সংযোগ পেয়েই হন্তদন্ত হয়ে বলতে শুরু করি- আমার পাশের বাড়ির একজনকে সাপে কে’টেছে। খুবই বি’ষাক্ত। আমরা এখন কী করতে পারি স্যার?
উত্তরে তিনি বলেন- একদম দেরি না করে সোজা যশোরে চলে যান।
– কেন স্যার? আপনাদের হাসপাতালে সাপে-কাটা রোগীর চিকিৎসা হয় না?
– না, এই চিকিৎসা আমাদের হাতে নেই। সেই ইনজেকশনও নেই। সেটি থাকে মেডিক্যালে।
কিছুক্ষণ থেমে এবার কল করি নিজের এলাকা মিরসরাইয়ের সরকারি হাসপাতালে। ‘আমি করেরহাট থেকে বলছি’ পরিচয় দিয়েই একই ধরনের কথা শোনালাম।
তার উত্তরও অভিন্ন। বললেন- ‘এক মুহূর্তও সময় ন’ষ্ট না করে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে চলে যান। এই ইনজেকশন স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতাল কিংবা ফার্মেসিতে পাবেন না। মেডিক্যালই একমাত্র ভরসা।’
কিছুক্ষণ পরে কল করি বান্দরবানের লামা উপজেলায়। সেখানেও একই কথোপকোথন। এরপর একে একে বরিশালের গৌরনদী, পাবনার সাঁথিয়া, চাটমোহর, ময়মনসিংহের ভালুকা, নরসিংদীর পলাশ, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, কাটিয়াদি, জামালপুরের ইসলামপুর, গোপালগঞ্জের মুকসেদপুর, সিলেটের হবিগঞ্জসহ ১৬টি উপজেলার সরকারি হাসপাতালে আজ কথা বলেছি। সবখানে সব ডাক্তারই শুনিয়েছেন একই বাক্য!
যশোরের মনিরামপুরে সাপের দং’শনে ৯ জনের মৃ’ত্যুর খবর কাগজে পড়েছি। নাটোরের নলডাঙায় ৯ম শ্রেণির ছাত্রী এবং কেশবপুরে দুই ভাই-বোনের ম’র্মান্তিক মৃ’ত্যুর খবরও জেনেছি। সেই খবরগুলি কেবল খবরেই আটকে ছিলো। বিবেকের চোখ খুলেছে মিরসরাইয়ের নোমান। সোনার টুকরা ছেলেটির ব’লিদানের পরেই অনেকে জেনেছেন উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের ইনজেকশন থাকে না।
নানা কারণে তথ্য পেতে অনেকেই আমাকে নক করেন। সে কারণে এমন অনেকগুলো দুর্ঘটনার খবর জানি। সাপের ছো’বল খাওয়া রোগী নিয়ে পথে পথে ঘোরা এমন অনেক অসহায় মানুষের আ’র্তনাদ আমি শুনেছি। শহরে মেডিক্যালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আমার ছিলো না কোনকালে।
মিথ্যাবাদি সেজে এই সত্যিটাই বার করতে চেয়েছিলাম যে, আসলেই কি গ্রামপর্যায়ে সাপের বি’ষাক্রান্তের কোনো চিকিৎসা নেই? সারাদেশের উপজেলা পর্যায়ের সবগুলো সরকারি হাসপাতালে কল করার ইচ্ছে আমার। একটি হাসপাতালও কি খুঁজে পাবো না, যেটি ব্যতিক্রম?
মনিরামপুরের উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপটা দীর্ঘ করেছিলাম। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম- গুরুত্বপূর্ণ ইনজেকশনটি গ্রামে না রেখে শহরে কেন?
তার জবাব ছিলো- সাপের বি’ষে আ’ক্রান্ত রোগীকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রেখে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির আওতায় আনতে হয়। ইনজেকশন পুশ করার পরে তাকে অবজারভেশনে রাখা লাগে।
তার সরলবাক্যে আমি আরো বিচলিত! বললাম- এই যন্ত্রপাতি কিংবা করোনারি কেয়ার ইউনিটের ব্যবস্থা উপজেলার সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থা নেই কেন?
তিনি নিরুত্তর।
এসব সরকারি হাসপাতালে নিযুক্ত ডাক্তারেরা যে ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তা আমরা বহু সাধারণেরই জানা। তাহলে বেতন দিয়ে এদের পুষতে হবে কেন? আবার তৃণমূলের অ’সচেতন অনেকেই আছেন, যারা জানেন না বলে রোগীকে নিয়ে যান উপজেলার হাসপাতালে। সেখানে বেশকিছু সময় ন’ষ্টের পরে পাঠানো হয় শহরে। ততক্ষণে বি’ষে নীল হয়ে যায় আ’ক্রান্তের সমস্ত শরীর।
ইসলামপুরের চিকিৎসক আমাকে বলেন, বি’ষাক্ত সাপের ছো’বল হলে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টার মধ্যে ইনজেকশনটি পুশ করতে হবে। নইলে বি’পদ।
অথচ গ্রামে যেখানে সাপের উ’পদ্রব, সেখান থেকে শহরের মেডিক্যালের দূরত্ব ২ ঘণ্টারও বেশি। সময়, দূরত্ব আর বিবেকের হেরফেরে তাজা জীবনগুলো এভাবেই না’শ হয়ে যায়!
স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা না-ই বা করলাম। এটি তো তুলে ধরতে পারি যে, আমাদের সরকারপ্রধান বহুবার হুম’কি দিয়েছেন ডাক্তারদের। গ্রামে না গেলে চাকরি কেড়ে নেওয়ার হুম’কি সর্বোচ্চপর্যায় থেকে ছিলো। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু ডাক্তারদের গ্রামে পাঠানোর সমস্ত আয়োজন করে পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা কেন শহরে ব’ন্দি? তাদেরকে আজ এই শিক্ষাটাই দিতে হবে- সাপ কি শহরে বাস করে, নাকি গাঁয়ে?
তাদের কাছে নিশ্চয়ই এই প্রশ্নের উত্তর জানা। তবু তারা নিরব হয়ে থাকবেন। কারণ, তাদের কাছে অনেক কিছুর দাম থাকতে পারে; শুধু দাম নেই মানুষের জীবনের!
লেখক: জয়নাল আবেদিন
পরিচিতি: সংবাদকর্মী
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: