
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট এখন অত্যন্ত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক দায়িত্বহীনতার কারণে আজ প্রায় ২৯৫ মিলিয়ন মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। GFRC ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে জানানো হলো, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে ৫৩টি দেশে ৩৭.৭ মিলিয়ন শিশুর মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা গুরুতর দারিদ্র্য ও অপুষ্টিতে পড়েছে, যাদের মধ্যে ১০ মিলিয়ন জরুরি চিকিৎসার দাবিদার। তাছাড়া, গাজা অঞ্চলে ১০০% মানুষের তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, যা খাদ্য সংকটের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে।
তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো বিশ্বব্যাপী “হিডেন হাঙ্গার” বা অদৃশ্য ক্ষুধার প্রকাশ—২০২২ সালে প্রায় ২.৮ বিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার খরচ করতে না পারায় এই সংকটে পতিত হয়েছে। এদিকে, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ২০২৪-২৫ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১২৭ দেশের মধ্যে ৮৪তম অবস্থানে রয়েছে এবং ১৯.৪ স্কোর পেয়ে “মডারেট” ক্ষুধা পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় আরও নাজুক চিত্রের ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্ব খাদ্য ন্যায্যতা ড্যাশবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২২ সালে বিশ্ব খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির মাত্র ১% অতিরিক্ত ১০ মিলিয়ন মানুষকে “অতিক্রান্ত দারিদ্র্যে” ঠেলে দিয়েছে। এর পাশাপাশি বাজার অদক্ষতায় বছরে প্রায় $১০ ট্রিলিয়ন ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, যা খাদ্য ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে।
এই সংকটের মূল চালিকা শক্তির মধ্যে রয়েছে সঙ্ঘাত, যা ২০টিরও বেশি দেশে খাদ্য সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত, এবং জলবায়ু চালিত দুর্যোগ যা ১৭টি দেশকে প্রভাবিত করেছে। অর্থনৈতিক শক—যেমন মুদ্রাস্ফীতি—আরও ১৬টি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সমস্যাকে প্রকট করেছে।
পরিশেষে, এ দৃশ্যপট থেকে বোঝা যায়, সতর্কতা এবং প্রগতিশীল নীতিমালার মাধ্যমে আমরা খাদ্য নিরাপত্তায় স্থায়ী সমাধান আনতে পারি। উন্নত পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও প্রযুক্তি নির্ভর সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এমন প্রাণঘাতী সংকট প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বিভিন্ন দেশের কার্যকর উদ্যোগ ও অনুকরণীয় উদাহরণ
খাদ্য অপচয় কেবল অর্থনৈতিক বা পরিবেশগত সমস্যা নয়—এটা এক নিঃশব্দ, কিন্তু গভীর নৈতিক বৈপর্যায়। একজন নাগরিকের আধা-ভরা প্লেট থেকে ফেলে দেওয়া ভাত আচ্ছন্ন হতে পারে কমিউনিটির এক ক্ষুধার্ত শিশুর সময়ের একমাত্র আহারে। এটা প্রমাণ করে অর্থনৈতিক সুবিধার ভিত্তিতে মানুষ কতটা ভিন্ন বাস্তবতায় বসবাস করছে। আরও ভয়াবহ হলো, কেউ হয়তো এই বৈষম্যের ব্যাপারে সচেতন নয়—যেমন উন্নত দেশগুলোর গ্রাহকরা অব্যাহতভাবে প্রচুর খাবার ফেলে দিতে সক্রিয় হয়।
বৈশ্বিক কিছু দেশ আজ সচেতন উদ্যোগ গ্রহণ করছে: ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী সুপারমার্কেটগুলি পারে না তাদের খাবার ফেলে দিতে — তাদের বাধ্য করা হয় অভ্যন্তরীণ ও সামাজিক চ্যানেলে দান করতে। দক্ষিণ কোরিয়ার “Love Food, Stop Waste” ক্যাম্পেইন শিক্ষা দেয় কীভাবে portion control কার্যকরভাবে কাজ করে। জার্মানির কিছু শহরে “Community Fridges” প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে কেউ তার অস্বাদু খাবারগুলো আনা-বিনিময়ে অংশগ্রহণ করে দিতে পারে। এগুলো শুধু অপচয় রোধ করেনি, বরং সামাজিক বন্ধন গড়েছে।
দক্ষিণ বাঙালি শহরে একটি NGO চালু করেছে ‘Feeding the Hungry’ নামে একটি প্রোগ্রাম, যেখানে রেস্টুরেন্ট থেকে সংগ্রহিকৃত খাবার রাতে ফেলে না দিয়ে, বিতরণ করা হয় পথের অসচ্ছল মানুষদের মাঝে। ফলশ্রুতিতে, একটি সময়ে রেস্টুরেন্টের অপচয় অনেকাংশে কমেছে। এমনটি দেখিয়ে দিয়েছে সমাজের সচেতনতা কীভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিবর্তন আনতে পারে।
এই উদাহরণগুলি প্রমাণ করে, খাদ্য অপচয় একটি নীতিগত দর্শন—যেখানে নৈতিক দায় এবং দাতব্যতা একসাথে কাজ করে। এর কেবল ব্যবস্থাপনাগত নয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক আত্মবোধও দরকার। যখন সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকরা একসাথে কাজ করে, তখন এ সমস্যার সমাধানকারীরা আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। এই উদ্যোগগুলো অনুকরণীয় হতে পারে আমাদের দেশেও।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য অপচয় বনাম ক্ষুধার বাস্তবতা: The Hunger Project-এর দৃষ্টিকোণ
“The Hunger Project” – এক বিশ্বব্যাপী সংস্থার মিশন ক্ষুধা বিমোচন। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিকভাবে খাদ্য উৎপাদন পর্যাপ্ত। তবে উৎপাদন ও অপচয়ের ব্যবধান নীরবে বাড়ছে।েই কারণেই, প্রতিটি অপচয় করা টুকরো ভাত, ঝুঁকছে জীবন ও ক্ষুধার অন্তর্গত চিরাচরিত দ্বন্দ্বের দিকে: খাদ্য অপচয় বনাম ক্ষুধার বাস্তবতা।
এই সংস্থা দেখায়, উন্নত দেশের পরিবারের ৩০% খাবার অপচিয়ে যায় আর একই সময়ে উন্নয়নশীল দেশে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ২২ জন খাদ্য সঙ্কটে ভোগে। “Hunger Project” দাবি করে—এই বৈপর্যায় একটি সাংঘাতিক সমস্যা: তাত্ত্বিকভাবে অপ্রয়োজনীয় অপচয় প্রতিটি গরীবকে নীরবে হত্যা করতে পারে।
তারা একটি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে জোরার করে দিচ্ছেন—“Waste Not, Feed Many”৷ খাদ্য অপচয় রোধের মাধ্যমে দানসামগ্রীগুলোর যোগ্যতা নিরাপদ রাখা যাবে, যেখানে অপচয়কারীরা নিজ উদ্যোগে গরীবদের আনতে পারে, এমনকি রান্নার সময় portion নির্ধারণ এবং বাকী খাবার সংরক্ষণ শেখায়। বেশ কিছু pilot এলাকায় শিশুদের খাদ্যসেবায় এই পদ্ধতি গ্রহণ করে দৈনিক ১৫% অপচয় হ্রাস—and খাদ্যের প্রাপ্যতা ৫–১০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘Hunger Project’ মনে করিয়ে দেয়—খাদ্য অপচয় কেবল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানজনিত নয়, এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক দায়। উন্নত বিশ্ব যদি সচেতন ভাবে তার অপ্রয়োজনীয় খাদ্য অপচয় বন্ধ করে, দুর্বল আর দরিদ্রদের জন্য এটা হতে পারে জীবন–মৃত্যুর এক সেতুবন্ধ। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে ক্ষুধা এখনও বড় সমস্যা, এই মডেল এক সংকট নিরসনের জন্য দিশারী হতে পারে।
বিশ্ব বিশ্লেষণ ও নৈতিক দায়
খাদ্য অপচয় সমাজকে একটি অনুশীলনজীবী আঙিনা দিয়ে জিজ্ঞেস করে: আমরা কী ধরনের সভ্যতা চাই? বৈশ্বিক মাত্রায় উৎপাদিত খাবারের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অপচয় হয়—এটি শুধু অর্থনৈতিক অপচয় নয়, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি অপমানজনক। যখন মানুষ রাতভর ক্ষুধায় ভুগে, তখন আমাদের অর্ধেক প্লেটে থাকা খাদ্য ‘প্রতিটি দানার’ ন্যায়-নৈতিক চেতনার অধিকারীকে না দেওয়া, এক কাফেলার স্বার্থে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন এটি “নৈতিক দায়হীনতার প্রতীক”—যেখানে গ্রাহক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নীতি-নির্ধারকরা এককভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ কোষ্ঠকাঠিন্য বুঝে না, কেউই দূরদৃষ্টি দেখায় না। একদিকে খাদ্য অপচয়—অন্যদিকে ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ—এই পরিপ্রেক্ষিতে শব্দহীন মানবতাবাদ ক্রমেই স্তব্ধ হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও FAO যৌথভাবে আহ্বান জানিয়েছে, খাদ্য অপচয় রোধকে মানবাধিকার নিশ্চিতির সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। এই আবেদন কার্যকর হলে, খাদ্য অপচয় – শুধুমাত্র পরিবেশগত নয়, নৈতিক শিক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার অধীনে আইনের আওতায় আসবে। বাংলাদেশ এ ব্যত্যয়ের লক্ষ্য দেখাতে পারে সচেতন পরিকল্পনা ও সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে।
অপচয় রোধই ক্ষুধা নির্মূলের প্রথম শর্ত
যখন একটি পরিবারের খাদ্য অপচয়ে যায়, তখন “অপার্যাপ্ত ও অপচিত খাওয়ানো” – এর বিপরীতে “ক্ষুধা নির্মূলের প্রথম শর্ত” উল্লেখ নিয়িতভাবে হয়ে দাঁড়িয়ে। এক গবেষণা অনুযায়ী, খাদ্য অপচয় হ্রাসযোগ্য হলে সারা বছর জুড়ে ১৭% কম খাদ্য উৎপাদনেই বিশ্বশক্তিতে খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করা যায়। এই সক্ষমতা বিশ্লেষণে প্রমাণ হয়েছে—ক্ষুধা-বিমোচন যুদ্ধ জয়ের প্রথম ধাপ হলো অপচয় রোধ।
দেশব্যাপী উদ্যোগ হিসাবে রেস্টুরেন্ট, স্কুল, অফিস বিভাগে অপচয় পরিমাপের প্রয়োগ জরুরি। প্রতিটি ‘Waste Audit’ আয়োজন করলে সহজভাবে বোঝা যায়—কের কতটা অপচয় হচ্ছে। বিশেষ করে জায়গাগুলো যেখানে পুরণো খাবার অন্তত রান্না বন্ধ করে ৫০% অপচয় কমানো যায়—সেক্ষেত্রে সম্পদগুলি সহজেই redirect করা যায় দরিদ্র ছেলেমেয়েদের আহারে।
এছাড়া “portion-control” সংস্কৃতি গড়ে তোলা—যা শেখায় গণ–পরিবেশ করেও অর্ধেকই যথেষ্ট—এবং “left-over packing” বা “doggy bags” ব্যবহারের প্রচার আর প্রয়োজনীয়। সরকারি ভাবে “Leftover Food Donation Act” আনা সম্ভব যাতে রেস্টুরেন্টগুলো বাকি খাদ্য দানের বাধ্য থাকে।
এভাবে অপচয় রোধ করা মাত্রই ক্ষুধামুক্তির পথ এক ধাপ এগিয়ে যায়। তবে, এটি শুধু খাবার সাময়িক সরবরাহ নয়, সামাজিক শিক্ষা, নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক দায়বোধের বিষয়। তাই অপচয় রোধের প্রথম ধাপ হিসেবে এটি একটি নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রান্তিকাল তৈরি করে—যা ভালো খাওয়ানো ও ন্যায্যতার সম্মিলিত পরিচায়ক হিসেবে কাজ করে।
— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: