ঢাকা | শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১
শিশুদের কথাও ভাবছে না ওরা

পুরান ঢাকায় নকল প্রসাধনের দাপট চলছেই,

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০২০ ০১:১১

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০২০ ০১:১১

 

জব্দ করা নকল প্রসাধন জব্দ করা নকল প্রসাধন

পুরান ঢাকার অলিগলিতে এখনও তৈরি হচ্ছে নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল পণ্য। নকল পণ্য বানানোর জন্য গলিঘুপচিতে পাওয়া যাবে রাসায়নিকের অবৈধ গোডাউন। একদিকে যেমন প্রসাধন ব্যবহারকারীরা আছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে, তেমনি ভয়াবহ কোনও অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে আবার। পুরান ঢাকার এই নকল প্রসাধন সাম্রাজ্যের বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও প্রভাবশালীদের দাপটে বড় আকারের ব্যবস্থা নিতে পারছে না প্রশাসন।

নকল পণ্যের তালিকায় বাদ যায়নি শিশুদের ব্যবহার্য প্রসাধনও। নকল বিদেশি অয়েল, শ্যাম্পু, পাউডার সবই বিক্রি হচ্ছে দেদার। এসব ভেজাল পণ্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণও অনেক সময় বুঝতে পারেন না অভিভাবকরা। তাদের অভিযোগ, অন্তত শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে হলেও পুরান ঢাকার এই ভেজাল সাম্রাজ্য সমূলে উৎপাটনের উদ্যোগ নেওয়ার সময় হয়েছে।

বছরের পর বছর এই অবৈধ ব্যবসাকে `ঐতিহ্য’ হিসেবেই নিয়েছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। মাসের পর মাস অভিযানে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড দিয়েও কাজ হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, নকল ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

গত সপ্তাহে বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল শিশু প্রসাধন তৈরির অপরাধে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। দুই জনকে দিয়েছেন এক বছর করে কারাদণ্ড। জব্দ করেছেন জনসন অ্যান্ড জনসনের আদলে তৈরি মোড়কে বেবি লোশন, বেবি শ্যাম্পু, পাউডার, ইউনিলিভারের পন্ডস, ফেয়ার এন্ড লাভলিসহ ২৮ ধরনের নকল প্রসাধন সামগ্রী।

র‍্যাব সদর দফতরের তথ্য বলছে, দেশে ২০১৬ সাল থেকে ৩১ অক্টোবর ২০২০ সাল পর্যন্ত ভেজাল পণ্য সংক্রান্ত ৯১৭টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। প্রায় ৭০ ভাগ অভিযান হয়েছে রাজধানীতে। যার অর্ধেকের বেশি হয়েছে পুরান ঢাকায়। এই কয়েক বছরে চকবাজার, মৌলভিবাজার, লালবাগ, ইসলামবাগ, ইমামগঞ্জ ও নবাবপুর মিলে প্রায় ২০০টি নকল পণ্যের কারখানা বন্ধ করে সিলগালা করে দিয়েছেন র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানা করা হয়েছে সাড়ে ৮ কোটি টাকারও বেশি। যেখানে চার বছরে সারাদেশে র‍্যাবের অভিযান মোট জরিমানা করা হয়েছে ১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৯৬ হাজার ৩৩৯ টাকা।

র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদামের মতোই ভয়ংকর এ নকল পণ্য ও অবৈধ কারখানাগুলো। এদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযান চালানো হয়েছে। কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জামিনে বের হয়ে আবার তারা আগের ব্যবসায় ফিরে যায়।’

অভিযান সংশ্লিষ্ট র‍্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, পরিত্যক্ত মোড়ক ও কৌটাতে নকল প্রসাধনী ঢুকিয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে তারা। তাছাড়া অবৈধ পথে ভারত, চীন, মালয়েশিয়া থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে ব্র্যান্ডের প্যাকেট, কৌটা আর বাহারি মোড়কে ভেজাল প্রসাধনী ভরে বিক্রি করা হচ্ছে আসল দামে।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, পুরান ঢাকার নকল পণ্যের এ পসরা অনেকটা ওপেন সিক্রেট। অজ্ঞাত কারণে এদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তবে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় ভেজাল পণ্যের সিন্ডিকেট কাজ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। তারা পাচ্ছেন প্রতিমাসে কোটি টাকার মাসোহারা। বিপরীতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক ভোক্তারা।

র‍্যাব ম্যাজিস্ট্রেটের সারওয়ার আলমের মতে, ‘পুরান ঢাকা বিশেষ করে চকবাজার-মিটফোর্ড এলাকার অলিগলিতে  নকল প্রসাধনী, নকল ওষুধ, নকল ইলেকট্রিক সরঞ্জাম, অবৈধ পলিথিনের কারখানা। আবার এগুলোতেই কাঁচামাল হিসেবে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুত আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বসতবাড়িতেই এসব রাসায়নিকের গুদাম। অবৈধ কারখানাগুলো চলছে স্থানীয় প্রভাবশালী ও বাড়ির মালিকের ছত্রছায়ায়। প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করে এই ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বাড়ির মালিকদের দ্বিগুণ ভাড়া দেন। তাই অভিযানে বাড়ির মালিকদেরকেও জবাবদিহিতায় আনা হয়।’

নকল প্রসাধন নকল প্রসাধন

র‍্যাব গোয়েন্দা ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় চার শতাধিক নকল প্রসাধন সামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে। যার মধ্যে পুরান ঢাকাতেই আছে সিংহভাগ।

সরেজমিনে দেখা যায় মৌলভি বাজারের হাজী হাবিবুল্লাহ মার্কেটের সব দোকানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যান্ডের প্রসাধনীতে ঠাসা। সাবান, শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, ক্রিম, লোশন, পাউডার, শ্যাম্পু, তেলসহ ৭০-৮০ ধরনের নকল প্রসাধনী দেখা গেছে এখানে।

বউ সাজ স্টোরের বিক্রয়কর্মী জামিল হোসেন বলেন, আমাদের দোকানে প্রায় ৫০টি আইটেম আছে। সব বাইরের। আমাদের এখান থেকে দিনে ৪০-৫০ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি হয়।

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে চকবাজারে নকল প্রসাধনী তৈরির চারটি কারখানা ও ছয়টি গোডাউন সিলগালা করে দেওয়া হয়। কাউকে আটক না করলেও বিক্রির অভিযোগে আট দোকান মালিককে সাড়ে ৪৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বউ সাজ’ও ছিল ওই তালিকায়।

চকবাজার ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একের পর এক অভিযানের ফলে সমিতির পক্ষ থেকে নকল পণ্য উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের কড়াভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু টাকার লোভে তারা থামছে না। একবার বন্ধ করা হলে ধাপে ধাপে টাকা দিয়ে নতুন করে আবার কারখানা খুলে বসে। নকল পণ্যের বাজার অনেক বড়। মাস গেলে এদের মধ্যে হাতবদল হয় শত কোটি টাকা।   

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) পরিচালক সাজ্জাদুল বারী বলেন, আমাদের আওতাধীন ১৮১টি বাধ্যতামূলক পণ্যের বিষয়েই আমরা মান যাচাই করি। নকল ও ভেজাল কসমেটিকসের পাশাপাশি ভেজাল খাদ্য নিয়েও বিএসটিআই নিয়মিত কাজ করছে।

পুলিশের লালবাগ বিভাগ বলছে, নকল প্রসাধনী তৈরিতে যেসব ব্যবসায়ী জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিএসটিআইর সহায়তায় পুলিশ অভিযান চালায়।পুরান ঢাকায় নকল পণ্যের খোঁজ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। 

Banglatribune



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: