এই উত্তর খোঁজার জন্য আমরা প্রথমেই দুজন মহিলার অভিজ্ঞতা শুনে নেব, যাঁরা কখনও না কখনও অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। নারী পুরুষ নির্বিশেষে কেন পরকীয়া করার প্রবণতা রয়েছে, তার উত্তরে শুনব বিশেষজ্ঞের মতামত। নারীদের মধ্যেই কি পরকীয়া করার প্রবণতা বেশি? উত্তর খুঁজব সমীক্ষায়।
অভিজ্ঞতা ১:
“আমার স্বামী তাঁর সেক্রেটারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। আমায় ঠকিয়েছিলেন। আমিও সে সময় ভাবি, আমি আর ভালো স্ত্রী হতে চাই না। কারণ সে আমার সব বিশ্বাস নষ্ট করেছে। আমিও অন্য় পুরুষের সঙ্গে ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড’ করি। সত্যি বলতে, আমার তার জন্য় কোনও অনুতাপ নেই। অনেক দোষারোপ হয়েছে, চোখের জল বয়েছে। আমরা আবার এগিয়ে গিয়েছি। ”
অভিজ্ঞতা ২:
“আমার স্বামী এবং আমি দুজনের মতো কাজ করছি। তবে হ্যাঁ, একবার আমি ওকে ঠকিয়েছিলাম। সেই সময় আমি বিজনেস ট্রিপে ছিলাম। সে সময় আমি অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি। সত্যি বলতে, এখন তাঁর জন্য সেরকম ভালোবাসাও আমি অনুভব করি না। কিন্তু আমার সন্তানের কথা ভাবতে হয় আমায়। আমি থাকতে চাই আমার সন্তানের কথা ভেব। তিনি আমার সন্তানের বাবা। আমার সন্তান ভাঙা পরিবারে বড় হোক, আমি তা চাই না। ”
আকাঙ্খা, ৩২ বছর
চটজলদি পরিতৃপ্তি পাওয়া
সল্টলেক মাইন্ডসেটের ডিরেক্টর বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেবাঞ্জন পানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম আমরা। তিনি কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। আসলে প্রতারণা বা ঠকানোর প্রবণতা স্বামী ও স্ত্রী দুজনের মধ্যে আছে। এই কারণে স্বামী বা স্ত্রী তাঁর সঙ্গীকে জীবনের কোনও এক সময়ে গিয়ে ঠকাতে পারেন।
চিকিৎসক দেবাঞ্জন পানের মতে, তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি পাওয়ার আকাঙ্খা খুবই খারাপ। ইদানীং বিষয়টি বাড়ছে বলে মনে করছেন চিকিৎসক দেবাঞ্জনবাবু। কারণ এখন মানুষ চটজলদি পরিতৃপ্তি পেতে চান। অর্থাৎ, যে সম্পর্কে আমার আরও এফর্ট দেওয়ার প্রয়োজন, তাতে এফর্ট দেওয়ার কথা ভাবছি না। বদলে অন্য কারও থেকে পরিতৃপ্তি খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছি আমরা।
তা শারীরিক বা মানসিক হতে পারে। সবসময় শারীরিক ঘনিষ্ঠতাই হবে, তার অর্থ নেই। বরং মানিসক শান্তি পাওয়ার প্রবণতাও অনেকের মধ্যে থেকে যায়। ঠিক একই কারণে রান্না করে খাওয়ার পরিবর্তে ইনস্ট্যান্ট ফুড পছন্দ করি আমরা। শ্রম না দিয়েই পরিতৃপ্তি পাওয়ার বেশি ইচ্ছে। কারণ, আমরা কষ্ট করতে চাইছি না। এখানেই লুকিয়ে সর্বনাশের ভয়ঙ্কর বীজ।
সম্পর্কের প্রয়োজন সময় ও এফর্ট
দাম্পত্য কি খুব সহজেই পালন করা সম্ভব? আপনি কি মনে করেন? আসলে সম্পর্কের তো নানা ধাপ থাকে। প্রথমে দুজন মানুষ দুইজনের প্রতি আকর্ষিত হন। সেই সময় আমাদের অনুভূতিগুলো অ্যাড্রিনালিন হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। কিন্তু এই স্টেজ খুব বেশিদিন থাকে না।
তাই এই দাম্পত্য মজবুত করার জন্য আমাদের এফর্ট দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের জীবন যে এখন খুব বেশি আমিত্বে ভরপুর। নিজের উপরে গিয়ে ভাবতে পারি কি?
তাই বৈবাহিক সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের থেকে যা দাবি করেন, তা পরিপূরণ হয় না।কিন্তু আমরা সে দিকে মন দেওয়ার কথা ভাবিও না। সেই সময়ে মনের মধ্য়ে অন্য ভাবনা আসতে শুরু করে। যে সম্পর্কে আমরা আছি, তাকে মজবুত করার চেয়ে আমরা তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করি। মূল্যবোধের শিক্ষা ছোট থেকে না থাকলে এই ভুল বেশি হওয়ার প্রবণতা থাকে।
মানুষ স্বভাবে বহুগামী
চিকিৎসক দেবাঞ্জন পানের মতে, মানুষ স্বভাবে বহুগামী(Polygamous)। আদিমযুগে পশুর মতোই আচরণ করত। এক মানুষের একাধিক সঙ্গমসঙ্গী থাকতে পারত। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর চরিত্রে পরিবর্তন হয়। মানুষের মস্তিষ্ক উন্নত হয়। সেই কারণেই আজ আমরা এতটা উন্নত। আমাদের মস্তিষ্কের সামনের অংশে রয়েছে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স। যা প্রাথমিকভাবে আমাদের নীতিবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে। কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমাদের বিচক্ষণ হতে সাহায্য করে। তাই এখন মানুষ সম্পর্কের মূল্যবোধ দিতে শিখেছেন।
একজন সঙ্গীর প্রতি লয়্যাল থাকতে শিখেছেন। কিন্তু স্বভাবগত দিক থেকে তো তাঁর কোনও পরিবর্তন হয়নি। একজন মানুষ সারাজীবন এক সঙ্গীর সঙ্গে থাকতে পারেন। কিন্তু বিচক্ষণতার অভাবে যখন তাঁর প্রাকৃতিক চরিত্র তাঁকে ডমিনেট করে, সেই সময়েই অন্য মানুষের প্রতি দুর্বল হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থেকে যায়। মানুষ সঙ্গীকে ঠকায়। তাই আমি সঙ্গীকে প্রতারণা করব নাকি সম্পর্কে লয়্যাল থাকব, এটি আমাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকে।
একাধিক অপশন, ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড
চিকিৎসক দেবাঞ্জন পানের মতে, বৈবাহিক বা রোম্যান্টিক সম্পর্ক তিনটি ধাপের মধ্য়ে দিয়ে যায়। প্রথমদিকে একে অপেরর প্রতি দুই সঙ্গীর একটি আকর্ষণ কাজ করে। শারীরিক ও মানসিক পরিতৃপ্তি পান বিপরীতের মানুষের থেকে। এই ধাপে অ্যাড্রিনালিন হরমোন কার্যকরী হয় বেশি। এরপর ধীরে ধীরে সঙ্গীর প্রতি আমাদের চাহিদা তৈরি হয়। তা শারীরিক ও মানসিক হতে পারে। এই সময়ে সঙ্গী যদি আমাদের মন ভালো রাখতে পারেন, তাহলে সঙ্গীর প্রতি আরও বেশি আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। এই ধাপে ডোপামিন হরমোনের কার্যকারিতা থাকে বেশি।
তবে সারাজীবন সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য সম্পর্কে এফর্ট দেওয়ার প্রয়োজন অনেক বেশি। এই ধাপে অক্সিটোসিন হরমোন প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। একে অপরের সঙ্গে বাঁধন মজবুত করার জন্য এই হরমোন খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ঠিক এই সময়েই আমরা বাঁধন মজবুত করার চেষ্টা করি না। সম্পর্কে শ্রম কম দিই ও তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তির দিকে ছুটি। আমাদের কাছে এখন অপশন অনেক বেশি। কয়েক দশক আগেও মানুষ যেরকম জীবন ভাবতে পারতেন না।
এখন ঠকানোর প্রবণতা বেশি কারণ আমাদের কাছে অপশনও অনেক বেশি। আগে মানুষের সামনে এই ভার্চুয়াল দুনিয়া খুলে যায়নি। এখন ভার্চুয়াল বিশ্বে অপশনের পর অপশন। তাহলে আমি একটি সম্পর্কেই মজবুত করার চেষ্টা করব কেন?
গ্লিডেন অ্যাপ ফ্রান্সে লঞ্চ করে ২০০৯ সালে। তা ভারতে আসে ২০১৭ সালে। এই অ্যাপের ভারতীয় ব্যবহারকারীদের ৩০ শতাংশই মহিলা। যাঁদের বয়স ৩৪ থেকে ৪৯ বছর পর্যন্ত। এই অ্যাপের তরফে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। যেখানে উঠে আসে এরকম তথ্য।
ভারতে ১০জনের মধ্য়ে ৭জন মহিলাই তাঁদের স্বামীকে ঠকিয়েছেন। কারণ, তাঁরা বাড়ির কোনও কাজে সাহায্য করেন না। কারও কারও ক্ষেত্রে বিবাহিত জীবন একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। তাই তাঁরা পরকীয়া সম্পর্ক করেছেন। এক্সট্রা-ম্যারিটাল ডেটিং অ্যাপের সমীক্ষা থেকে এরকম তথ্যই উঠে এসেছে। এই অ্যাপে ৫ লাখ ভারতীয় ব্যবহারকারী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২০ শতাংশ পুরুষ এবং ১৩ শতাংশ মহিলাই স্বীকার করেছেন তাঁরা তাঁদের সঙ্গীকে ঠকিয়েছেন
সংগৃহীত
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: