লেখক: আ ব ম ফারুক : সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা বিশ্বের রাজনীতি ইতিহাসে একটি সবচেয়ে নৃশংস ঘটনা। এইরকম মর্মন্তুদ হত্যা ইতিহাসে আর ঘটেনি। ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যা কোনো কোনো দেশে ঘটেছে। হত্যা মানেই নিষ্ঠুরতার আখ্যান। কিন্তু এইরকম নিষ্ঠুর রাজনৈতিক হত্যার উদাহরন আর কোথাও পাওয়া যায় না।
স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, শিশু, সন্তানসম্ভব্য নারী, ভাই, গৃহকর্মী সবাইকে মেরে ফেলা হলো। যুদ্ধকালীন হত্যার ও একটা রীতিনীতি থাকে। কিন্তু এখানে খুনিরা তার কিছুই মানেনি। বুঝায় যায় যে তাদের একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিলো এবং সে অনুযায়ী তারা খুনের কাজটা সেরে ফেলছে।
সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যটা কি অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে কেন হত্যা করা হলো এ বিষয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বিভিন্ন কথা পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলোর কোনোটা থেকেই পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। মনে হয় যেনো একেকজন তাদের মনের মাধুরি মিশিয়ে একেক মত দিয়েছে এবং যার অধিকাংশই বানানো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ২১ বছর এবং তারপর আবার ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৭ -বছর এভাবে মোট ২৮ বছর ধরে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল তারা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোন নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেনি, বরং সেই দীর্ঘ কালো সময়ে এ বিষয়টি নিয়ে যাতে কেউ তারা অন্ধকারে রেখেছে।
কেউ কেউ প্রদান কারণ হিসেবে বলার চেষ্টা করেন যে, তখন ক্ষমতার পরিবর্তনের প্রয়োজনে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। কিন্তু ক্ষমতার পরিবর্তন প্রয়োজন হলে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না তা তো নয়। আসলে ক্ষমতার পরিবর্তনের লক্ষ্যে এই হত্যাকান্ড ঘটানো হয়নি। হত্যাকাণ্ডের আগের এবং পরের ঘটনাবলী থেকে প্রতীয়মান হয় যে এটি ঘটানো হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে হত্যা করার জন্য। এই হত্যাকাণ্ডের সময় সমস্ত তথ্য উপাত্ত হাতে এলে হয়তো তখন আসল রহস্যটি উদঘাটিত হবে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের যাতে বিচার না হয় তার জন্য উগ্র সাম্প্রদায়িক বলে বহুল পরিচিত তৎকালীন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব খুব তৎপরতার সাথে কুখ্যাত 'দায়মুক্তি অধ্যাদেশ' বা 'ইনডেমনিটি অরডিন্যান্স' এর খসড়াটি প্রণয়ন করেছিলেন বলে জানা যায়। এর নামটি পরবর্তীতে পত্রপত্রিকাতেও এসেছিলো বলে বেশ মনে পড়ে। এই আমলা বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়েও ভালো পজিশনে ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার আসল রূপটি বেরিয়ে আসে। এবং এ কারণে তিনি নাকি জিয়াউর রহমানের খুব প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। ইনডেমনিটি অরডিন্যান্স প্রণয়নের বিনিময়ে তর বৈষয়িক লাভ নিশ্চয়ই অনেক হয়েছিলো। তবে একটি লাভ আমরা দেশবাসী নিজের চোখেই দেখেছি যে সচিব হয়েও মন্ত্রীপাড়া বেইলী রোডে সকল উচ্চ সুবিধাসহ তিনি দীর্ঘদিনের জন্য মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত একটি আলীশান বাংলো বরাদ্দ পেয়েছিলেন। কিন্তু এরকম সুবিধা পাওয়া আমলা ছিলেন শুধু তিনিই, তা কিন্তু নয়, হয়তো আরেকজন নয়, বরং আরও অনেকেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অনেক সরকারি কর্মকতার ভাব সাব দেখে মনে হতো যে তারা এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন, কিন্তু প্রকাশ করতেন না। বঙ্গবন্ধু সরকারকেও কখনো জানাননি।
যেদিন তিনি নিহত হলেন সেদিনকার দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আচরণ কি মনে সন্দেহ ও প্রশ্ন জাগায় না? তাদের মধ্যে কেউ কেউ তো এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু তাদের সেদিনের ভুমিকার জন্য কি জবাবদিহি করতে হয়েছে? তারা কে কতটুকু বা কী জানতেন তা কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাওয়া যায়নি।
মেজর ফারুক-রশিদ গং এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তৎকালীন উপ-সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল, সে সত্যটি তো তারাই গণমাধ্যমে বলেছে। জিয়াউর রহমান নাকি নিজে নেতৃত্ব দিতে সম্মত হননি, কিন্তু তাদেরকে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন। শুনেছি যে সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে চাকরিরত অবস্থায় এরকম একটি অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর নিয়ম অনুযায়ী তা কমান্ডকে জানাতে হয়, কিন্তু জিয়াউর রহমান তা করেননি। এই অবহিত না করাটা নাকি অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। সেই অপরাধ তিনি করেছেন। উপরন্তু তিনি এরপরেও যাতে ষড়যন্ত্র নিখুঁত ভাবে সফল করা যায় তার জন্য তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে, এমনকি ক্যান্টনমেন্টেও, বিভিন্ন নেতা ও কর্মকর্তাদের নিয়ে গোপন মিটিং করেছেন। এই সিরিজ গোপন মিটিং ও অন্যান্য কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেকে জড়িত ছিলেন বলে বিভিন্নভাবে নাম এসেছে। এগুলো সবই দেশদ্রোহিতা বা রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ। কিন্তু এগুলোর কোন বিচার বা সাজা হয়নি কারণ এসব লোকের বিরুদ্ধে কোন মামলাই হয়নি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িতদের বিচার হয়েছে। এ বিচারটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিলো। কারণ এই নির্মম হত্যাকান্ডে ও তৎপরবর্তী ইনডেমনিটি অরডিন্যান্সের কারণ জাতিগতভাবে বাঙালি যে অপমান ও কলংকের মুখোমুখি হয়েছিলো, এ-ই বিচারের ফলে তার কিছুটা অপনোদন হয়েছে। জনগণ খুশি যে এই নির্মম হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক যে বিদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকার কারণে এখনো সাজাপ্রাপ্ত পাঁচজনের সাজা কার্যকর করা যায়নি।
কিন্তু যাদের বিচার করা হয়েছে তারা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার দৃশ্যমান আসামী। কিন্তু সামনে যারা ছিল না, যারা গোপনে এই ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছে ও হত্যাকাণ্ডে ইন্ধন যুগিয়েছে বা বিদেশে লবিং করেছে কিংবা সরকারি প্রশাসনে ঘাপটি মেরে বসে সরকারের সিদ্ধান্তগুলোর বিরোধিতা করেছে কিংবা যারা বিদেশে বসে ষড়যন্ত্রের অগ্রগতি মনিটর করেছে এইসব লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য মানুষ গুলোর একের সাথে অন্যের যোগাযোগ ছিল কিনা, তারা কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল কিনা এবং কতটুকু ছিল এগুলো তদন্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। দৃশ্যমানদের বিচার হয়েছে কিন্তু এই বিচারকে সম্পূর্ণ অর্থবহ করতে হলে আড়ালের কিংবা ভালো মানুষের মুখোশ পরা কিংবা একেবারেই অদৃশ্য টাকা লোক গুলো কেউ খুঁজে বের করতে হবে। তাদেরকে যদি প্রাপ্য শাস্তি দেয়া না-ও যায়, তবু ন্যায় বিচারের স্বার্থে এবং জাতির ইতিহাসের স্বার্থে দেশী বিদেশী তাদের সবাইকে চিহ্নিত করা দরকার। এই কাজটি হবে দেশে ও বিদেশে পরিব্যাপ্ত। তাই একে নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভাবে অনুসন্ধানী করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন গঠন করে তাদেরকে জাতির জন্য এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি দেয়ার জন্য আবেদন রাখছি। এতে দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। তাহলে বিদেশের অনুসন্ধান গুলো কার্যকর ও সহজ হবে বলে বিশ্বাস করি। এই কমিশন যদি সুচারু ও নির্মোহ অনুসন্ধান করে একটি রিপোর্ট তৈরি করতে পারে, সেটি হবে বাঙালি জাতির জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সত্যনিষ্ঠ দলিল। ২৮ বছর ধরে চলে আসা অপপ্রচারকে ঠেলে ফেলে জাতি তখন জানতে পারবে ১৫ আগস্ট এর ষড়যন্ত্র টা আসলে কি ছিল, এটা কে কতটুকু কিভাবে জড়িত ছিল। বাঙালি জানতে পারবে যে এই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাকারী কারা,এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছে কারা ও কীভাবে, এবং এই হত্যাকাণ্ডের ফলে কারা কীভাবে লাভবান হয়েছে,কিংবা দেশ লাভবান হয়েছে কিনা।
বঙ্গবন্ধু পরিষদের ধারণা, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা কোনো হঠাৎ করার মতো কাজ নয়। এর পিছনে নিশ্চয়ই দীর্ঘদিনের সুপরিকল্পনা আর অসৎ ষড়যন্ত্র কাজ করছে। হয়তো হত্যার এই পরিকল্পনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই,কিংবা কে জানে হয়তো তারও আগে। আমরা দেশের ও আগামী দিনের সৎ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতির স্বার্থে সবটুকু জানতে চাই। ষড়যন্ত্রগুলোর সম্পর্কে জাতি না জানলে রাজনীতি পরিচ্ছন্ন হবে না।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ তার জন্মের পরের বছর সেই ১৯৮০ সালে লন্ডনে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, আমাদেরও সংগঠনের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দেশের একমাত্র বোস অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল মতিন চৌধুরীর উদ্যোগে আমাদের ইউরোপের নেতারা যা আয়োজন করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যেখানে কান্না ভেজা মর্মস্পর্শী বক্তৃতায় পরিবারসহ পিতা হত্যার বিচার চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত- আজ সেই শ্লোগানটি আমরা পুনরায় দীপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করছি 'বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার আন্তর্জাতিক তদন্ত চাই'। সেদিনের সেই সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটিতে প্রধান ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য একজন এমিকাস কিউরি।আর সদস্য হিসবে ছিলেন ব্রিটিশ ও অন্যান্য দেশের পার্লামেন্টের আরো কয়েকজন সদস্য, অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজের অধ্যাপক, বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আইনজীবী, প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। তদন্তের স্বার্থে তারা সেই সময় বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু জিয়াউর রহমান সরকার তাদের একজনকেও ভিসা দেয়নি। ফলে তাঁরা আসতে পারেননি। কিন্তু এখন ত তা শুরু করা যায়।
দেশের একটি সচেতন বুদ্ধিবিত্তিক সংগঠন হিসেবে আমরা যারা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাথে যুক্ত আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে দেশি বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক কমিশনের তদন্তের মাধ্যমে ইতিহাসের এই নিকৃষ্টতম রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হওয়া জাতির প্রয়োজনেই অন্তত জরুরি।
আমরা আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত চাইছি মানে এই নয় যে আমরা আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত চাই। আমরা চাই তদন্ত রিপোর্টটি যেন শুধু দেশীয় পরিমন্ডলে নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও বেশি গ্রহনযোগ্য হয়। সেজন্য এই তদন্ত কমিশনে বিদেশি প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবি, বিচারপতি ,আইনজীবি, অধ্যাপক,সাংবাদিক, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, অপরাধ বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ অন্তর্ভুক্ত থাকেন।
কেননা এই হত্যা ষড়যন্ত্রে বিদেশি কেউ অদৃশ্য আকারে জড়িত থাকলে তা উদঘাটন করতেও এই বিদেশী সদস্যরা সাহায্য করতে পারবে।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ তাই এবারের শোকের মাসেই ঐতিহাসিক স্লোগানটি বাছাই করেছে "বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার আন্তর্জাতিক তদন্ত চাই"। স্লোগানটি ৪২ বছরের পুরনো হলেও দুঃখজনক যে আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: অধ্যাপক আ ব ম ফারুক, সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ । সাবেক ডিন,ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সম্পাদক মন্ডলীর উপদেষ্টা, অধিকার পত্র।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: