odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Saturday, 1st November 2025, ১st November ২০২৫

আওয়ামী লীগ আজ যা ভোগ করছে তা তাদের ‘রাজনৈতিক পাপের ফল’: সংস্কৃতি উপদেষ্টা

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৩০ January ২০২৫ ১৯:৪১

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৩০ January ২০২৫ ১৯:৪১

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার এবং নাট্য নির্মাতা হিসেবে সুপরিচিত। সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার আগে তিনি শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে সফলতার সঙ্গে বিচরণ করেছেন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভিন্ন ধারার কিছু কাজ নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর তিনি ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যতিক্রমী সব পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে নতুন রূপে তুলে ধরতে তিনি বিভিন্ন পরিকল্পনার পাশাপাশি নানা প্রসঙ্গে বাসসের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সেলিনা শিউলী।

বাসস: বাংলা একাডেমিতে সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলুন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: প্রথমেই বলি বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে আমি ফেসবুকে লিখেছি। বিষয়টি স্পষ্ট করা ভালো। এ পুরস্কারের সাথে মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলা একাডেমির কিছু নিয়ম আছে, সেগুলো অনুসরণ করে তারা এ পুরস্কার দিয়ে থাকে। যখন পুরস্কারটা ঘোষণা করা হলো, যখন আমরা বিতর্ক এবং সমালোচনা দেখতে এবং শুনতে থাকলাম মানুষের কাছ থেকে, তখন আমরা দেখার চেষ্টা করলাম কী কারণে এ রকম হলো। পরে দেখা গেল এ পুরস্কারের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ছিল। বাংলা একাডেমির ফেলোরা এই পুরস্কারের মনোনয়ন দেন। পুরস্কার কমিটি ওই মনোনয়ন চূড়ান্ত করে। এসব ফেলোর শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি ও রুচি বিবেচনায় তাদের পছন্দের লোককে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। আবার ওই ফেলোরা কোন আমলে নিয়োগ পেয়েছেন, এক্ষেত্রে সেটারও একটা প্রভাব থাকে। ফলে ওই মনোনয়ন যে ফেলোরা দেন তাদের দিয়েই এই পুরস্কারের গতি নির্ধারণ করে ফেলা সম্ভব। এই ফেলোরা চাইলে এক ধরনের যোগসাজশ করে এমনকি হিটলারকেও একাডেমি পুরস্কার দিয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখেন এবং ফেলোদের মনোনয়নের খাম পুরস্কার কমিটি যে সভায় খোলে ওই সভাতেই সেটা পাস করতে হয়।

এখন ধরা যাক, পুরস্কার কমিটিতে যে সাত-আটজন সদস্য আছেন তাদের অনেকেই মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তির লেখালেখি সম্পর্কে না-ও জানতে পারেন। তারা চাইলেও মনোনীতদের লেখালেখি পড়ে দেখার সুযোগ পান না। আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টার মধ্যেই পুরস্কারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হয়। এটা এক অদ্ভুত নিয়ম। যেমন আমি নিশ্চিত জানি এবার পুরস্কার কমিটির মিটিংয়ে একজন সদস্য এই বিষয়ে আপত্তি করেন। এমনকি তিনি যে দুজনের পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে তাদের যেকোনো একটা বই চান দশ মিনিট পড়ার জন্য! সেটাও পারেননি।

বাসস: বিষয়টি ব্যাখ্যা করুন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: আরেকটা ব্যাপার গণমাধ্যমের নজরে আনা দরকার। বাংলা একাডেমির ফেলো এবং সাধারণ সদস্যের বেশিরভাগই একটা নির্দিষ্ট সার্কেলের অংশ। একটা উদাহরণ দেই- সলিমুল্লাহ খানের মতো বুদ্ধিজীবীকে বাংলা একাডেমির সদস্য পদের জন্য আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে দুইবার। আমাদের সময়টাকে যারা সনাক্ত করেছে তাদের কাজে, নতুন চিন্তা, নতুন ভাষা, নতুন ভাষ্যকে যারা উস্কে দিয়েছে এবং দিচ্ছে তাদের বেশিরভাগের সাথেই বাংলা একাডেমির কোনো যোগাযোগ নেই। সেজন্য এটা একটা স্থবির প্রতিষ্ঠান হয়ে আছে বহু বছর। ফলে আমি মনে করি শুধু পুরস্কার প্রক্রিয়া না, বাংলা একাডেমিরই আমূল সংস্কার করা উচিত।

আমাদের দেশে ‘২৪’র গণঅভ্যুত্থানের পর সব জায়গায় সংস্কারের চাহিদা তৈরি হয়েছে। বাংলা একাডেমি কেন এ সংস্কারের চাহিদার বাইরে থাকবে? ফলে আমরা মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি যাতে দ্রুত একাডেমির সংস্কারের জন্য একটা কমিটি তৈরি করতে পারি। কমিটির দায়িত্ব থাকবে বাংলা একাডেমিকে একটি চলমান প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত করা। যেন এটা নতুন চিন্তা অ্যাকোমোডেট করতে পারে। আর এটা নিশ্চিত করার জন্য বাংলা একাডেমির পরিচালনা পদ্ধতি, গঠনতন্ত্র, পুরস্কার নীতিমালা এবং যাবতীয় কিছু যদি নতুন করে করতে হয়, আর সেই নতুন করে করার কাজটা নতুন কমিটি করবে।

আমি মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যতদিন আছে আমরা যাওয়ার আগে এই সংস্কারের কাজটা শেষ করে দিয়ে যেতে চাই। যাতে এই প্রতিষ্ঠান জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব করে এবং জনচিন্তার প্রতিফল এটার মধ্যে থাকে। এটা যেন একটা বিশেষ কোটারি গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হয়ে না থাকে। এ কাজটা আমরা করব।

সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে কথা বলছেন বাসসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সেলিনা শিউলী। ছবি: বাসস
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে কথা বলছেন বাসসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সেলিনা শিউলী। ছবি: বাসস

বাসস: জুলাই বিপ্লবের পর গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘কালচারাল ব্রিজ’ তৈরি করা। এ কালচারাল ব্রিজ তৈরি বলতে আপনি কোন স্বপ্নের কথা বলেছেন?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : আওয়ামী লীগ দেশটাকে দুই ভাগ করেছিল একটা কালচারের অছিলা দিয়ে। আমি কয়েকটা উদাহরণ দিই, ৭১ টিভিতে একটা ইন্টারভিউয়ে আমার প্রিয় একজন রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী বলেছিলেন,‘হঠাৎ করে বাংলাদেশে এত বোরকা বেড়ে গেল কেন? কোত্থেকে আসছে এত বোরকা? এটা তো বাংলাদেশের সংস্কৃতি না ।’ এই ঘৃণাটা কালচারালি উৎপাদন করা হয়েছে আওয়ামী বিরোধীদের পলিটিক্যালি অ্যানিহিলেট করার জন্যে। এটা তো বাঙালি সংস্কৃতি না, এটা ইসলামি সংস্কৃতি। নামাজ-রোজা-বোরকা-দাড়ি এগুলোকে আপনি আপনার সংস্কৃতির অংশ বানাতে দেবেন না । সুতরাং আপনি ওদেরকে সাইডলাইন করছেন। সাইডলাইন করছেন তা না, আপনি মিডিয়ার সহযোগিতায় ওদেরকে ডিহিউমিনাইজ করছেন। আপনি ক্রিকেটার হাসিম আমলার ছবি দেখে বলছেন ‘জঙ্গি’। এই জিনিসগুলো আমরা ১৫ বছর ধরে উৎপাদন করেছি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। এই উৎপাদনের ফলাফল হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াতের যে কাউকে গুম করে ফেললে অসুবিধা নাই, ইলিয়াস আলী গুম হয়েছে, কোনো অসুবিধা নাই । কারণ ওরা তো ‘সো কলড বাঙালি সংস্কৃতি’র অংশ না, মানে আওয়ামী ঘরানার অংশ না, মানে ওই হেজেমনির অংশ না। সুতরাং ওরা খারাপ, প্রতিক্রিয়াশীল। সুতরাং ওদের গুম-খুন করা হলেও আমাদের কী আসে-যায়! এভাবেই কালচারাল পলিটিকসের বলি হয়েছে হাজার হাজার মানুষ! এটা ডেঞ্জারাস!

আরেক দল বলে পহেলা, বৈশাখ তো আমাদের সংস্কৃতি না, এটা প্রতিহত করো। ওর জিন্স প্যান্ট আমার পছন্দ না, প্রতিহত করো। এটা ভয়ংকর! আমাদের একমত হতে হবে যে, রাষ্ট্রে সকল মত এবং পথের মানুষ সকল দ্বিমত নিয়ে পরস্পরকে শ্রদ্ধা করে পাশাপাশি থাকতে পারে।

এই যে একদল আরেকদলকে এক্সক্লুড করতে চাওয়ার রেজাল্ট হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং তার ফলাফল ২০২৪। আওয়ামী লীগ আজ যা ভোগ করছে তা তাদের ‘সাংস্কৃতিক পাপের’ ফল। আজকে যে আমরা গণঅভ্যুত্থানের পরে নতুন একটা সরকার দায়িত্বে এসেছি, আমাদের কাজ হলো এই কালচারাল ব্রিজটা নির্মাণ করা। যেন আবার একই ভুল আমরা না করি। যে ভাই-বোনরা এতদিন এক্সক্লুডেড ফিল করেছেন, তারা যেন আবার অন্যদের এক্সক্লুডেড ফিল না করান।

বাসস: কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিতে কী ধরনের বুনিয়াদি পরিবর্তন আসতে পারে? এ বিষয়ে কিছু বলেন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: সংস্কৃতি বিষয়ে নীতিমালা পরিবর্তন করা খুব প্রয়োজন। আমাদের মন্ত্রণালয়গুলোর ‘অ্যালোকেশন অব বিজনেস’ খুব অবৈজ্ঞানিক। বিশ্বের যে দেশগুলো এখন কালচারালি ভালো করছে কোরিয়া,ইতালি,ইরান বা যে কোনো দেশের উদাহরণ দেখাই; কলোনিয়াল কান্ট্রি বাদ- তাহলে দেখব যে, পুরা কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি একটা মন্ত্রণালয়ের অধীন। সিনেমা, ওটিটি, থিয়েটার, মিউজিক, আর্ট এডুকেশন, ফিল্ম স্কুল,থিয়েটার এডুকেশন; পর্যটনও একই সাথে। এতে করে গোটা কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির পলিসি মেকিং, রেগুলেশন, সাপোর্ট সিস্টেম অনেক সহজ হয়। এ ছাড়া ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিও তখন অনেক সিনক্রোনাইজড ওয়েতে কাজ করতে পারে। কালচার এবং ট্যুরিজম প্রায়ই কাছাকাছি কাজ করে। ফলে সেটাও একসাথে থাকা উচিত।

এই কম্বাইন্ড অ্যাপ্রোচ ছাড়া কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন মাফিক পলিসি করা এবং সেটা বাস্তবায়ন অসম্ভব হবে। আমাদের কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিটা দেখার কথা মিনিস্ট্রি অব কালচারের। কিন্তু সিনেমা আবার ইনফরমেশন মিনিস্ট্রির। ওটিটি এবং টিভি চ্যানেলও ইনফরমেশন মিনিস্ট্রির আন্ডারে। যদি সব এক জায়গায় না হয়, তাহলে সিনক্রোনাইজেশনটা হয় না। এদিকে, আমার জানতে হবে বিদেশি টিভির বেলায় কী নীতিমালা হতে হবে এবং ওই নীতিমালা হওয়ার ফলে বাংলাদেশে আমার যে শিল্পীরা আছে, তাদের জন্য কী বেনিফিট হবে। এটার বেনিফিটটা এনশিওর করার জন্য আরো কোনো পলিসি সাপোর্ট লাগবে কি না। কোনো স্ট্রিক্ট রুল লাগবে কি না। আমাদের শিল্পীদের কাজের জায়গা বাড়ানো মন্ত্রণালয়ের কর্তব্য হওয়ার কথা ছিল। এখন আমাদের দায়িত্ব যেটা আছে সেটা হলো কাজের অভাবে দুস্থ হয়ে গেলে দুঃস্থ শিল্পীদের ফান্ড থেকে টাকা দেওয়া।

বাসস: অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এবারের প্রতিপাদ্য ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ বিষয়টি নিয়ে আপনার পরিকল্পনার কথা বলুন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: বইমেলা আমাদের কালচারালি একটা বড় ইভেন্ট। এবার বইমেলাটা জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রথম মেলা। এবারের বইমেলা, একুশের প্রথম প্রহরে ফুল দেওয়া, একুশে পদক অনুষ্ঠান- এই পুরো আয়োজনে আমরা একটা থিমেটিক পরিবর্তন আনতে চাই। থিমের মধ্যে যদি রঙের কথা বলি, লাল-কালো এবং সাদা- এই তিনটা রঙে ছেঁয়ে যাবে এই পুরো অঞ্চলটা- এটা আমরা চাই। পাশাপাশি ‘৫২’র সঙ্গে ‘২৪’র একটা গভীর যোগাযোগ আছে। আমি যদি কয়েকটা গ্রাফিতির কথা বলি- এটা বুঝতে আরো সহজ হবে। বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে এখনও আছে, ‘কথা ক’, ‘আওয়াজ উঠা’, ‘নো নেটওয়ার্ক’, ‘পুলিশের থাবায় বন্ধ মুখ’- এগুলোর সঙ্গে ‘৫২’র ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’-এর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই যে মিলটা খুঁজে পাওয়া যাবে, এই যে দ্বিমত করতে চাওয়ার অধিকারটা এটা সিগনিফিক্যান্ট। আমরা মনে করি যে ৫২’র যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সেটা বাহ্যত ‘বাংলা’কে রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতি দেওয়ার দাবীতে হয়েছিল বটে, তবে অন্তরে আরো অনেক কিছু ছিল। অন্তরে সবচেয়ে বড় জিনিসটা ছিল ক্ষমতাসীনের সঙ্গে দ্বিমত করার স্বাধীনতা। অর্থাৎ মানুষের মাতৃভাষা দুইটা। এক. যে ভাষায় তার পূর্বপুরুষ কথা বলে। দুই. দ্বিমতের ভাষা।

‘২৪ এও একই ব্যাপার। ‘২৪ আপাতদৃষ্টিতে শুরু হয়েছিল চাকরিতে কোটার দাবিতে। আমার ফেসবুকে লিখেছিলাম যে যারা মনে করছেন, এটা স্রেফ একটা চাকরির আন্দোলন তারা বোকার স্বর্গে আছেন। এ আন্দোলন মূলত নিজের দেশে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে না বাঁচার আন্দোলন। অর্থাৎ নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার আন্দোলন। মত প্রকাশের আন্দোলন। ‘রাজা, তোমার মত মানি না’ বলার আন্দোলন।

ফলে ‘২৪ এবং ‘৫২’র যে সবচেয়ে বড় একটা মিলের জায়গা সেটা হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এটা থাকলে সমাজে গণতন্ত্র থাকবে। এটা থাকলে সমাজ ইনক্লুসিভ হবে। এই কারণে বইমেলায় সকল সাজসজ্জায় জুলাইয়ের লাল, বায়ান্ন’র কালো এবং চিরকালীন সাদা থাকবে। বইমেলায় আপনারা যে ছবি এবং গ্রাফিতিগুলো দেখবেন সেগুলোর মধ্যে ‘৫২ এবং ‘২৪’র মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখবেন।

বাসস: আপনি জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলা একাডেমির সংস্কারসহ সাতটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন- এসব সংস্কার কার্যক্রম বিষয়ে কিছু বলুন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: এই সাতটার পর আরো নতুন কিছু প্রজেক্ট এসেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর দেখলাম এটা একটা অবহেলিত মন্ত্রণালয়! আমরা আমাদের সব দপ্তর, সংস্থা এবং মন্ত্রণালয় মিলে চেষ্টা করতে শুরু করলাম যাতে সারা দেশে একটা সাংস্কৃতিক উদ্দীপনা তৈরি করা যায়।

জাতীয় জাদুঘর দিয়ে শুরু করি। আমাদের জাতীয় জাদুঘর খুবই বেহাল অবস্থায় রয়েছে। আমরা যখন পৃথিবীর কোনো দেশে যাই, ওই দেশের মিউজিয়ামে যাই। মিউজিয়ামে যাওয়া যেকোনো টুরিস্টের মাস্ট ভিজিট অ্যাক্টিভিটি।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাইরে থেকে যারা আসে তারা যখন আমাদের মিউজিয়ামে যায়, হতাশ হয়ে ফিরে আসে। কারণ মিউজিয়ামে কোনো জিনিস প্রপারলি রাখা হয়নি। প্রিজারভেশন প্রপার না। জাদুঘর কিউরেশনে যে ইনোভেটিভ হওয়ার একটা ব্যাপার আছে এটা এখানে দেখা যায় না। আমরাও তাই খুব একটা জাতীয় জাদুঘরে যাই না।

জাতীয় জাদুঘর একটি স্থবির প্রতিষ্ঠান হয়ে আছে তা নয়, একই সঙ্গে ক্ষয়িষ্ণুও বটে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও পটুয়া কামরুল হাসানের শত শত পেইন্টিং বেসমেন্টে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এগুলোর প্রিজারভেশনের কোনো ব্যবস্থা নাই। এগুলো নিয়ে কোনো ট্রাভেলিং শো করার ব্যবস্থাও নেই। জাদুঘরের দুর্লভ ছবিগুলো নিয়ে ট্রাভেলিং শো হতে পারে সারা পৃথিবীতে। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশ্বের বিভিন্ন মিউজিয়ামে আধুনিক প্রযুক্তি এসে গেছে। আমরা যদি এই প্রযুক্তিগুলোর দিকে না তাকাই নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা মিউজিয়াম ইন্টারেস্টিং করতে পারবো না ।

জাতীয় জাদুঘর কোনো জাতির জন্য একটা ‘মেজর’ বিষয় । কিন্তু এটাতে মনোযোগ 'মিনিমাম'। জাদুঘরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং আধুনিকায়ন করা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হিসেবে নির্ধারণ করেছি। কিন্তু কাজটা করতে পারবে এমন ভিশনারি কে হতে পারেন? এক্ষেত্রে আমরা খুবই আনন্দিত যে আর্কিটেক্ট মেরিনা তাবাসসুমকে ন্যাশনাল মিউজিয়ামের গভর্নিং বডি’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে সম্মত করাতে পেরেছি। আমরা সবাই উনার কাজ সম্পর্কে জানি। ২০২৪ সালে টাইম ম্যাগাজিনের চোখে ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে তিনি স্থান করে নিয়েছেন। মিউজিয়ামের কাজ দীর্ঘমেয়াদী। উনি জানেন কি করে মিউজিয়ামকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি আগামী তিন বছরের মধ্যে মিউজিয়ামের দৃশ্যগত পরিবর্তন আনতে পারবেন। পারলে এটা আমাদের একটা মেজর সংস্কার হয়ে থাকবে।

বাসস: ‘জুলাই গণঅভ্যূত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ এর গঠন ও নির্মাণ শৈলী নিয়ে কিছু বলুন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: মিউজিয়ামের কথা যেহেতু হচ্ছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরের কথা বলা প্রয়োজন। এটা আমাদের একটা ‘প্রায়োরিটি প্রজেক্ট’। যেটা আগে গণভবন ছিল, যেটা খুনি হাসিনার বাসা ছিল। আপনারা জানেন প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরই এটাকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেয়। এটার দায়িত্ব এখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তেছে। বাংলাদেশের যারা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং সম্যক জ্ঞান রাখেন, সবাইকে সাথে নিয়ে এই কাজটা আমরা করতে চাচ্ছি।

আমাদের গৃহীত অনেক প্রজেক্টের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর। এই জাদুঘরের দর্শনটা একটু ভিন্ন হবে। আমরা এই জাদুঘরটা এমনভাবে করতে চাই যাতে জাদুঘরের প্রথম গেট দিয়ে একজন দর্শক যখন ঢুকবে ওই দর্শককে যেন আমরা হাত ধরে নিয়ে যেতে পারি গত ১৫ বছরের দুঃশাসনের ভেতর দিয়ে। এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে জার্নি করতে করতে গণভবনের যে মূল প্রাসাদ যেখানে খুনির বাসভবন ছিল, সেই খুনির বাসভবনেও অনেক ধরনের ইনস্টলেশন এবং প্রজেকশনের ব্যবস্থা করা হবে। দর্শকরা এই জাদুঘরে গেলে ওই ১৫ বছরের ইমোশনাল জার্নিটার ভেতর দিয়ে যাবে। তারা জার্নি শেষে যেই গেট দিয়ে খুনি হাসিনা পালিয়ে গিয়েছিল সেই গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবে।

এরমধ্য দিয়ে তাদের এই ১৫ বছরের দুঃশাসনের ভ্রমণটা হয়ে যাবে। আমরা মনে করি এটা শুধু বাংলাদেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ না গোটা পৃথিবীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। যাতে করে যে কেউ ফ্যাসিস্ট হওয়ার আগে যেন দ্বিতীয়বার ভাবে এবং খেয়াল রাখে ফ্যাসিস্ট হলে তার কী পরিণতি হতে পারে। এই কারণে জাদুঘরটিতে ফিজিক্যাল ট্যুরের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও যারা ভার্চুয়াল ট্যুর করতে চায় তাদের জন্য ভার্চুয়াল ট্যুরের ব্যবস্থা করা হবে। এই জাদুঘর সাজানোর চিন্তা-ভাবনা ও ক্রিয়েটিভ কাজকর্মের পেছনে বাংলাদেশের ‘বেস্ট মাইন্ড’ কাজ করবে এটুকু আমরা বলতে পারি।

বাসস: পানাম নগরী ও কক্সবাজার এ দুটো স্থানকে সাংস্কৃতিক ক্যাপিটালে পরিণত করার বিষয়ে আপনার কি ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে তা বলুন।

মোস্তফা সারয়ার ফারুকী: এক্ষেত্রে দুইটা বড় স্বপ্ন আছে আমাদের। আমরা এটা শুরু করে দিয়ে যেতে চাই। হয়তো আমরা শেষ করে যেতে পারবো না। কারণ এগুলো সম্পন্ন করতে সময় লাগবে অনেক। একটা হচ্ছে পানাম নগরীকে কালচারাল ক্যাপিটালে পরিণত করা। আমরা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে গেলে দেখব তাদের হেরিটেজ সাইটগুলোকে এমনভাবে রিনোভেট করা হয়েছে, কোথাও রিসোর্ট বানানো হয়েছে, কোথাও মিউজিয়াম বানানো হয়েছে, কোথাও রেস্টুরেন্ট বানানো হয়েছে। এর মাধ্যমে ওই ভবনগুলো জীবন্ত থাকছে। কারণ পর্যটক যখন ওখানে যায়, রিসোর্টে থাকে, মিউজিয়াম পরিদর্শন করে, তখন প্রতিনিয়ত তাদের আনাগোনায় সেটা জীবন্ত থাকে।

আমরা চাই পানাম নগরীকে রেনোভেট করতে। শুধু রেনোভেট না, যেন এটাকে একটা কালচারাল ক্যাপিটালে পরিণত করতে পারি- যেখানে দেশ-বিদেশের মানুষ গিয়ে এক-দুইদিন থাকে এবং বাংলাদেশের কালচারের রস আস্বাদন করে। পাশাপাশি আমাদের লোকাল কারুশিল্পের সাথে যেন পর্যটকদের পরিচয় ঘটে। আমরা মনে করি পানাম নগরীকে পৃথিবীর ম্যাপে একটা উল্লেখযোগ্য কালচারাল হেরিটেজ সাইট হিসেবে আমরা পরিচয় করাতে পারবো।

এর বাইরে আরেকটা বড় স্বপ্ন আছে কক্সবাজারকে একটা ‘কালচারাল হাব’-এ পরিণত করা। আপনি দেখেন বিচ শহরে গড়ে উঠেছে ‘কান’। যেখানে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়। সেখানে নানান কালচারাল অ্যাকটিভিটিস থাকে।

আপনি ভেনিসের কথা ভাবেন। বিচকেন্দ্রিক শহরগুলোতে বিভিন্ন ধরনের কালচারাল অ্যাকটিভিটিস থাকে। আর্ট স্কুল থাকে, ফিল্ম স্কুল থাকে। এটা করা হয় যাতে কালচার এবং ট্যুরিজম একই মালায় গেঁথে পৃথিবীর একটা প্রমিনেন্ট সাইট হিসেবে পরিণত করা যায়। আমাদের কক্সবাজারে গেলে দেখবেন, সন্ধ্যার পর ব্যস্ত থাকার মতো তেমন কিছুই নেই। বিচে কিছু নিঃসঙ্গ কুকুর হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমরা কালচারাল ইনস্টিটিউশনসহ এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই যাতে কক্সবাজার কালচার এবং আর্ট এডুকেশনের হাব হয়। যাতে করে বিচে দশটা স্পটে প্রতিদিন কোনো না কোনো কর্মসূচি চলতে থাকে।

এই কর্মসূচিগুলো শুধু যে বাইরে থেকে শিল্পী গিয়ে করবেন তা না, ওই কালচারাল ইনস্টিটিউশনগুলোর যে শিক্ষার্থীরা থাকবে তারাও এই কালচারাল ইভেন্টগুলোতে অংশ নিতে পারবে। এ থেকে তারা পার্ট টাইম আয় করতে পারবে। আমরা যদি আমাদের সময়ে পরিকল্পনাটা শেষ করতে পারি তাহলে আমরা ভবিষ্যতে এটা বাস্তবায়ন করতে পারবো। আমরা মানে যে সরকার নির্বাচিত হয়ে আসবে তারা। এ দুইটা কাজ করতে পারলে আমাদের দেশের জন্য খুবই ভালো হবে।

বাসস: জুলাই বিপ্লবের আগুনকে আপনি কীভাবে জাগরুক রাখতে চান? ব্যাখ্যা করুন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: জুলাইয়ের যে আগুন আমাদের গায়ে আছে এর উত্তাপটাকে জাগরুক রাখার জন্য আমরা অনেকগুলো উদ্যোগ নিয়েছি। এরমধ্যে রিমেম্বার মনসুন রেভ্যুলেশনের আওতায় আটটি বিভাগে ফিল্ম মেকিং ওয়ার্কশপ হচ্ছে। কিছু রেডিক্যাল ইয়াং ও রকিং ইয়াং ওয়ার্কশপগুলো পরিচালনা করছে। তারা হলো- নূহাশ হুমায়ূন, অনম বিশ্বাস, হুমায়রা বিলকিস, শঙ্খ দাস গুপ্ত, শাহীন দিল রিয়াজ, রবিউল আলম রবি, তাসমিয়াহ আফরিন মৌ এবং মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম।

তারা যে শুধু ওয়ার্কশপ করবে তা নয়, দশজন করে ফিল্মমেকারকে প্রশিক্ষণ দেবেন। পাশাপাশি আটটি মাঝারি ধরনের কনটেন্ট বানাবেন তারা। ছবিগুলো আমাদের নতুন বাংলাদেশের কথা বলবে।

বাংলাদেশ কীসের ভেতর দিয়ে আজকে আসছে তা দেখাবে। এ কার্যক্রমে সরকার তাদের কোনো প্রেসক্রিপশন দিচ্ছে না, স্ক্রিপ্ট লেখার ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। তারা সচেতন ফিল্মমেকার। বাংলাদেশ কী, তারা সেটাকে মাথায় রেখে স্বাধীনভাবে চিত্র নির্মাণ করবে। এ থেকে থিয়েটার প্রোডাকশন হবে আটটি।

এছাড়া আমরা ডিজিটাল ওরাল হিস্ট্রি আর্কাইভ করছি। সবই যে আমরা ছয় মাসে করতে পারব তা নয়, এক বছর লাগতে পারে।

বাসস: নানা ব্যস্ততার মাঝেও বাসসকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: আপনাকেও ধন্যবাদ।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: