
অধিকারপত্র বিশেষ প্রতিনিধি
এক সময় চীনের হুবেই প্রদেশের শেননংজিয়া পর্বতমালায় সোনালি মুখের নাক-কাটা বানরদের প্রচুর দেখতে পাওয়া যেতো। মানুষ তাদের বাসস্থান ও জীবিকার প্রয়োজনে বন উজার করায় বানরদের আবাসস্থল হ্রাস পেতে থাকে দ্রুত। একদিকে আবাসস্থল কমে আসা এবং মাংস ও পশমের জন্য নির্বিচারে শিকারের ফলে এই অঞ্চলের বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ১৯৮০-এর দশকেও বেঁচে ছিল মাত্র ৫০০টি বানর। ১৯৮২ সালে শেননংজিয়া জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই অঞ্চলে বেড়ে ওঠা ৪৯ বছর বয়সী একজন রেঞ্জার ফ্যাং জিক্সি, বলেন- মানুষদের পরিবেশ ধ্বংস করা বন্ধ করতে আরও অনেক বছর সময় লেগেছে। এই পাহাড়গুলোতে মানুষ খুবই দরিদ্র ছিল এবং বন্য প্রাণীদের রক্ষা করার কোনও ধারণা তাদের ছিল না। কাঠ কাটা নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও লোকেরা অবৈধভাবে কাঠ কাটছিল। যদি তারা গাছ না কাটত, তাহলে তাদের অর্থ কীভাবে হত? বেঁচে থাকার জন্য এখানে লোকেরা গোপনে শিকারও করত। দীর্ঘ সময় ধরে সচেতনতা তৈরির পরেই স্থানীয় কৃষকদের চেতনা পরিবর্তিত হয়েছিল। এই সচেতনতার একটি অংশ ছিল এই কৃষকদের বন ধ্বংসকারীর পরিবর্তে রক্ষাকারী হওয়ার জন্য বোর্ডে নিয়ে আসা। প্রাণীদের সাহায্য করার জন্য দল গঠন করা হয়। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে পাহাড়ে টহল দেওয়া, শিকারিদের উপর নজর রাখে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বানরগুলি কোথায় আছে তা অনুসন্ধান করা। যাতে গবেষকরা অধ্যয়ন করতে পারেন যে তারা কীভাবে এবং কোথায় ঘুমায়, খাবার খুঁজে বের করে এবং বাচ্চা দেয়। বর্তমানে সংখ্যাটা পৌঁছেছে ১৬০০ তে সংখ্যাটি উন্নতি হয়েছে। সোনালি মুখওয়ালা নাক-কাটা বানরেরা প্রতি দুই বছরে একটি সন্তান দেয়। সব সন্তান বাঁচেও না। গবেষকগণ আশাবাদী দশ বছরের মধ্যে ২০০০–এর মাইলফলক স্পর্শ করবে। শেননংজিয়া ন্যাশনাল পার্ক সায়েন্টিফিক ইনস্টিটিউটের বর্তমান পরিচালক, প্রফেসর ইয়াং জিংইউয়ান বলেন- মানুষ এখন তাদের বন্ধু হয়েছে। ওদের এখন নিরাপদ ঘর আছে, খাবার আছে, পানি আছে। মানুষ আর প্রকৃতি একসঙ্গে বাঁচতে শিখেছে। আজ শেননংজিয়া জাতীয় উদ্যানে গাছের আচ্ছাদন ৯৬%–এরও বেশি, যেখানে এক সময় ছিল মাত্র ৬০%। পাহাড়ের উপর থেকে ড্রোন উড়িয়ে দেখা যায়, বন যেন নতুন করে শ্বাস নিচ্ছে। বানরদের জন্য নির্ধারিত অঞ্চলগুলোতে সাধারণ পর্যটক প্রবেশ করতে পারছেন না। সেখানে শুধু বিজ্ঞানী আর বনকর্মীরা যেতে পারেন গবেষণার জন্য। একসময় যে কৃষকেরা ওই গভীর জঙ্গলে থাকতেন, তাঁদের অন্যত্র পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে, আর তারা এখন চালাচ্ছেন অতিথিশালা, খুঁজে পেয়েছেন নতুন জীবন।
বানরের ভাষা বুঝতে পারা এক মানুষের গল্প-
"ইয়ে" মানে "এখানে নিরাপদ, চলে আসো" আর "উ-কা" মানে "বিপদ আছে, সাবধান!" — বানরদের এই ডাকগুলো এখন অনায়াসে বুঝে ফেলেন প্রফেসর ইয়াং। তিনি বলেন, "এরা কেবল গাছে ঘুরে বেড়ানো প্রাণী নয়, এদের সমাজ আছে, পরিবার আছে, প্রেম আছে, এমনকি বিদ্রোহও আছে। এই বানরদের সমাজ ব্যবস্থায় এক পুরুষের তিন থেকে পাঁচটি স্ত্রী থাকে, থাকে তাদের সন্তান। বহু পরিবার মিলে গড়ে ওঠে এক ‘ব্যান্ড’। আবার একক পুরুষ বানররা গঠন করে ‘ব্যাচেলর গ্রুপ’, যারা পাহারা দেয়, রাজনীতি করে, প্রেমে পড়ে, প্রেমে ধোঁকাও খায়!
অরণ্য ধ্বংস থেকে অরণ্য রক্ষা। প্রকৃতি ধ্বংস করেছিল মানুষ, আবার সেই মানুষই হয়ে উঠেছে রক্ষক। এক সময় যে কৃষকেরা জীবিকার জন্য গাছ কাটতেন, এখন তারাই বন রক্ষা বাহিনীর সদস্য। শেননংজিয়া আজ শুধু এক বন নয়, এটি এক নতুন সমাজ গড়ার প্রতীক। যেখানে মানুষ বন ধ্বংস করে আবার বাঁচিয়েও তুলেছে। যেখানে একজন মানুষের ভালোবাসা হাজারো প্রাণ রক্ষা করেছে। এ যেন প্রকৃতির কাছে মানুষের ক্ষমা চাওয়ার এক নিঃশব্দ অনুশোচনা—আর বানরগুলো যেন সেই ক্ষমা গ্রহণ করেছে।
- মো. সাইদুর রহমান, অধিকারপত্র বিশেষ প্রতিনিধি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: