odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Monday, 29th December 2025, ২৯th December ২০২৫
ধর্মের পবিত্রতার সাথে দর্শনের সংমিশ্রণে জীবনের উদ্দেশ্য, ন্যায়বিচার ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতার এক গভীর দার্শনিক অনুসন্ধান এবং ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।

জীবন কেন? আল-কোরআনের আলোকে মানবসত্তার দর্শন ও আধুনিক সমাজের বিচ্যুতি

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ২৯ December ২০২৫ ০৭:০৭

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ২৯ December ২০২৫ ০৭:০৭

—একটি ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক অনুসন্ধান

"জীবন কেন?" — মানব ইতিহাসের এই চিরন্তন প্রশ্নের উত্তর কোরআনের আয়াতে, হাদীসের ব্যাখ্যায় এবং বিশ্বখ্যাত দার্শনিকদের চিন্তাধারায় কীভাবে মূর্ত হয়েছে? বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক বিচ্যূতি দূর করে কল্যাণ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সেই সত্যের প্রাসঙ্গিকতা অনুসন্ধান।

"জীবন কেন?" (Why?) — এই প্রশ্নটি কেবল ধর্মতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা নয়, এটি মানবসত্তার গভীরে প্রোথিত এক দার্শনিক আর্তনাদ। প্রদীপ্ত সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে কিংবা ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে, প্রতিটি মানুষ তার অস্তিত্বের মূল লক্ষ্য খুঁজতে চেয়েছে। সক্রেটিস যেমন বলেছেন, "পরীক্ষিত জীবনই বাঁচার যোগ্য," তেমনি প্রাচ্যের মহাজ্ঞানীরাও জীবনকে কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসের সমষ্টি নয়, বরং মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখেছেন। এই অনুসন্ধানের চূড়ান্ত ও প্রাঞ্জল উত্তরটি পাওয়া যায় আল-কোরআনের ঐশী বাণীতে, যা জীবনকে এক গভীর অর্থ ও তাৎপর্য দান করেছে।

অপরদিকে মানবজীবনের উদ্দেশ্য 'কি?' (What?) এর উত্তর, তা ধর্মতাত্ত্বিক হোক বা দার্শনিক, চূড়ান্তভাবে একটি অভিন্ন সত্যের দিকেই ধাবিত হয়: জীবন কেবল ভোগ বা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নয়, বরং এটি আত্মিক পূর্ণতা (Spiritual Perfection), নৈতিক দায়িত্ব (Moral Accountability) এবং মানবকল্যাণ (Human Welfare) প্রতিষ্ঠার এক মহৎ প্ল্যাটফর্ম। কোরআনের 'ইবাদাহ' এবং 'খিলাফাহ'র ধারণাটিই পশ্চিমা ও প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের চিন্তায় (যেমন: প্লেটোর 'Good' এর ধারণা বা ভারতীয় দর্শনের 'মোক্ষ') ভিন্ন নামে প্রতিফলিত হয়েছে। এই স্মারকলিপিটি উক্ত অভিন্ন সত্যের যৌক্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে।

উদ্দেশ্যের মূল ভিত্তি: ইবাদাহ খিলাফাহ

ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অনুসারে, জীবনের উদ্দেশ্য কেবল জাগতিক সুখ বা জৈবিক চাহিদা পূরণ নয়, বরং এর মূল উদ্দেশ্যটি দুটি কোরআনিক ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত: ইবাদাহ (আল্লাহর দাসত্ব/আনুগত্য) এবং খিলাফাহ (পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি)। এই ‘ইবাদাহ’ শব্দটি কেবল নামাজ, রোজা বা আনুষ্ঠানিক উপাসনায় সীমাবদ্ধ নয়। ইবনে সিনার (Avicenna) মতো দার্শনিকেরা এই ‘ইবাদাহ’কে আত্মার পরিপূর্ণতা এবং সর্বোচ্চ জ্ঞান (Ultimate Knowledge) অর্জনের অবিরাম প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, মানবাত্মা একটি ‘নকশাবিহীন স্লেট’ নয়, বরং ঐশী প্রজ্ঞা দ্বারা আলোকিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। মানুষের প্রতিটি সৎকর্ম, ন্যায়পরায়ণ চিন্তা, এমনকি একটি গাছের প্রতি যত্ন নেওয়াও এই বৃহত্তর ইবাদতের অংশ। অন্যদিকে, মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা। এই ভূমিকা তাকে এক বিরাট নৈতিক দায়িত্বের ভার দিয়েছে। পৃথিবীর সম্পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার না করে, তা সমাজের কল্যাণ ও সুবিচারের জন্য ব্যবহার করাই হলো ‘খিলাফাহ’র লক্ষ্য। জীবন তাই কেবল ব্যক্তিগত পূর্ণতার জন্য নয়, বরং একটি সুশৃঙ্খল, কল্যাণময় ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য এক ঐশী মিশন।

উদ্দেশ্যের ত্রিমাত্রিক ভিত্তি (The Three-Dimensional Foundation of Purpose)

জীবনের উদ্দেশ্য কোনো একক বা সরল ধারণা নয়; বরং এটি তিনটি আন্তঃসম্পর্কিত মৌলিক স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই স্তম্ভগুলো একত্রে মানুষের অস্তিত্ব, নৈতিকতা ও কর্মের তাৎপর্যকে অর্থবহ করে তোলে।

  1. আল্লাহর সন্তুষ্টি আত্মার পূর্ণতা (Divine Pleasure & Self-Perfection): আল-কোরআনের মৌলিক শিক্ষা অনুযায়ী, মানবসৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত। কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—“আমি জিন ও মানবকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।”(সূরা আয-যারিয়াত, ৫১: ৫৬) —এখানে ‘ইবাদত’ বলতে কেবল আনুষ্ঠানিক উপাসনাকেই বোঝানো হয়নি; বরং আল্লাহর নির্দেশিত ন্যায়নীতি ও নৈতিকতার আলোকে জীবনের প্রতিটি কাজ পরিচালনা করাকেই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুফি দার্শনিক মাওলানা রুমি এই ইবাদতকে ব্যাখ্যা করেছেন এক ধরনের প্রেমময় সন্ধান হিসেবে—যেখানে মানুষ নিজের ভেতরের আল্লাহপ্রদত্ত রূহকে অনুধাবন করে এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তাঁর সান্নিধ্য লাভের পথে অগ্রসর হয়। এই আত্মশুদ্ধি ও আত্মোপলব্ধিই আত্মার পূর্ণতার মূল ভিত্তি।
  2. নৈতিক দায়িত্ব ও খিলাফাহ (Moral Accountability & Trusteeship): ইসলামি দর্শনে মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই খিলাফাহ কোনো সম্মানসূচক পদ নয়; বরং এটি এক গভীর নৈতিক দায়িত্ব ও আস্থার চুক্তি। কোরআনে বলা হয়েছে—“আমি পৃথিবীতে একজন খলিফা সৃষ্টি করতে চলেছি।” (সূরা আল-বাকারা, : ৩০) — আর খলিফা হিসেবে মানুষের দায়িত্ব হলো পৃথিবীতে ন্যায় (Adl) ও কল্যাণ (Ihsan) প্রতিষ্ঠা করা। এ প্রসঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শনের সঙ্গে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংযোগ লক্ষ করা যায়। সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি— পরীক্ষিত জীবনই বাঁচার যোগ্য—মানুষের নৈতিক আত্মসমালোচনা ও দায়িত্বশীল জীবনের ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করে, তা খিলাফাহর ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। একইভাবে ইবনে সিনা (অ্যাভিসেনা) দেখিয়েছেন, মানুষের সর্বোচ্চ সুখ তখনই অর্জিত হয়, যখন তার বুদ্ধি ও আত্মা নৈতিকতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সে সক্রিয়ভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে।
  3. নশ্বরতা এবং মহৎ কর্মের গুরুত্ব (Mortality and the Weight of Action): জীবনের নশ্বরতা বা মৃত্যুচেতনা মানুষের কর্মকে অর্থবহ করে তোলে এবং দায়িত্ববোধকে গভীরতর করে। ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবন একটি পরীক্ষা, যার চূড়ান্ত মূল্যায়ন পরকালে সম্পন্ন হবে। কোরআনে বলা হয়েছে—“যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য—কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম?”(সূরা আল-মুলক, ৬৭: ) —এই পরীক্ষার ধারণা মানুষকে দায়িত্বশীল কর্মে উদ্বুদ্ধ করে। হাদীসে আরও বলা হয়েছে—“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে মানুষের জন্য অধিক কল্যাণকর।” —এই বাণী স্পষ্ট করে যে, জীবনের উদ্দেশ্য কেবল ব্যক্তিগত মুক্তি বা আত্মরক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করাও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনের নশ্বরতার এই সচেতনতা মানুষকে ভোগবাদী প্রবণতা থেকে দূরে সরিয়ে মহৎ কর্ম, ন্যায়বোধ ও সামাজিক কল্যাণের পথে পরিচালিত করে।

কল্যাণ, ন্যায় ও দার্শনিক প্রাসঙ্গিকতা

জীবনের এই উদ্দেশ্য তখনই সফল হয় যখন ব্যক্তি ও সমাজ কল্যাণের পথে চালিত হয়। কোরআন মজিদে আল্লাহ কঠোরভাবে ন্যায়বিচার ও ইহসান (উত্তম আচরণ বা সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণ) প্রতিষ্ঠার আদেশ দিয়েছেন: "নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ নিকটাত্মীয়দের দান করার নির্দেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ অবাধ্যতা করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।" (সূরা নাহল, ১৬: ৯০) —এই আয়াতটি মানবজীবনের উদ্দেশ্যকে এক সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। কল্যাণ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইবাদত অসম্পূর্ণ। সুফি সাধক ও মরমী কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শনে এই কথাটিই বলেছেন— ভেতরের সত্যকে উপলব্ধি করাই হলো খোদার সন্ধান, কিন্তু সেই সন্ধান অর্থহীন, যদি না তা সৃষ্টির প্রতি দয়া ও ভালোবাসা হিসেবে প্রকাশ পায়। অর্থাৎ, আত্মার পরিশুদ্ধি (রুমি) অবশ্যই সমাজের পরিশুদ্ধির (কোরআন) দিকে চালিত হবে।

যদি আমরা বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাকাই, তবে দেখা যায়— ব্যক্তিজীবনের লোভ, দুর্নীতি, এবং সামাজিক অসাম্য আমাদের এই মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করেছে। আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার এক ধরনের আধুনিক ফ্যাসাদ’ (Corruption /বিপর্যয়) সৃষ্টি করেছে, যা সমাজের ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে। বস্তুবাদিতার এই অস্থির স্রোতে মানুষ তাদের আধ্যাত্মিক ‘কেন্দ্র’ থেকে সরে গেছে। কোরআনের সাবধানবাণী এখানে গভীর প্রাসঙ্গিক: "যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো কেবল সংশোধনকারী।" (সূরা বাকারা, : ১১) —এই বিচ্যূতির কারণেই দেশে নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের ঘাটতি দেখা যায়, যা প্রমাণ করে যে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা পালিত হলেও, বৃহত্তর ‘ইবাদাহ’ ও ‘খিলাফাহ’র স্পিরিট আজ সংকটে।

রূপক, হাদিস ও জীবনের পরীক্ষা

ইসলামী ধর্মতত্ত্বে জীবনকে প্রায়শই একটি ‘সফর’ (যাত্রা) এবং একটি ‘পরীক্ষা’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, "আমি ছিলাম গোপন ভাণ্ডার, আমি চেয়েছিলাম মানুষ আমাকে জানুক, তাই আমি সৃষ্টি করলাম।" এটি মানুষের মধ্যে নিহিত ঐশী স্পৃহার একটি সুন্দর রূপক— জীবন হলো স্রষ্টাকে জানার এবং চেনার এক প্রেমময় যাত্রা। আবার কোরআন জীবনকে একটি অনিবার্য পরীক্ষার মঞ্চ হিসেবে ঘোষণা করেছে। আরম এখানে কর্মে ‘উত্তম’ হওয়ার মানদণ্ড হলো: ব্যক্তিগত সততা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠা। সক্রেটিসের দর্শনও এই পরীক্ষার ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ— কেবল জ্ঞান অর্জনই যথেষ্ট নয়, সেই জ্ঞানকে নৈতিক ও কল্যাণকর জীবনে প্রয়োগ করাই শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড।

আধুনিক সমাজের বিচ্যুতি ও এর প্রাসঙ্গিকতা

আধুনিক সমাজে—বিশেষত বাংলাদেশি বাস্তবতায়—জীবনের উদ্দেশ্য সংক্রান্ত এই অভিন্ন ও সমন্বিত সত্য থেকে ক্রমাগত বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়। এই বিচ্যুতির পেছনে কয়েকটি কাঠামোগত ও মানসিক কারণ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, যা ব্যক্তি ও সমাজ উভয় স্তরেই গভীর সংকট তৈরি করেছে।

প্রথমত, ভোগবাদের আধিপত্য : আধুনিক জীবনের প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। জীবনকে ক্রমেই ‘খাওয়া-পরা’, ভোগ, আর তাৎক্ষণিক স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। এর ফলে কোরআনিক ‘ইবাদাহ’-এর ব্যাপক ও সমন্বিত ধারণা সংকুচিত হয়ে কেবল আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অথচ ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে ইবাদাহ হলো জীবনের সামগ্রিক নৈতিক দিকনির্দেশনা—যেখানে অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক আচরণ সবই আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়ার কথা। ভোগবাদ এই সামগ্রিকতাকে ভেঙে দিয়ে জীবনকে অর্থহীন খণ্ডিত অভিজ্ঞতায় রূপান্তর করেছে।

দ্বিতীয়ত, খিলাফাহ’-এর ব্যর্থতা: আধুনিক সমাজের একটি মৌলিক নৈতিক সংকট। ক্ষমতা ও সম্পদের অপব্যবহার, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য এই ব্যর্থতার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। মানুষ যখন নিজেকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে নয়, বরং নিছক ভোক্তা বা ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করে, তখন খলিফা হিসেবে অর্পিত ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব উপেক্ষিত হয়। এর ফলেই সমাজে আস্থা ভাঙে, ন্যায়বোধ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং মানবিক সম্পর্কগুলো ক্রমে যান্ত্রিক ও স্বার্থনির্ভর হয়ে ওঠে।

তৃতীয়ত, অহং আত্মকেন্দ্রিকতার বিস্তার : আধুনিক সমাজে আত্মিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে আরও তীব্র করেছে। ব্যক্তিগত মুক্তি, আধ্যাত্মিক উন্নতি বা ‘নিজেকে গড়ার’ প্রচেষ্টা অনেক সময় সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই প্রবণতা সুফি দর্শন কিংবা ইবনে সিনার নৈতিক দর্শনের পরিপন্থী। রুমি বা ইবনে সিনা—উভয়ের কাছেই আত্মার উন্নতি একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যক্তি নিজের উৎকর্ষ সাধন করে সমাজের কল্যাণে অবদান রাখে। আত্মকেন্দ্রিক আধ্যাত্মিকতা সেই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গিকে ভেঙে দিয়ে আত্মোন্নয়নকে এক ধরনের নিঃসঙ্গ ও আত্মমুখী প্রকল্পে পরিণত করেছে।

মূল প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর: করণীয় প্রাসঙ্গিকতা

"জীবন কেন?"— মানবজীবনের এই মূল প্রশ্নটির উত্তর কোরআন এবং মহান দার্শনিকেরা একীভূত করেছেন— আধুনিক বাংলাদেশের সমাজের জন্য এই উপলব্ধি অপরিহার্য। দুর্নীতি, অসাম্য, এবং নৈতিক অবক্ষয় দূর করে যদি মানুষ আবার তার জীবনের মৌলিক উদ্দেশ্য অর্থাৎ, স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও সৃষ্টির প্রতি ন্যায়বিচারের পথে ফেরে, তবেই ব্যক্তিগত শান্তি ও জাতীয় কল্যাণ নিশ্চিত হবে। জীবন তাই কেবল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই নয়, এটি মানবসত্তার উত্থান এবং পৃথিবীতে ঐশী-ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক পবিত্র দায়িত্ব। তাইতো কবি বলেন, “নিঃশ্বাসের নাইরে বিশ্বাস, পলকে করিবে নৈরাশ।”—তাই সতর্ক হতে হবে। জীবনের এই রুঢ় সত্যটি নিচের টেবিলে প্রদত্ত দার্শনিক মডেলের মাধ্যমে বোঝা যায়: 

তাই আসুন, আমরা এই মহৎ জীবন উদ্দেশ্যের সন্ধানে নিজেদের প্রশ্ন করি এবং কোরআনের বাণীতে আলোকিত হয়ে একটি সমৃদ্ধ, ন্যায়পরায়ণ ও কল্যাণকর সমাজ গড়ার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করি। জীবন কেবল শুরু নয়, এটি একটি সুযোগ— স্বর্গীয় গন্তব্যে পৌঁছানোর সুযোগ।

এই বহুমাত্রিক বিচ্যুতি দূর করতে হলে ব্যক্তিকে অবশ্যই তার জীবনের মৌলিক কেন?’ প্রশ্নটির উত্তর দৈনন্দিন কর্মজীবনে প্রতিফলিত করতে হবে। জীবনের উদ্দেশ্য কেবল চিন্তার স্তরে সীমাবদ্ধ থাকলে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে; বরং সেই উদ্দেশ্যকে বাস্তব আচরণে রূপ দিতে হয়। ব্যক্তির ব্যবসা, রাজনীতি, শিক্ষা, পেশাজীবন কিংবা পারিবারিক সম্পর্ক—সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণের নৈতিক লক্ষ্যকে কেন্দ্রীয় প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গিই আধুনিক সমাজে জীবনের উদ্দেশ্যকে নতুন করে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। কারণ বর্তমান সংকটের সমাধান কোনো একক নীতিগত সংস্কার বা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে সম্ভব নয়; বরং প্রয়োজন এমন এক নৈতিক ও মানসিক পুনর্গঠন, যেখানে ইবাদাহ, খিলাফাহ এবং মানবকল্যাণ—এই তিনটি ধারণা আবারও জীবনের কেন্দ্রস্থলে ফিরে আসে।

মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

#জীবনদর্শন #আলকোরআন #ইসলামিক_দর্শন #সক্রেটিস #ইবনেসিনা #রুমি #মানবকল্যাণ #ন্যায়বিচার #বাংলাদেশ_সমাজ #আধ্যাত্মিকতা 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: