
ভারতের গুজরাট রাজ্যে এশীয় সিংহের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। একসময় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া এই প্রজাতির জন্য এটি নিঃসন্দেহে আশার খবর। মাত্র কয়েক দশক আগেও যেখানে তাদের সংখ্যা ছিল কয়েকশ’র কম। আজ সেখানে কয়েক শতাধিক সিংহ অবাধে বিচরণ করছে। সংরক্ষণ কার্যক্রম, অভয়ারণ্য বিস্তার এবং কঠোর আইন প্রয়োগের ফলেই এ সাফল্য এসেছে।
কিন্তু সুখবরের আড়ালে আছে ভয়ংকর বাস্তবতা। সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিংহেরা ক্রমে মানুষের বসতি, কৃষিজমি এমনকি শহরতলির দিকে চলে আসছে। ফলে বাড়ছে মানুষ-সিংহ সংঘাত। প্রায়শই শোনা যাচ্ছে গবাদিপশু হত্যার খবর, কখনও বা মানুষকেও শিকার করছে এই বন্যপ্রাণী। স্থানীয়রা আতঙ্কে থাকলেও আবার সিংহকে আঘাত করার সাহস পাচ্ছে না। কারণ আইনে সিংহ হত্যা বা আঘাত করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিংহের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য একদিকে ইতিবাচক, অন্যদিকে অভয়ারণ্যের সীমিত পরিসরে এত প্রাণীর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র যেমন একদিকে রক্ষা পাচ্ছে, তেমনি মানুষের জীবন-জীবিকায় নেমে আসছে নতুন সংকট। গুজরাটের অভয়ারণ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, সিংহের জন্য নতুন এলাকা খুঁজে বের করা এখন জরুরি। না হলে মানুষ-সিংহ সংঘাত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
ভারতে সিংহের সাফল্যের গল্প নাকি নতুন আতঙ্ক? গুজরাটের ছোট্ট গ্রামে মাঠে খেলছিল পাঁচ বছরের শিশু পালসিং আজনেড়া। হঠাৎই বন থেকে বেরিয়ে আসে এক সিংহ। মুহূর্তেই শিশুটিকে তুলে নিয়ে যায়। পরিবারের মরিয়া চেষ্টাও কাজে আসেনি। পরে তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি শুধু একটি উদাহরণ। গত এক বছরে ভারতে অন্তত সাতজন সিংহের আক্রমণে নিহত হয়েছেন। গত পাঁচ বছরে এই সংখ্যা ২০ ছাড়িয়েছে। একই সময়ে গবাদিপশুর উপর হামলার ঘটনাও দ্বিগুণ হয়েছে।
সংরক্ষণের সাফল্য: এশীয় সিংহ একসময় বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। তবে শতবর্ষ আগে শিকার নিষিদ্ধ হওয়া ও গত কয়েক দশকে নিবিড় সংরক্ষণ কার্যক্রমের ফলে গুজরাটে তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০০-তে। এটি নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ সাফল্য। গুজরাটের গির ন্যাশনাল পার্ক ও আশপাশের এলাকা এখন বিশ্বের একমাত্র এশীয় সিংহের আবাসস্থল। স্থানীয় Maldhari সম্প্রদায়ও সিংহের সঙ্গে একধরনের সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়েছে। পর্যটন থেকে আয় এবং পুরোনো গবাদিপশু ত্যাগের মতো প্রথা এই সম্পর্ককে টিকিয়ে রেখেছে।
বাড়তে থাকা সংঘাত: সিংহের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা এখন গ্রাম, শহরতলি এমনকি হোটেলের বেসমেন্ট পর্যন্ত চলে আসছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন-প্রাণী যত মানুষের এলাকায় ঢুকছে, ততই আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, গবাদিপশুর উপর আক্রমণ বেড়ে গেছে। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি আতঙ্কও তৈরি হচ্ছে। ফলে দীর্ঘদিনের সহাবস্থানের মডেল ভেঙে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থবির স্থানান্তর পরিকল্পনা: বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সিংহের একটি অংশকে গুজরাটের বাইরে মধ্যপ্রদেশের কুনো অভয়ারণ্যে স্থানান্তরের দাবি জানাচ্ছেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালে সরকারকে “জরুরি ভিত্তিতে” পদক্ষেপ নিতে নির্দেশও দেয়। কিন্তু এক দশক পেরিয়ে গেলেও সিংহ এখনো গুজরাটেই সীমাবদ্ধ। গুজরাট সরকার বিকল্প হিসেবে রাজ্যের ভেতরেই বারদা অভয়ারণ্যে সিংহ স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা-এটি ছোট এলাকা, পর্যাপ্ত শিকারও নেই। উপরন্তু গিরের কাছাকাছি হওয়ায় রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকে যাবে।
অজানা ভবিষ্যৎ: ভারত এখন নিজেকে বিশ্বে বড় বিড়াল প্রজাতির সংরক্ষণে শীর্ষে তুলতে চায়। সিংহ সংরক্ষণের সফল কাহিনি তারই বড় অংশ। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রাণহানি ও গবাদিপশু ক্ষতি দেখিয়ে দিচ্ছে—সাফল্যের সঙ্গে এসেছে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জও। পালসিংয়ের বাবা হীরা আজনেড়া আগে বিশ্বাস করতেন, মানুষ আর সিংহ একসঙ্গে বাঁচতে পারে। কিন্তু ছেলের মৃত্যু তার সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। তিনি ভয়ে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। “আমরা আর সেখানে থাকতে পারিনি। এখন শুধু ভয়”।
ভারতের সিংহসংরক্ষণ আজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত একটি সাফল্যের গল্প। মানুষের সঙ্গে এই সহাবস্থানকে আরও টেকসই করতে প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা ও সুষম পদক্ষেপ। সঠিক উদ্যোগ নিলে সিংহ ও মানুষের সম্পর্ক আবারও হয়ে উঠতে পারে ভারসাম্যপূর্ণ ও গৌরবময়। সহাবস্থানের সুর যদি না ভাঙে, তবে সিংহ আর মানুষ মিলেই লিখবে ভারতের প্রকৃতির নতুন ইতিহাস।
- বিশেষ প্রতিনিধি (Special National Correspondent) মোঃ সাইদুর রহমান (বাবু)
গির ন্যাশনাল পার্ক সিংহ সংখ্যা ভারতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ চ্যালেঞ্জ ভারতে মানুষ সিংহ সংঘাত গুজরাটে এশীয় সিংহ সংরক্ষণ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: