ঢাকা | শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ : যেসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনো

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২২ মে ২০২৫ ২৩:৩৮

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২২ মে ২০২৫ ২৩:৩৮

গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামের একটি পর্যটন কেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হয়। ভারত হামলার জন্য প্রতিবেশি দেশ পাকিস্তানের একটি জঙ্গি সংগঠনকে সরাসরি দায়ী করলেও আজ পর্যন্ত কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। সৌদি আরব সফর বাতিল করে বাদশাহ সালমানের মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ না নিয়েই উড়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নয়াদিল্লি বিমানবন্দরেই মন্ত্রিসভার বৈঠক আহ্বান করে সেনাবাহিনীকে সব ক্ষমতা দিয়ে দিলেন পাকিস্তানে হামলা চালানোর জন্য। প্রতিবেশি দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলো আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে তাৎক্ষণিক যুদ্ধ বিরতিতে চলে গেল উভয় দেশ। সেই হামলার প্রায় ১৫ দিন পর ভারত সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে থাকা নয়টি স্থাপনাকে টার্গেট করে সামরিক অভিযান চালায়। ভারত দাবি করেছে, টার্গেট করা ওই স্থাপনাগুলো ছিল ‘জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে’। অথচ হামলার জন্য ভারতের ভাষায় কথিত জঙ্গিরা অধরাই থেকে গেল। তাহলে কেন এই যুদ্ধ।

ভারত ও পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উর্দ্ধৃতি দিয়ে ‘পাকিস্তান টাইমস’ আজ এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।

এরপরই সীমান্তের ওপার থেকে ড্রোন দিয়ে হামলা চালায় পাকিস্তান। এই সংঘর্ষ চলাকালীন এবং তার পরেও উভরপক্ষের বহু দাবি জানানো হয়েছে, অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগও উঠেছে। এর মধ্যে কিছু দাবি যাচাই করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগই এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।

পাশাপাশি অনেক সামরিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্ন রয়েছে যার সরাসরি কোনো উত্তর এখনো মেলেনি। প্রতিরক্ষা, কূটনীতি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এমনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করেছে পাকিস্তান টাইমস।

পেহেলগাম হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে চিহ্নিত করেছিল জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ। এদের মধ্যে একজন কাশ্মীরি ও দু’জন পাকিস্তানি ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছিল।

এদের মধ্যে আদিল হুসেন ঠোকার, হাশিম মুসা ওরফে সুলেমান এবং আলি ভাই ওরফে তালহা ভাই বলেও পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এদের সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার জন্য ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়।

পরে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, সন্ত্রাসীরা আমাদের বোনেদের সিঁদুর মুছে দিয়েছে। তাই ভারত এই সন্ত্রাসের সদর দফতরকেই ধ্বংস করেছে। ভারতের এই হামলায় শতাধিক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।

সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) জীবন রাজপুরোহিতের কাছে এই একই প্রশ্ন করেছিল পাকিস্তান টাইমস। উত্তরে ব্রিগেডিয়ার রাজপুরোহিত বলেছেন, এই সন্ত্রাসীদের নির্মূল করা কঠিন। কারণ, তাদের চারপাশে স্থানীয় সমর্থকদের একটা নেটওয়ার্ক রয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা পাকিস্তানের কাছ থেকে সাহায্য পায়।

'এই দুটি কারণে ভারতের জন্য সন্ত্রাসবাদকে একেবারে গোড়া থেকে উৎখাত করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসবাদ একটা কাঠামো। তাই সন্ত্রাসবাদের শিকড়কে উপড়ে ফেলতে হলে শুধু সন্ত্রাসীদের হত্যা করাই যথেষ্ট নয়, বরং যে কাঠামো এটা পরিচালনা করে সেটা গুঁড়িয়ে ফেলা দরকার।’

তিনি বলছেন, এই সন্ত্রাসীদের হত্যার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো পাকিস্তানে এই গোটা মতাদর্শের অবসান করা। কয়েকজন সন্ত্রাসীকে হত্যা করে সন্ত্রাসবাদের মূলে আঘাত হানা যাবে না।

আন্তঃসীমান্ত হামলায় বেসামরিক নাগরিক ও নিরাপত্তাকর্মীরাও নিহত হয়েছেন এবং বিবিসিসহ বেশ কয়েকটা গণমাধ্যম নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে। তবে নিহতদের সম্পর্কে কোনো সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি ভারত।

এখানে যে প্রশ্নটা উঠছে তা হলো, যখন সীমান্তে গোলাগুলি চলার আশঙ্কা ছিল, তখন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কি সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া উচিত ছিল না?

এই প্রশ্নের উত্তরে সেনার এয়ার মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) দীপ্তেন্দু চৌধুরী বলেছেন, এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড রয়েছে। প্রত্যেক রাজ্যের নিজস্ব প্রটোকল থাকে। কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী এলাকায় জনসংখ্যা সবচেয়ে কম। জম্মুতে জনসংখ্যা বেশি এবং পাঞ্জাবে তা সর্বোচ্চ।

‘সীমান্তের কাছাকাছি যারা বাস করেন তারা এর আগেও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। বহু বছর ধরেই তারা গোলাগুলির সম্মুখীন হচ্ছেন। সেখানকার মানুষ আগে থেকেই প্রস্তুত থাকেন। সেখানে বাংকার আছে। নানান গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাও আছে। যখন সাইরেন বেজে ওঠে বা ব্ল্যাকআউট হয়, তখন তারা জানে কী করতে হবে।’

তাই নতুন করে সরিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি ভারত সরকার। তবে যুদ্ধের আশঙ্কা বৃদ্ধি হলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয় বলে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।

তিনি বলেছেন, যখন যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ে বা সেনা মোতায়েনের পরিমাণ বাড়তে থাকে, তখনই সেখান থেকে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার হয়। সীমান্ত এলাকা খালি করা হয়।

এর জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়। কিন্তু যেহেতু এটা সেই অর্থে যুদ্ধ ছিল না, তাই তেমনটা করা হয়নি। গোলাগুলি হঠাৎ শুরু হয়ে যায়, তাই আগে থেকে সতর্ক করা সম্ভব হয়নি।

জম্মু ও কাশ্মীরের পাম্পোর এলাকায় একটা বিশাল ধাতব টুকরো পাওয়া গিয়েছিল। তবে সেটা কোনো ভারতীয় বিমানের অংশ ছিল কিনা তা অস্বীকার বা নিশ্চিত কোনোটাই করেনি ভারত সরকার।

অন্যদিকে পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা ভারতের রাফাল যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে।

এয়ার মার্শাল একে ভারতীকে সাংবাদিক সম্মেলনে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা কম্ব্যাট পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি এবং ক্ষতি এরই একটা অংশ। আপনার প্রশ্ন করা উচিত, আমরা কি আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি? আমরা কি সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করার লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি? এবং উত্তর হলো- হ্যাঁ।

এয়ার মার্শাল ভারতী সেই সময় বলেছিলেন, এই মুহূর্তে এর চেয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলা যাচ্ছে না। এতে বিরোধীরা লাভবান হতে পারে। হ্যাঁ, আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি আমাদের সব পাইলট দেশে ফিরেছেন।

ভারত পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে কি-না জানতে চাইলে এয়ার মার্শাল একে ভারতী বলেছিলেন, আমাদের ভূখণ্ডে ওদের বিমানকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ আমাদের কাছে নেই।

এয়ার মার্শাল চৌধুরীর মতে, যখন কোনো অভিযান চলে তখন ক্ষয়ক্ষতির কথা জনসমক্ষে জানাতে হবে কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে।

তিনি বলেছেন, উদাহরণস্বরূপ বালাকোটের কথাই ধরুন। তখন আমরা আমাদের অভিযানের সাফল্য নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে প্রস্তুত ছিলাম না। সেই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে তথ্য দিচ্ছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এসেছিল পরে।

‘যতক্ষণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এসেছে, ততক্ষণে ন্যারেটিভ পাল্টে গিয়েছে। দু’দিন পর অভিনন্দনকে (ভারতীয় যুদ্ধবিমানের পাইলট আভিনন্দন বর্তমান) ধরা হয়। এরপরই গোটা বিশ্বের নজর সেদিকে চলে যায়। সন্ত্রাসকে টার্গেট করার ভারতের যে কৌশলগত উদ্দেশ্য ছিল, সেটা ভুলে যাওয়া হয়েছে।’

এয়ার মার্শাল চৌধুরী বলেন, সেনাবাহিনীর ক্ষতি হবে। এটা তাদের কাজের অংশ। হিসাব করা জরুরি নয়। কে কতগুলো বিমান ভূপাতিত করেছে সেটা বড় কথা নয়। মূল কথা হওয়া উচিত- আমরা কি আমাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি কি না? লোকসান তো থাকবেই, কিন্তু কৌশলগত উদ্দেশ্য কি অর্জন করতে পেরেছি? সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত ও পাকিস্তানের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি নিয়ে ঘোষণার আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নিয়ে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন।

তিনি দাবি করেন, তার সরকারের মধ্যস্থতার কারণে দুই দেশ ‘অবিলম্বে এবং সম্পূর্ণভাবে সংঘাত বন্ধ করতে’ সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে ভারত বলছে, পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনের (ডিজিএমও) উদ্যোগে এই যুদ্ধবিরতি হয়েছে। ভারত ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি অস্বীকার না করলেও তা নিশ্চিতও করেনি।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক দিলীপ সিং বিবিসি’র সঙ্গে কথোপকথনের সময় তার অনুমানের কথা প্রকাশ করেছেন।

সিংয়ের মতে, মনে হচ্ছে পাকিস্তান হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তারপর হয়ত ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কথা বলেছে। ভারত হয়তো বলেছে, আমরা প্রস্তুত, কিন্তু এই উদ্যোগটা পাকিস্তানের দিক থেকে আসা উচিত।

‘এরপরই পাকিস্তান তাদের ডিজিএমও-কে ভারতের ডিজিএমও-র সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। আমাদের ডিজিএমও নিশ্চয়ই যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি প্রকাশ করেছিলেন হয়ত। এরপরই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।’

তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক রাখাটা দরকার। সিংয়ের কথায়, ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কিছু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে এই সম্পর্ক কিন্তু শুধু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিবৃতি ও যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর বিরোধী রাজনীতিবিদরা একাধিক প্রশ্ন তুলেছেন। কীভাবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশের জন্য সরকারকে প্রতিনিয়ত চাপও দিচ্ছে তারা। যুদ্ধবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কী ভূমিকা ছিল তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার দাবিও তোলা হয়েছে বিরোধীদের পক্ষ থেকে।

প্রশ্ন উঠছে, এই জাতীয় সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে সরকারের কি বিরোধী দলের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত?

সিং বলেছেন, এটা কোনো প্রোটোকলের অংশ নয়। বেশকিছু বিষয় দেখে সরকারকে এই জাতীয় কৌশলগত ও সামরিক পদক্ষেপে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই যারা এই অভিযানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা সম্ভব হয় না।

‘অভিযানের বিবরণ সবাইকে জানানো হয় না। অভিযান সংক্রান্ত বিবরণ প্রকাশ করলে নিরাপত্তার দিক থেকে একটা বড় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক চন্দ্রচূড় সিং জানিয়েছেন, সামরিক নীতি নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে পরামর্শ করার কোনো নজির নেই।

তিনি বিবিসি’কে বলেন, একবার ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথাই ধরুন। তখনও বিরোধীদের সঙ্গে যুদ্ধের কৌশল নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সংসদীয় ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সংসদে আনা হয় না। যতই সেই নিয়ে পরে আলোচনা করা হোক না কেন।

অধ্যাপক সিং বলছেন, সেনাবাহিনী সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত তারাই নেয় যাদের কাছে অভিযানের বিবরণ এবং সামরিক গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। সুতরাং যুদ্ধবিরতি হবে কি না- সেই নিয়েও বিরোধীদের জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন নেই বলে আমার মনে হয়।a



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: