সাঁতার দিচ্ছেন ক্ষিতীন্দ্র বৈশ্য।
মানুষটি সাঁতার শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে চলছে দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও একটি ডিঙি। তাতে দুই শতাধিক উৎসুক জনতা সার্বক্ষণিক তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখছেন। নৌকায় গান বাজছে, সঙ্গে বাদ্যের তাল। তিনি সাঁতার কাটছেন। তাঁর ক্লান্তি এড়াতেই এই বাজনার আয়োজন। আর যাতে তিনি দুর্বল না হন, সে জন্য তরল খাবার দেওয়া হচ্ছে। এভাবে নদীপথে পার হলো পাঁচটি উপজেলা। গন্তব্যে আসার পথে বিভিন্ন স্থানে নদীর দুই তীরে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষ। তাঁরা বিরামহীন সাঁতারের দৃশ্য দেখছিলেন। এ সময় হাত নেড়ে উৎসুক জনতার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন সাঁতারু।
সাঁতারুর নাম ক্ষিতীন্দ্র বৈশ্য। বয়স ৬৫। পরোয়া নেই তাতে। ময়মনসিংহের ফুলপুরের কংস নদী থেকে শুরু করে নেত্রকোনার মদন উপজেলার মগড়া নদীতে গিয়ে শেষ হয় তাঁর যাত্রা। করলেন নিজস্ব রেকর্ড। এ পথ ১৪৬ কিলোমিটার বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে ফুলপুরের সরচাপুর সেতুসংলগ্ন এলাকা থেকে সাঁতার শুরু হয়। ৪৩ ঘণ্টা পর আজ রোববার দুপুর ১টা ৫০ তা শেষ হয় নেত্রকোনার মদন উপজেলা সদরের মগড়া নদীর সেতুর কাছে। ক্ষিতীন্দ্র বৈশ্য বললেন, ‘আমি একটি রেকর্ড করতে চাই। আর এটা প্রমাণ করতে চাই, বয়স কোনো বিষয় না। চেষ্টা থাকলে সবই সম্ভব।’
এই অদম্য মানুষটির বাড়ি নেত্রকোনার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের এএনএস কনসালট্যান্ট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি পাস করেন। সাঁতার কেটে এ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে চারটি পুরস্কার পেয়েছেন।
কীভাবে সাঁতারের প্রতি ক্ষিতীন্দ্রর এই ঝোঁক তৈরি হলো? জানালেন, ১৯৭০ সালে সিলেটের ধুপাদীঘি পুকুরে অরুণ কুমার নন্দীর বিরামহীন ৩০ ঘণ্টার সাঁতার প্রদর্শনী দেখে ক্ষিতীন্দ্র উদ্বুদ্ধ হন। পরে একই বছর মদনের জাহাঙ্গীরপুর উন্নয়ন কেন্দ্রের পুকুরে তিনি ১৫ ঘণ্টার সাঁতার প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে আলোচিত হন। এটিই তাঁর প্রথম সাঁতার প্রদর্শনী। পরে ১৯৭২ সালে সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশন পুকুরে ৩৪ ঘণ্টা, সুনামগঞ্জের সরকারি হাইস্কুলের পুকুরে ৪৩ ঘণ্টা, ১৯৭৩ সালে ছাতক হাইস্কুলের পুকুরে ৬০ ঘণ্টা, সিলেটের এমসি কলেজের পুকুরে ৮২ ঘণ্টা এবং ১৯৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পুকুরে ৯৩ ঘণ্টা ১১ মিনিট বিরামহীন সাঁতার প্রদর্শন করে জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করেন। জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করায় ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ডাকসুর উদ্যোগে ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি জগন্নাথ হলের পুকুরে ১০৮ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার প্রদর্শন করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের পুকুরের পাড়ে একটি স্মারক ফলক নির্মাণ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ঢাকা স্টেডিয়ামের সুইমিং পুল, মদন উপজেলা পরিষদের পুকুর এবং নেত্রকোনা পৌরসভার পুকুরে তাঁর একাধিক সাঁতার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতেও দূরপাল্লার সাঁতার প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন ক্ষিতীন্দ্র। ১৯৮০ সালে মাত্র ১২ ঘণ্টা ২৮ মিনিটে মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদীর জঙ্গীপুর ঘাট থেকে গোদাবরী ঘাট পর্যন্ত ৭৪ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দেন। সাঁতার প্রদর্শনী ও রেকর্ড সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণভবনে তাঁকে রুপার নৌকা উপহার দেন। একই বছর ডাকসু তাঁকে বিশেষ সম্মানসূচক স্বর্ণপদক দেয়।
ক্ষিতীন্দ্র বৈশ্যর চাচাতো ভাই বিমান বৈশ্য বললেন, ‘দাদা আগে বলেছিলেন এই সাঁতার তাঁর শেষ সাঁতার হবে। এখন সফলতার পর দাদা আরও বেশি পথ সাঁতরাতে চান।’
আজও যখন মগড়া সেতুতে সাঁতার শেষ করেন ক্ষিতীন্দ্র, তখন তাঁকে স্বাগত জানাতে ছিলেন মদনের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ওয়ালীউল হাসান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম আকন্দ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কদ্দুছসহ নানা শ্রেণি-পেশার হাজারো মানুষ। এ সময় নদীর তীরে অপেক্ষমাণ কয়েক হাজার লোক করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করেন। তাঁর সাঁতার প্রদর্শনী উপলক্ষে গতকাল মদন পৌর শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি ঘোষণা করা হয়। সাঁতার শেষ হওয়ার পর ক্ষিতীন্দ্র বৈশ্যকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরীক্ষার পর চিকিৎসক জানান তিনি স্বাভাবিক রয়েছেন।
এটি কী রেকর্ড: ক্ষিতীন্দ্র বৈশ্য ১৪৬ কিলোমিটার সাঁতরেছেন বলে তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করেছেন। তাঁর বয়স এবং দৈর্ঘ্যের বিবেচনা করলে ক্ষিতীন্দ্র বৈশ্যের এই সাঁতার কী তবে রেকর্ড হিসেবে গণ্য হবে? এ বিষয়ে জাতীয় সাঁতার ফেডারেশনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এম বি সাইফ বলেন, ‘আমাদের দেশে দূরপাল্লার সাঁতার সর্বোচ্চ ১৫ কিলোমিটার। জানামতে, এ অঞ্চলে সর্বোচ্চ ভারতের মুর্শিদাবাদে ৮১ কিলোমিটার হয়। আমাদের দেশের শরিফুল ইসলাম গত বছর এ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হন। এম বি সাইফ বলেন, ক্ষিতীন্দ্র বৈশ্য এ সাঁতার পর্যবেক্ষণ করার জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে অনুরোধ করেছিলেন। তবে পরিষদ সেই আবেদন গ্রহণ করেনি বলে জানি।’নদীর পাড়ে হাজারো মানুষের ভিড়।
এ বিষয়ে মদনের ইউএনও মো. ওয়ালীউল হাসান আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বয়সের কথা বিবেচনা করে ক্রীড়া পরিষদ রাজি হয়নি বলে জানি। এরপর ক্ষিতীন্দ্র বৈশ্য নিজেই এ উদ্যোগ নেন। আমরা প্রশাসনিকভাবে সহযোগিতা করেছি।’
ইউএনও ওয়ালীউল হাসান গুগল ম্যাপ ডেটায় ফুলপুর থেকে মদনের দূরত্বের একটি হিসাব তুলে ধরেন। এটি আয়োজকেরা তাঁকে দিয়েছেন বলে জানান। সেই হিসাবে দেখা যায় ক্ষিতীন্দ্র বৈশ্য মোট ১৪৫ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার পথ সাঁতরেছেন।
সাঁতারে দূরত্বের বিষয়ে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক মো. মুশফিকুর রহমান আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দূরত্বটা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। খোঁজখবর নিচ্ছি। তবে যে দূরত্বের কথা বলা হয়েছে, তা এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: