ভোলগা থেকে গঙ্গা ইতিহাসের এক ট্রাজেডি
- মোঃ এরফান রাশেদ
রাহুল সাংকৃত্যায়ন ভোলগা থেকে গঙ্গা বইয়ে ২০টি ছোট গল্পের মাধ্যমে মানবজাতির ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ৪৫ বছর ধরে রাশিয়া জাপান, চায়না, কোরিয়া, ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেছেন। এই ভ্রমন লব্ধ জ্ঞান তিনি তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম ভোলগা থেকে গঙ্গার মধ্যে উপস্থাপন করেছেন। অনেকেই মনে করে থাকেন এই বইয়ের ছোট ছোট গল্প সমূহ কল্পনা প্রসূত কিন্তু ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানের এই পর্যায়ে ঘটনা সমূহের ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। প্রায় ৬০০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে ভোলগা নদীর তীরে যে মানব গোষ্ঠী পরিবার স্থাপন করেছিল তাদেরই আবাস ও জীবন নিয়ে রচিত হয়েছে প্রথম গল্পটির (নিশা) দৃশ্যপট। ক্রমে সেই মানুষ মধ্য ভোলগাতটে অগ্রসর হয়ে মধ্য এশিয়া অতিক্রম করেছিল। উত্তর কুরু (তাজিকিস্তান) পেরিয়ে একসময় সমগ্র গান্ধার এলাকা জুড়ে বসতি স্থাপন করেছিল এই আর্যরা।
ধর্ম কী? একটি শিশু জন্মের পরেই এই শব্দের সাথে পরিচিত হয় না। তাকে মসজিদ অথবা মন্দিরে গিয়ে ধর্মের নানা বিধ আচার সম্পন্ন করানো হয়। বাবা-মার দেখাদেখি সেও নিজেকে হিন্দু –মুসলিম-বৌদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। পুরুহুত অংশের শেষভাগে লেখক দেখিয়েছেন যুদ্ধ জয়ের ফলে ব্যক্তি কীভাবে দেবতা ইন্দ্রে পরিণত হন।
পুরুধানে লেখক উপস্থিত করেছেন আর্য এবং অনার্য জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং নিত্য নতুন দ্রব্যের ব্যবহার। এছাড়াও বইটির পরবর্তী অংশসমূহে আর্য অনার্যদের মধ্যে যুদ্ধ, অনার্যদের পরাজয়ের ফলে দাস শ্রেণির উদ্ভব, ব্রাহ্মণ সমাজের উৎপত্তি, যার ফলে মানুষ কীভাবে বিভিন্ন দেব-দেবতায় বিশ্বাসী হল তার এক জবনিকা উৎঘাটন করা হয়েছে। লিঙ্গ পূজার (দেবতা শীবের পুজা) মধ্যমে এক নতুন প্রথার চালু হল যার কারন হিসেবে বলা যায় তৎকালীন সময়ের রাজাদের দুঃশাসন যাতে করে সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে এবং রাজারাই যে দেবতাদের প্রতিনিধি এবং জনগনের সম্পদে তাদের প্রাপ্য অংশ যা তারা খাজনা হিসেবে তাদের ভোগ বিলাসের জন্য আদায় করে এগুলো যাতে প্রকাশিত না হয় তাই তারা ব্রাহ্মণ তথা পুরোহিতদের বিভিন্ন উপঢৌকনের মাধ্যমে এই সব রীতিনীতি চালু করে। আর এভাবেই আর্যরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। আর যারা পারেনি তারা দাস শ্রেণিতে পরিনত হয়।
এবার আসা যাক বৌদ্ধ ধর্মে। যা সব সময় প্রচার করে এসেছে সমাজে সকলের সমতা। কিন্তু তারা পারেনি সমাজ থেকে দাশ প্রথার মুক্তি দিতে। এই বইয়ের প্রভা অংশে তার সরূপ আলোচনা করা হয়েছে “ বুদ্ধ জগতের ভিতর বাহির কোথাও এমন কোন নিত্য ধ্রুব বা শাশ্বত তত্ত্বকে স্বীকার করেন না। এ জন্যই তাঁর দর্শনকে অনাত্মবাদ, অর্থাৎ অবিরাম উৎপত্তি আর বিনাশের সংঘর্ষে যে অনিত্যতা তারই দর্শন বলা হয়।” কিন্তু দাশেরা যখন বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষিত হয়ে বৌদ্ধ মঠ গুলোতে অবস্থান করতে পারল না সমতা আর কোথায় রইল। ধর্মে শুধু উচ্চবিত্তদের গুনকীর্ত্তণই রইল।
সমাজ সর্বদাই পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনটা এগিয়ে যাবার জন্য, পিছিয়ে পড়ার জন্য নয়। আর অতীত সে তো মৃত। আর এভাবেই গঙ্গার তীরে একদিন মুসলমানদের আগমন ঘটে। সমাজে যারা নির্যাতিত ব্রাহ্মণদের উপরে যারা কোনদিনই কথা বলতে পারত না তারাই এই ধর্মের অনুসারী হল। আর মুসলমানের জোর পূর্বক বিভিন্ন স্থানে মানুষকে ধর্মান্তরিত করতে লাগল হাজারো তরুণী হলো তাদের লালসার শিকার। এটাই কী ধর্ম?
রাহুল সাংকৃত্যায়ন ব্যক্তি জীবনে মার্কসবাদী ছিলেন। তাঁর এই মার্কসবাদী চিন্তার প্রতিফলন তিনি মঙল সিংহের মাধ্যমে ঘটিয়েছেন। সারা বাংলা যখন ইংরেজদের অত্যাচারে জর্জরিত তখন শুরু হয় সিপাহী বিদ্রোহ আর এই বিদ্রোহের মাধ্যমে আমাদের সামনে এসে হাজির হয় বিলেত ফেরত মঙল সিংহ। যা রাহুল সাংকৃত্যায়নের ব্যক্তি জীবনের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মঙল সিংহের সেই আন্দোলন বিফলে গেলেও রাহুল সাংকৃত্যায়ন পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্তি পেতে মহাত্মা গান্ধীকেও ছেড়ে কথা বলেন নি। সফদর অংশে তিনি এ বিষয়ে সফদর ও তার বন্ধু শঙ্করের কার্যকলাপের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এছাড়াও ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে তাদের দুজনের একসাথে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম সকলের সম্মিলিত অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। সবিশেষ সুমের অংশের মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তি তথা স্বাধীনতার বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
এ বইয়ের প্রতিটি ঘটনাই ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে রচিত। বইটি ইন্দো-ইউরোপীয় জাতির ইতিহাস। তাদের সংগ্রাম, ঐতিহ্য ও ধর্মের ইতিহাস। বইয়ের নিশা, দিবা, অমৃতাশ্ব, পুরুহুত প্রভৃতি রচনা লইস মর্গানের “এনসিয়েন্ট সোসাইটি”, এঙ্গেলসের “পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি”, রবার্ট ব্রিফলের “দি মাদাস” প্রভৃতি গ্রন্থে প্রচারিত সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্বের উপর নির্ভর করে রচিত।
পুরুধান থেকে প্রবাহণ পর্যন্ত গল্পে বেদ, ব্রাহ্মণ, মহাভারত, পুরাণ ও বৌদ্ধভাষ্য অটঠ কথার সাহায্য নেয়া হয়েছে। সুদাস গল্পটি সম্পূর্ণ ঋগবেদ নির্ভর। এরপরের থেকে গুপ্তযুগ এর প্রাক্কাল অবধি কাহিনী গুলো মুলত বৌদ্ধশাস্ত্র, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, অশ্বঘোষ এর বুদ্ধচরিত, সৌন্দরানন্দ এই কটি গ্রন্থের সহায়তায় রচিত। এ ছাড়াও গ্রিক পর্যটকদের ভ্রমণকথা, জয়সোয়াল এর “হিন্দু-পলিটি ও অন্যান্য ইতিহাস”, রিজ ডেভিজ এর “বৌদ্ধ ভারত” হতে তথ্য গ্রহণ করেছেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন।
সুপর্ণ যৌধেয় কাহিনী থেকে গুপ্তযুগের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তার মূল গুপ্তযুগের বিভিন্ন পুরালেখা সমূহ। অবশ্য অধিকাংশ রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, অভিজ্ঞান-শকুন্তলম থেকে গৃহীত। তবে চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন এর ভ্রমণ বৃত্তান্তও কাজে লাগিয়েছেন তিনি। দুর্মুখ হর্ষচরিত, কদম্বরী এবং ফা-হিউয়েন সাং ও ইৎসিঙ এর বর্ণনার উপর নির্ভরশীল। চক্রপাণি নৈষধ, খন্দনখন্ড খাদ্য এবং বিক্ষিপ্ত কিছু বই এর উপর নিভর্রশীল। বাবা নূরদীন থেকে সুমের পর্যন্ত গল্পের প্রমাণাদি যথেষ্ট রূপে বিদ্যমান, যেহেতু এই সময়কাল গুলো বেশি আগের নয়।
বইয়ের আরো একটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে ট্রাজেডি। প্রায় প্রতিটি গল্পই শেষ হয়েছে ট্রাজেডির মাধ্যমে। যে ট্রাজেডি এই সুজলা সুফলা বাংলা-এই ভারতীয় উপমহাদেশের। যার সাক্ষী ভোলগা থেকে গঙ্গার প্রতিটি ধুলিকণা।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: