ঢাকা | রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দুঃসময়ে সবাই এক একজন শামীম ওসমান হোন

আহসানুল ইসলাম আমিন | প্রকাশিত: ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৪৬

আহসানুল ইসলাম আমিন
প্রকাশিত: ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৪৬

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অাসন্ন। বিরোধী দলগুলো চায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখতে। টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি যেকোনো মূল্যে ক্ষমতার মসনদ দখলে মরিয়া। যেকোনো মূল্যে রাজপথের দখল নিয়ে সরকার কে চাপে ফেলতে চায় দলটি। এই লক্ষ্যে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করছে তারা। কর্মীদের উজ্জীবিত করতে আমেরিকার স্যাংশন, ভিসা নীতির মত বিষয়গুলো বারবার সামনে আনছে। সভা, সমাবেশে যেকোনো মুহূর্তে সরকার কে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের ঘাবড়ে দিতে তারা একের পর এক বিভিন্ন আল্টিমেটাম দিচ্ছে। মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে স্যাংশনের নতুন নতুন খবর কিংবা গুজব প্রকাশিত হলে খুশিতে অট্টহাসি দেন বিএনপি মহাসচিব।

বিএনপি ঘরানার কিছু বুদ্ধিজীবী ও খুশিতে আত্মহারা হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন- আরো নিষেধাজ্ঞা আসছে, মিডিয়ার উপরও স্যাংশন আসছে, অচিরেই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা! ভাবখানা এমন যে বাংলাদেশের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপিত হলে তারা মহাখুশি; কারন সরকার চাপে পড়বে। এসব স্ট্যাটাসে বিএনপি নেতারাও বেশ উচ্ছ্বসিত হন, পুলকিত হন। বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা এসব সংবাদ, গুজব আর স্ট্যাটাস দেখে স্বপ্ন দেখতে থাকে  এই বুঝি সরকার পড়ে গেল! আমেরিকা তো আছে সাথে, নির্বাচনের আর দরকার কি? বিএনপি তো সরকারে এলো বলে! ক্ষমতার স্বপ্ন মোহে ওরা একের পর এক এসব শেয়ার করতে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অথচ বিএনপির এই রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের বিপরীতে আওয়ামী লীগ যেন অনেকটাই চুপ। এসব সংবাদ, গুজব এবং অনুমান নির্ভর স্ট্যাটাসের জবাবে আওয়ামী লীগের দু'একজন ছাড়া লেখার কেউ নেই।

বিএনপির নেতৃত্বে সরকার বিরোধী সংগঠনগুলো যখন ঐক্যবদ্ধভাবে ঢাকা দখল এবং গণভবন ঘেরাওয়ের হুমকি দিচ্ছে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতারা তখন ব্যস্ত নিজেদের কে জাহির করতে। জাতীয় সংসদের নির্বাচন কে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের কিছু মনোনয়ন প্রত্যাশী শেখ হাসিনা সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন এবং অর্জনের প্রচার করলেও বেশিরভাগই সভা, সমাবেশে ব্যস্ত বর্তমান এমপিদের সমালোচনা এবং চরিত্রহননে। যতটা না তারা সরব বিএনপি, জামাতের বিরুদ্ধে; তার চেয়ে বহুগুণে উচ্চকিত নিজ দলের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলেও দেখা যায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিজ দলের নেতা, এমপি, মন্ত্রীদের সমালোচনায় ব্যস্ত থাকতে। অথচ বিরোধী দলের অপপ্রচার, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের বেশিরভাগই  টুঁশব্দ ও করেন না। এটা ঠিক কিছু এমপি এলাকায় নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে দলের ত্যাগী, পরীক্ষিত, জনপ্রিয় নেতাদের কোণঠাসা করে নিজের একান্ত অনুগত কিছু নেতাকর্মী নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। গণমানুষ তো দূরের কথা নিজ দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীদের কাছ থেকেও তারা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন।

সম্প্রতি বাগেরহাট-৩, মেহেরপুর-১ সহ অনেক আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এক মঞ্চে একজোট হয়ে বর্তমান এমপিদের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়েছেন। আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন পরিবর্তনের জন্য দলীয় প্রধানের কাছে দাবি জানিয়েছেন। দলের এমপিদের সমালোচনা করতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা দলকেই বিতর্কিত করছেন। দলের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বর্তমান এমপিকে বাদ দিয়ে আর যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক তারা তাকে মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো যারা বর্তমান এমপি কে ঠেকাতে একাট্টা হয়েছেন, এক মঞ্চে উঠেছেন তারা সবাই মনোনয়ন প্রত্যাশী। দলের হাইকমান্ড তাদের কাছে একক প্রার্থীর নাম চাইলে তারা কি দিতে পারবেন? না কি তখন নিজেদের মধ্যে বিভেদে জড়াবেন? এই প্রশ্ন অনেকের মনে। শুধু বাগেরহাট, মেহেরপুর নয় সারাদেশের অনেক আসনেই এমপি বনাম স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরোধ, সংঘর্ষের খবর রীতিমতো পত্রিকার হেডলাইন হচ্ছে।

নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বিরুদ্ধে জেলা আওয়ামী লীগ এবং জেলার অন্যান্য এমপিদের প্রকাশ্য অবস্থান দীর্ঘদিন ধরে টক অব দ্যা কান্ট্রি। দলের নেতাদের লাঞ্চিত করা এমনকি খোদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, পিতার বয়সী, সদ্য প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস কে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ও রয়েছে এই সাংসদের বিরুদ্ধে। বিগত সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ হারিয়েছেন তিনি। এই আসনে ভাল অবস্থানে রয়েছেন শিমুলের পদে স্থলাভিষিক্ত হওয়া জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান।

সম্প্রতি খুলনা-৬ আসনের এমপি আক্তারুজ্জামান বাবুর সাথে সভা মঞ্চে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম মহসিন রেজার উদ্ধত আচরণে হতভম্ব দলের নেতাকর্মীরা। খুলনা-৬ আসনের সার্বিক উন্নয়ন, দূর্যোগ, দুর্বিপাকে মানুষের পাশে থাকা, সংগঠন কে গতিশীল করা এবং দল-মত নির্বিশেষে মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন এই সাংসদ। পটুয়াখালী-৩ আসনের সাত বারের এমপি আ স ম ফিরোজের সাথে বাউফল পৌরসভার মেয়র, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জিয়াউল হক জুয়েল এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব হাওলাদার এর বিরোধ এখন প্রকাশ্যে। অথচ এতদিন পটুয়াখালী এবং বাউফলে আ স ম ফিরোজ ছিলেন সকলের মধ্যমণি।

 

কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের টানা তিন বারের এমপি আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় অজয় কর খোকন সহ অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা একাট্টা। জেলা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতার অবস্থান বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে। রাজশাহী-৪ আসনের এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে প্রায় এক ডজন নেতা এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন। কুষ্টিয়ার সাংসদ, যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জের সাথে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব সদর উদ্দীন খান এবং সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আজগর আলীর বিরোধ এখন প্রকাশ্যে দলের কর্মসূচীতে আলাদা আলাদা মঞ্চে একে অপরের বিরুদ্ধে যে ভাষায় কথা বলেছেন তা স্পষ্টভাবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের শামিল। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ এবং প্রতিবেদন অনুসারে এমন বিরোধ রয়েছে প্রায় শতাধিক আসনে। এসব আসনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ যেন আওয়ামী লীগ। এসব আসনগুলোতে দলীয় কর্মসূচীতে সরকারের উন্নয়ন এবং বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড, ষড়যন্ত্র এবং অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এমপি গ্রুপ এবং এমপি বিরোধী গ্রুপ সরব না হলেও একে অপরের বিরুদ্ধে সমালোচনায় তারা সরব।

এটা ঠিক কোনো কোনো এমপির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, ত্যাগী এবং পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন এবং দলের মধ্যে নিজস্ব বলয় সৃষ্টির মত সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। অনেকে দলের নেতাকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, অনেকের জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার মত অসংখ্য কারণ তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেছেন। তবে নিজে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য  সভা, সমাবেশে ওপেন মঞ্চে নিজ দলের এমপিদের বিরুদ্ধে এরুপ সমালোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? দলের গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন নয় কি? দলের বর্ধিত সভা এবং কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিংয়ে এসব বিষয় উপস্থাপন করা যেতে পারে। দলের এমপি কিংবা কোনো নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে দলের প্রধান বরাবর লিখিত অভিযোগ করার ও সুযোগ রয়েছে দলের গঠনতন্ত্রে। সবাই যখন ব্যস্ত নিজেদের মনোনয়ন তদবিরে, নারায়নগঞ্জ-৪ আসনের এমপি তখন দলীয় প্রধান কে চিঠি লিখেছেন তাকে মনোনয়ন না দিতে। দল এবং দলীয় প্রধান মনোনয়ন না দিয়ে দলের এই ক্রান্তিকালে তাকে অন্যভাবে কাজে লাগাতে চাইলে তিনি প্রস্তুত আছেন দলের স্বার্থে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রা কে থামিয়ে দিতে ৭৫'র মত দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা এক হয়ে ষড়যন্ত্র করছে সরকারের বিরুদ্ধে। একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশের সরকার, আদালত, প্রশাসন এবং নির্বাচন বিষয়ে যেভাবে একটি দেশের রাষ্ট্রদূত কথা বলেন তা কোনোভাবেই তিনি পারেন না।  প্রতিনিয়ত তিনি স্যাংশনের হুমকি দেন। অথচ বিরোধী দলসমূহ তাকে বাহবা দেয়, ইন্ধন দেয়। তারা চায় আরও স্যাংশন, আরও অবরোধ, আরও নিষেধাজ্ঞা! দেশের যাই হোক! তাদের চাই ক্ষমতা। সরকারের এখন চরম ক্রান্তিকালে আওয়ামী লীগ নেতাদের এখন সময় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, রাজপথ নিজেদের দখলে রাখার। একে অপরের সমালোচনা করার সময় এখন নয়। নিজের জন্য মনোনয়ন তদবির নয়, নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নয়। দেশ এবং দলের বৃহত্তর স্বার্থে স্যাক্রিফাইস করার জন্য প্রস্তুতি নেন, সবাই এক একজন শামীম ওসমান হোন।

লেখকঃ মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: