ঢাকা, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ : একের পর এক ফোন কল রিসিভ করছেন তারা দু’জন। সকাল নয়টায় অফিসে আসার পর থেকে টানা ফোনে বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে চলেছেন। দিয়ে যাচ্ছেন পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় তথ্য। কেউ অভিযোগ দিলে তা লিখে নিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তদন্ত কমিটির কাছে। এভাবেই চলছে তাদের দু’জনের অফিস। কিন্তু টানা কাজ করে গেলেও চোখে-মুখে ক্লান্তির ছোঁয়া নেই এতটুকুও। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে কাজ করছেন তা তৃপ্তির সাথেই করছেন। বেশ উপভোগও করছেন তাঁরা।
রওনক জাহান উষা এবং মোসাম্মত মিতা খাতুন কাজ করছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কল সেন্টারে। যদিও অনেক মেয়েই কাজ করছেন তাদের দু’জনের মত অন্যান্য প্রতিষ্টানে। কিন্তু উষা আর মিতার বিষয়টি ভিন্ন। তাদের জীবনের গল্প অন্য আর দশজন নারীর মত নয়। তারা দুজনেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। দুজনেই হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন এবং অনেক কষ্টে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে অফিসে আসেন।
বেশ কয়েক মাস হলো তারা কাজ করছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কল সেন্টারে। এখানে কাজ শুরুর আগে এক মাসের প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে দু’জনকেই।
উষার সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি ইডেন মহিলা কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ২০১১ সালে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে ইডেনে পড়ালেখা শুরু করেন তিনি। স্কুলে সব সময় ভালো রেজাল্ট করে আসা মেয়েটির মুখে সারাক্ষন হাসি লেগেই থাকত। সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি।
ইডেনে ক্লাস শুরুর পর পলাশীর একটি বাড়িতে সাবলেট থাকা শুরু করেন উষা। মাত্র তিন মাসের মাথায় একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পা পিছলেয়ে পড়ে যান তিনি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন পরীক্ষার পর জানা যায় স্পাইনালকর্ডে মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন তিনি। এরপর দীর্ঘদিন নগরীরর বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকে তার চিকিৎসা চলে। একপর্যায়ে ডাক্তাররা তাকে জানিয়ে দেন যে তার নিচের অংশ আর কোনদিন সচল হবেনা।
ডাক্তারের এমন কথায় উষাসহ তার পরিবারের সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
উষা বলেন, ‘স্কুলে সব সময় ভালো রেজাল্ট ছিল। সবার অনেক স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে। আমারও স্বপ্ন ছিল পড়া শেষ করে একটা ভালো চাকরি করে পরিবারের হাল ধরব। কিন্তু সব স্বপ্নই যেন ডাক্তারের কথায় চুরমার হয়ে গেল।’
তিনি জানান, কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর আমাকে যখন কলেজে আনা হয় তখন বাঁধে আরেক বিপত্তি। শিক্ষকরা আমাকে পড়াতে চাননি। তাদের মতে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী কাউকে কলেজে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যেসব উপকরন দরকার তা এখানে নেই।
এ কথা জানার পর সিআরপিতে চিকিৎসা নেওয়ার সময় পরিচিত ভেলরি টেলর ও আশ্রাফুন নাহার মিষ্টি এগিয়ে আসেন তার সাহায্যে। তারা তাকে সাহস দেন। কথা বলেন ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। সিআরপি থেকে কলেজে হোস্টেলে একটি প্রতিবন্ধী বান্ধব টয়লেট স্থাপন করে দেওয়া হয়। শুরু হয় আবার তার পড়াশুনা।
এদিকে মিতার গল্পটা উষার মত নয়। জন্মের পর মিতা ভালই ছিল। দু’বছর বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ পোলিও আক্রান্ত হয়ে পড়ে মিতা। এরপর থেকে আর হাঁটাচলা করতে পারেনি সে। একটু বড় হলে, মায়ের কোলে চড়েই স্কুলে যেত। পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত মায়ের সাথেই স্কুলে আসা-যাওয়া করার পর একটি রিজার্ভ ভ্যান রাখা হয় তাকে স্কুলে আনা-নেয়ার জন্য। আর সেই ভ্যানে চেপেই মিতা এমএ পাশ করেন কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ থেকে।
উষা এখন কিছুটা চিন্তিত। কারন তাকে হল ছেড়ে দিতে হবে। আর কর্মজীবি হোষ্টেলে তাদের মত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের থাকার কোন ব্যবস্থা নেই।
মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট মনোয়ারা হক বলেন, বাংলাদেশ এখন প্রতিবন্ধী-বান্ধব। এক সময় তো প্রতিবন্ধীদের কথা কেউ চিন্তাই করত না। অধিকাংশ মানুষই তাদেরকে ঘৃণার চোখে তাকাত। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই ধারনা থেকে সাধারন মানুষকে বের করে আনতে পেরেছেন। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এ ব্যপারে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
এই সরকার মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে প্রতিন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়। তারা সমাজের সম্পদ। শুধু প্রয়োজন একটু মমতা, ভালোবাসা আর দেখভাল। তাহলে তারাও হয়ে উঠতে পারে একেকটি সম্পদ হয়ে।
তিনি বলেন, প্রায় প্রতিজন প্রতিবন্ধীর মধ্যেই একধরনের প্রতিভা থাকে। একেক জন একেক কাজে পারদর্শী। কিন্তু আমরা অনেকেই তা বুঝতে পারিনা। কিন্তু যারা বুঝতে পারেন তাদের প্রতিবন্ধী সন্তান তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠে। তাই আমাদের সকলের উচিত সমাজের সকল প্রতিবন্ধীর সহায়তায় এগিয়ে আসা।
কর্মজীবি হোস্টেলে যাতে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীরা থাকতে পারে সে দিকে নজর দেয়া দরকার।