাছের উৎপাদন কমেছে। তার ওপর মৌসুমভিত্তিক প্রজননকালীন নিষেধাজ্ঞা জেলেদের জীবিকায় এনেছে অনিশ্চয়তা। সরকার মাছ রক্ষায় পদক্ষেপ নিলেও, জেলেরা বলছেন—“ন্যায্য ক্ষতিপূরণ কোথায়?”

জেলেদের বক্তব্যে উঠে আসে চারটি মূল সমস্যা:

  1. জীবিকার অনিশ্চয়তা: মৌসুমভিত্তিক নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিপূরণ না পেয়ে জেলেরা দিন গুনছে ক্ষুধার ক্যালেন্ডারে।
  2. দাদন ঋণের ফাঁদ: অগ্রিম ঋণের নামে শোষণের শিকার হয়ে কমদামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা।
  3. শ্রমের স্বীকৃতির অভাব: শ্রমিক হিসেবে আইনগত সুরক্ষা পান না, নেই নিরাপত্তা বা সামাজিক সেবা।
  4. বৈষম্যমূলক জীবনযাপন: জেলে পল্লীর বাসস্থান অস্বাস্থ্যকর, স্বাস্থ্যসেবা নাগালের বাইরে, শিশুরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

একজন জেলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় হতাশার এক সারাংশ—“নদী যেমন ভাত দেয়, তেমনি অধিকারও কেড়ে নেয়।”

তবু প্রশ্ন থাকে—পদ্মা নদীর মাঝি কি আজও সেই মাঝিই রয়ে গেছে? না কি আরও বেশি অসহায়? আর এই প্রশ্নই তাহলে নতুন দেশের সার্বিক উন্নয়ন চিন্তায় আশংকা তৈরি করে—পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবন কতটা বদলেছে? আর পদ্মার জেলেদের অবস্থার কোন পরিবর্তনই বা ঘটেছে?

তাহলে দেখুন

এই প্রশ্ন নিয়েই অধিকারপত্রের ধারাবাহিক ডকুমেন্টারি আজ পদ্মাপাড়ের মানুষ কেমন আছে?”
পরিকল্পনায়: মোস্তাফিজুর রহমান টিংকু
পরিচালনায়: ড. মাহবুব লিটু
প্রযোজনায়: মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পলাশ

জানুন অজানা গল্প, শুনুন খবরের অন্তরালের সত্য—পদ্মার জেলেদের জীবন কি কেবল বেঁচে থাকার গল্প?

Upcoming

পদ্মা নদীর জেলে (অধিকারপত্র ডকুমেন্টারি) পরবর্তী পর্বসমূহ দেখতে চোখ রাখুন:

পদ্মা নদীর জেলে – পর্ব ০৪: নদীর সঙ্গে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে তার শৈশব।
জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে এক জেলে পরিবার তার প্রতিবন্ধী শিশু সন্তানকে বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে পাঠাচ্ছে মাছ ধরতে। তাকে তৈরি করা হচ্ছে ভবিষতের জেলে হিসেবে—নদীর সঙ্গে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে তার শৈশব। [To survive, a fisherman's family sends their disabled child to fish instead of school. His childhood is being shaped not by books, but by the river — preparing him to become the next generation fisherman.]

পদ্মা নদীর জেলে – পর্ব ০৫: জেলেদের অতীত ও বর্তমানের তুলনা

এক অভিজ্ঞ জেলের জবানিতে উঠে এসেছে মাছ প্রাপ্তির অতীত ও বর্তমানের তীব্র পার্থক্য। নদী বদলেছে, বদলেছে মাছের চিত্র, আর বদলে গেছে জেলেদের ভাগ্য। [Through the words of a veteran fisherman, we hear how the availability of fish has changed drastically over time. The river has shifted — and so has the fate of those who depend on it.]

পদ্মা নদীর জেলে – পর্ব ০৬: জীবন যেখানে নদীর মতোই অনিশ্চিত/Where Life is as uncertain as the River
ইংরেজি ধারাভাষ্যে নির্মিত এই পর্বে উঠে এসেছে পদ্মার পাড়ঘেঁষা জেলে সম্প্রদায়ের অধিকার বঞ্চনার নির্মম বাস্তবতা। নেই সুরক্ষা, নেই স্বীকৃতি—আছে শুধু প্রতিদিনের অনুচ্চারিত যন্ত্রণা, ক্ষুধা, শোষণ আর বেঁচে থাকার লড়াই। এ এক ডকুমেন্টারি যেখানে গল্প বলে না কেউ—গল্প বলে নদী, বলে নোনা চোখ, আর ভাঙা স্বপ্ন। [Episode 06 features an English-narrated documentary portraying the harsh truth of fishermen living along the banks of the Padma River. Stripped of rights, recognition, and safety nets, they live lives shaped by hunger, exploitation, and silence. This is not just a documentary—it's a river telling its own story through tired eyes and shattered hopes.]

দেখুন, শুনুন, ভাবুন—
যে নদী এক সময় জীবন দিত, আজ সে-ই কি প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে?
আর যদি তাই হয়, তবে আমরা কী করছি?

তথ্য নয়, সত্য জানুন।
এক ঠিকানাঅধিকারপত্র.কম
চোখ রাখুন অধিকারপত্র ইউটিউব চ্যানেলে।@odhikarpatra

— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: