
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে লেখকের সেলফি
কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি নৃত্যে স্নাতকোত্তর পড়ছি। এখানে পড়ার স্বপ্নটা কি আমার ছিল, নাকি আমার মায়ের (আরজুমান্দ আরা বকুল), সেটা এখন আর মনে করতে পারি না। হয়তো দুজনের স্বপ্নটাই মিলেমিশে এক হয়েছে। ইংরেজি ভাষাতত্ত্ব নিয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেছি। একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর করে ৯টা থেকে ৫টা স্কুলে পড়ানো—আমার গল্পটাও হয়তো এমনই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎই ‘পারস্যু ইওর ড্রিম’ (স্বপ্নের পেছনে ছোটো), এই ‘বোকা বোকা’ কথাটা মাথায় ভর করল। নৃত্যে আমার স্রষ্টাপ্রদত্ত প্রেম আর মায়ের সূত্রে পাওয়া রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা—এই দুই এক করে স্বপ্নপূরণে উঠে পড়ে লাগলাম।
স্বপ্নটা এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল আইসিসিআর (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস)। প্রতিবছর ভারতে পড়ার জন্য একটা বৃত্তি দেয় তারা। সেই বৃত্তি কী করে যে পেলাম, পেছনে ফিরে দিনগুলো মনে করলে এখন রূপকথার মতো লাগে। পুরো এক বছর গোঁ ধরে বসেছিলাম। এমনকি ইংরেজিতে স্নাতকোত্তরের ভর্তি ফরমটাও তুলিনি। পাছে যদি আমার রবীন্দ্রভারতীতে আসা না হয়!
২০১৬ সালের ২ আগস্ট বেলা আড়াইটার দিকে আমি আর মা একসঙ্গে রবীন্দ্রভারতীর বিটি রোড ক্যাম্পাসে পা রেখেছিলাম। উত্তেজনায়, আনন্দে আমরা দুজন কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ঢুকতেই কানে ভেসে এল রবীন্দ্রসংগীতের সুর, সামনেই গুরুদেবের প্রতিকৃতি। আমাদের ক্যাম্পাসে সারা দিন, সারা বেলা, সারা বছর গুরুদেবের গান ভাসে। বাইরের জগৎ থেকে সে জন্যই এই জগৎটা একদম আলাদা।
বেশ খানিকটা হেঁটে আমাকে আমার ডিপার্টমেন্টের ভবনে পৌঁছাতে হয়। কিন্তু এই পথচলায় কখনো ক্লান্তি লাগে না। পাথুরিয়াঘাটার হরকুমার ঠাকুরের বংশধর সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের নির্মিত একটা ঐতিহাসিক দালান আমাদের ক্যাম্পাসের অংশ। এখানে ১৮৭৩ সালে হিন্দু কলেজের পুনর্মিলনী উপলক্ষে বালক রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন (দালানটি এখন দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত হয়)। বিভিন্ন সময় যেকোনো ছুতোয় আমি ওই দালানে চলে যাই। হাতড়ে দেখি দরজাগুলো, সিঁড়ির হাতলগুলো।
২০০৪ সাল থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আর কোনো ক্লাস হয় না। তবে কবির জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকীর মতো বিশেষ দিনগুলোয় আমরা রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রছাত্রীরা অনুষ্ঠানে নৃত্যগীত পরিবেশন করি। কবিগুরু ছাড়া কোনো উদ্যাপন এখানে ভাবাই যায় না। ২২ শ্রাবণ উপলক্ষে সবাই মিলে ভোরবেলা জোড়াসাঁকো যাওয়া হবে। কবিকে পুষ্পার্ঘ্য দেওয়া হবে। নবকিরণের সঙ্গে শুরু হবে তাঁকে উদ্দেশ করে গান। রবীন্দ্রসংগীত অনুষদের শিক্ষার্থীদের সমবেত গান দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হবে। থাকবে তাঁকে নিয়ে আর তাঁর লেখা নিয়ে বিশিষ্টজনদের গান, আবৃত্তি ও প্রবন্ধপাঠ। এই পরিবেশ অন্য রকম। আমি এর অংশ হতে পারছি ভেবে ভালো লাগে, আবার মন খারাপও হয় এই ভেবে যে এখানে আর খুব বেশি দিন থাকা হবে না।
অনেকেই প্রশ্ন করে, ভরতনাট্যমের জন্য কলকাতা কেন অথবা রবীন্দ্রভারতী কেন? আমি বলি নাচ আমার প্রেম, আমার উপাস্য। আর রবীন্দ্রনাথ আমার ক্ষুধা নিবারক। এই দুটোর সমন্বয় রবীন্দ্রভারতী ছাড়া আর কোথায় পেতাম! সারা জীবন ক্লাসে আনমনে নেচে উঠেছি যখন, তখন শিক্ষকের কড়া চাহনি আমাকে নিরস্ত করেছে। আর এখন আমি ক্লাসে নাচি, এখানে বরং না নাচলে বকুনি খেতে হয়! আজ আমি নাচ নিয়ে পড়ি, পরীক্ষা দিই, নাচ নিয়ে লিখে পরীক্ষার খাতা ভরাই।
আমরা নন্দনতত্ত্ব পড়ি, যেখানে রবীন্দ্রনাথের কথাই ঘুরেফিরে আসে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সিলেবাসেই একটা বড় জায়গা দখল করে আছেন। তাঁকে নিয়ে পড়তে হয়, ভাবতে হয়, তাঁর লেখায় নৃত্যপরিকল্পনা করতে হয়। আমাদের নৃত্য অনুষদে আলাদা করে রবীন্দ্রনৃত্য বলে একটা স্বতন্ত্র বিভাগের সূচনা হয়েছে। এই বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করবেন শিক্ষার্থীরা। রবিঠাকুরের সুরের মূর্ছনায় মোহিত হয়ে, রবীন্দ্রসংগীত বিভাগে পড়ার জন্য প্রচুর শিক্ষার্থী এসেছে দেশ-বিদেশ থেকে। আমি ভেবেছিলাম একলা আমিই হয়তো হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে, রবীন্দ্রভারতীতে নাচ নিয়ে পড়ব বলে একগুঁয়েমি করে কলকাতায় চলে এসেছি। কিন্তু এখানে আসার পর দেখলাম আমার দল বেশ ভারী। ‘আমার মুক্তির আলোয় আলোয়’ উদ্ভাসিত হতে বহু শিক্ষার্থী এখানে জড়ো হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এই দিনে চলে গেছেন বলে আমরা ২২ শ্রাবণ পালন করি না। বরং রবীন্দ্রনাথ এখনো আছেন বলেই প্রতিবছর আমাদের জীবনে ২২ শ্রাবণটা একটা বিশেষ দিন হয়ে আসে!
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: