
তকমিনার কাছে তার মায়ের মুখখানি ছায়ার মতন। ক্ষুধার যন্ত্রণায় যখন তার পেট জ্বলে, ভাত পায় না, তখন মায়ের কথা মনে পড়ে। সৎমায়ের কাছ থেকে ভাত পেলেও যখন তা লবণ, মরিচ বা শুঁটকি দিয়ে খেতে হয়, তখন নিজের মাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছা করে।
দিনের আলো ফোটার পর যখন হাওরের বিপুল জলরাশির মধ্যে দিয়ে তকমিনার বান্ধবীরা রোজ নৌকায় করে স্কুলে যায়, তা দেখে তার মন বেদনায় ভরে ওঠে। খাতা, কলম, পেনসিল না থাকার জন্য তার স্কুলে যাওয়া হয় না। স্কুলে যেতে না পেরে তার মধ্যে হাহাকার জাগে। রাতে এই হাহাকার মিলিয়ে যায়। তকমিনার মনে ভর করে ভয়।
রাতে হাওরে ঢেউ খেলা করে। বড় বড় ঢেউ। ঢেউ বাড়লে তকমিনা গুটিয়ে যায়। মনে মনে ভাবে, এই বুঝি ঢেউ তাদের ঘরবাড়ি নিয়ে গেল! ঢেউয়ের ছোবলে হারিয়ে গেল সে!
১০ বছরের ছোট্ট কিশোরী তকমিনার দিন এভাবেই কাটে। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বরম হাওরের বাসিন্দা সে। গ্রামের নাম তলবাউস, যা ‘তলবাউস আঁটি’ নাম পরিচিত। গ্রামটি তারল ইউনিয়নে অবস্থিত। ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছাড়া সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে এই হাওরের অবস্থান।
নিজেদের ঘরের দরজায় ১০ বছরের কিশোরী তকমিনা।
তকমিনার মায়ের নাম বদরুন্নেসা। বেশ আগে বাবার কাছে তকমিনাকে রেখে তার মা চলে গেছেন। আর মায়ের দেখা পায়নি সে। তবে তার কাছে মায়ের ছবি আছে। ছবি দেখেই মাকে অনুভব করে তকমিনা। শুনেছে, মা নতুন সংসার পেতেছেন।
বদরুন্নেসা চলে যাওয়ার পর তকমিনার বাবা মো. বিল্লাল হোসেন ফের বিয়ে করেন। সৎমা আসেন ঘরে। তকমিনা বিপদে পড়ে। সৎমায়ের কাছ থেকে আদর-ভালোবাসা পায় না সে। তাকে বড় করেন দাদা-দাদি, চাচা-চাচিরা।
তকমিনার বাবা বিল্লাল অন্য সবার মতো হাওরে মাছ ধরে সংসার চালান। আবার হাওরের জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষও করেন। এভাবেই কোনো রকমে তাদের সংসার চলে।
এবার বিল্লাল দুই বিঘা (স্থানীয় ভাষায় খের) জমিতে ধান লাগান। ঋণ করেন ৫০ হাজার টাকা। তবে গেল চৈত্র মাসে অন্য সব হাওরের মতো বরম হাওর তলিয়ে যায়। এখন বিল্লালের ভরসা হাওরের মাছ।
বাবা মো. বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে তকমিনা।
তকমিনাকে তার বাবা ভালোবাসেন। কিন্তু সৎমা একদমই দেখতে পারেন না। বাবা ঘরে থাকলে সৎমা ভাত দেন। কিন্তু বাবা ঘরে না থাকলে তার কপালে শনি নামে। সৎমা রান্নাঘরে পর্যন্ত যেতে দেন না। কারণে-অকারণে বকাঝকা করেন। মারধর করেন। তখন তাকে চাচার ঘরে গিয়ে খেতে হয়। তখন তকমিনা ভাবে, নিজের মা থাকলে হয়তো তার কপালে এমন আচরণ জুটত না। নিজের অজান্তে তার দুচোখ ভেঙে কান্না নামে।
বিল্লাল একটু সহজ-সরল ধরনের। এ জন্য লোকজন তাঁকে খোটা মারে। অন্যদের মতো কাজে ততটা পারদর্শী নন তিনি। নিজেও তা স্বীকার করেন।
অন্যের বাবারা মাছ ধরে অনেক আয় করে। ছেলেমেয়েদের জন্য বাজার থেকে ভালো ভালো জিনিস আনেন। তকমিনার বাবা তা পারেন না। বিল্লালের আয়-রোজগার কম। তার ওপর এবার ফসল মার খেয়েছে। মাছও কম পাচ্ছেন। প্রায় সময় তাঁর ঘরে চাল থাকে না। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চাল ধার করেন। তরকারি না থাকায় গেল চৈত্র মাস থেকে লবণ, মরিচ, সিদল (মাছের একধরনের শুঁটকি) দিয়ে চটকিয়ে ভাত খেতে হয় তকমিনাদের। অবশ্য মাঝেমধ্যে পাতে মাছ থাকে। গত রোজার ঈদে সবশেষ গোশত খেয়েছে পরিবারটি।
হাওরের ঢেউয়ে তকমিনাদের গ্রাম ভাঙতে ভাঙতে ছোট হয়ে গেছে।
তকমিনার একজন চাচা আছেন। তিনি তাকে খুব ভালোবাসে। যখন সৎমা তকমিনাকে খাবার দিতেন না, তখন সেই চাচা বলেছিলেন, ভিক্ষা করে হলেও তাকে (তকমিনা) খাওয়াবে। লেখাপড়া করাবে। কিন্তু তার চাচা এখন হাসপাতালে। ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন তিনি। ঋণ করে চাচার চিকিৎসা চলছে। কিন্তু ভালো হচ্ছেন না। তকমিনা ভাবে, আজ চাচা ভালো থাকলে তার লেখাপড়া বন্ধ হতো না। এখন সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত।
দুই বছর হয়ে গেল, তকমিনার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। তার খাতা-কলম-পেনসিল নেই। নৌকায় করে স্কুলে যেতে যে টাকা দরকার, তা দেওয়ার সামর্থ্য তার বাবার নেই। হাওরের গ্রামগুলোর চারদিকে এখন অথই পানি। যোগাযোগের মাধ্যম কেবলই নৌকা।
তকমিনার খেলার সাথিরা স্কুলে যায়। তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে স্কুলে যাবে কি না?
তকমিনাদের গ্রামের টিউবওয়েলটি যেকোনো সময় হাওরে হারিয়ে যেতে পারে।
বাবাকে তকমিনা অনেক দিন বলেছে, সে স্কুলে যাবে। জবাবে বাবা বলেছেন, কদিন যাক, তারপরই তাকে স্কুলে পাঠাবে।
প্রথম প্রথম বাবার কথা বিশ্বাস করে তকমিনা। পরে বুঝে যায়, বাবা তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে।
স্কুলে যাওয়ার জন্য তকমিনার মন কাঁদে। তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে নৌকায় করে অন্য ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। তকমিনা ঠায় বসে থাকে। ঘরে এসে কাঁদে। তকমিনা বলে, ‘খাইলে খাইলাম, না খাইলে না খাইলাম, কিন্তু স্কুলে যামু।’
তকমিনাদের গ্রামের ঘরবাড়ি হাওরে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
মাস পাঁচেক আগে সানজিদা (৫) নামের একটি মেয়ে হাওরের পানিতে পড়ে মারা যায়। নিজের গ্রামের সেই মেয়েটিকে কোনোভাবেই ভুলতে পারে না তকমিনা। মেয়েটির বাবা-মায়ের আহাজারি এখনো তকমিনাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
আগে তকমিনাদের গ্রামের আয়তন (আঁটি) বড় ছিল। প্রতিবছর হাওরের ঢেউয়ে (স্থানীয়রা বলে আফাল) তাদের গ্রাম ভাঙছে। গতকাল শনিবার দেখা গেল, তকমিনাদের আঁটির পূর্ব-দক্ষিণ পাশ ঢেউয়ের কবলে পড়েছে। তাদের টিউবওয়েলটি যেকোনো সময় হাওরে হারিয়ে যেতে পারে। ঘরবাড়িও ঝুঁকির মধ্যে আছে।
তকমিনা জানাল, আঁটি ভাঙতে ভাঙতে একেবারই ছোট হয়ে গেছে। ঘরের সামনেই চলে এসেছে হাওর। তাদের বাড়ির সামনের অংশ আগে বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল। কিন্তু তা হাওরের ঢেউ নিয়ে গেছে। এখন তার পরিবারের সদস্যরা রাতদিন পাহারা দেয়। সবাই ভয়ে থাকে, কখন বাড়িঘর চলে যায়!
আতঙ্কে রাতে তকমিনার ঘুম আসে না। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে। রাতের অন্ধকারে যদি হাওরের ঢেউ এসে তাদের ঘরবাড়ি নিয়ে যায়, তখন কী হবে?
প্রায় দিন বাবা-চাচাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে তকমিনার ঘুম ভাঙে। জোরে জোরে তাঁরা বলতে থাকেন, ‘ওঠো ওঠো, আফাল আইছে। বাঁশ-খুঁটি যা আছে, সব নিয়া আস।’
তকমিনাদের গ্রাম থেকে অনেকে ভয়ে চলে গেছে। যারা এখনো আছে, তারাও অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভাবছে। বাসিন্দাদের ভাষ্য, কখন কী হয়, তা কেউ বলতে পারে না।
তকমিনা বলে, ‘যারাত টাকা আছে, হেরা আঁটি ছেড়ে যাইতাছে। আমাগো টাকা নাই, তাই থাকতাছি। আফাল আইলে ভয় লাগে। ভয়ে ঘুম আয় না। যেহানে আফাল নাই, সেই হানে একখানা ঘর চাইমু। শান্তিতে ঘুমাইমু।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: