odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 5th November 2025, ৫th November ২০২৫
ক্ষমতার মরুভূমি ও সততার ফোয়ারা: আবু বকর (রা.) থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য সঞ্জীবনী শিক্ষা

আবু বকর (রা.)-এর আয়নায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব: ভোটের আগে শেষ ভাবনা (১ম পর্ব) (

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৫ November ২০২৫ ০২:২৭

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৫ November ২০২৫ ০২:২৭

সম্পাদকীয় বিশ্লেষণ: ত্যাগের মহিমা ও ঐক্যের আহ্বান (১ম পর্ব)

হজরত আবু বকর (রা.)-এর জীবন, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগ থেকে বর্তমান বাংলাদেশি রাজনীতি কী শিখতে পারে? জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে একটি আদর্শিক আলোচনায় আপনার জায়গা খুঁজুন। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে, এই বিশ্লেষণাত্মক সম্পাদকীয়তে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর শাসননীতি, ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে। নেতাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা ও ভোটারদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করে এই নিবন্ধ “The Desert of Power and the Fountain of Honesty: Life-giving Lessons from Abu Bakar (R.A.) for the State of Bangladesh”.

জাতীয় নির্বাচন এখন দোরগোড়ায়। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ প্রতি পাঁচ বছর পর একবার নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ পায়। কিন্তু অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা হচ্ছেন পেশাদার রাজনীতিবিদ। এ লেখা মূলত তাঁদের উদ্দেশেই। যদি বাংলাদেশের নেতৃত্ব হজরত আবু বকর (রা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে, তবে এই দেশ কখনো পথ হারাবে না—বরং দেখতে পাবে মুক্তির আলো।অপরদিকে এই নিবন্ধটি সাধারণ ভোটারদের নেতৃত্ব নির্বাচনে ভোটদানে সহায়তা করবে।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখন অসহিষ্ণুতার কালো মেঘে ঢেকে যায়, যখন রাজনৈতিক অঙ্গনে চলে শুধু বিভেদ আর প্রতিপক্ষের কণ্ঠরোধের নিরন্তর চেষ্টা, ঠিক তখনই ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসে এক শাশ্বত বাতিঘরের বার্তা— হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর প্রজ্ঞাময় শাসন। বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষতবিক্ষত রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁর খিলাফতকাল কেবল একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় নয়, বরং এটি রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শিক মানদণ্ড, এক সঞ্জীবনী মন্ত্র।

হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)— ইসলামের ইতিহাসে এই নামটি কেবল একজন প্রথম খলিফার পরিচয় বহন করে না; এটি বহন করে নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং বিচক্ষণ দূরদর্শিতার এক সমুজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশে জন্ম নেওয়া এই মহামানব জীবিত অবস্থাতেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ‘আশারাতুল মুবাশশারা’র অন্যতম। বর্তমানের দ্বিধাগ্রস্ত, স্বার্থান্বেষী রাজনীতির কণ্টকময় পথে হেঁটে চলা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের নেতা ও শাসকদের জন্য তাঁর জীবন এক আলোকবর্তিকা, এক গভীর অনুধ্যানের বিষয়।

রসুল (সা.)-এর প্রিয় সহচর, জীবিতাবস্থায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত এই মহামানবের জীবন থেকে যে তিনটি মূল শিক্ষা বর্তমান বাংলাদেশি নেতা ও শাসকদের জন্য অপরিহার্য, তা হলো— ১. নিঃশর্ত আত্মত্যাগ; ২. ঐক্যের প্রতিষ্ঠা; এবং ৩. দুর্বলদের প্রতি ন্যায়।

সাকিফার শিক্ষা: অসহিষ্ণুতার বিপরীতে ঐক্যের বন্ধন

রসুল (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলিম উম্মাহর ওপর নেমে এসেছিল এক মহাবিপর্যয় ও নেতৃত্বশূন্যতার চরম সংকট। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যখন মতপার্থক্য তীব্র, যখন গোত্রভিত্তিক নেতৃত্বে ফিরে যাওয়ার পুরাতন প্রথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, ঠিক সেই অস্থির সময়ে আবু বকর (রা.)-এর ভূমিকা ছিল বিভেদ বিনাশকারী ঐক্যের প্রতীক।

তিনি সাকিফার সভায় বিনয়ের সঙ্গে হজরত ওমর (রা.) এবং আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহকে এগিয়ে দিয়ে দেখালেন যে, ক্ষমতা ধরে রাখা তাঁর লক্ষ্য নয়, উম্মাহর স্থিতিশীলতাই তাঁর একমাত্র ব্রত। তাঁর এই নিঃস্বার্থ আত্মসমর্পণ দেখে যখন ওমর (রা.) স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর হাতে আনুগত্যের শপথ নেন, তখন ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিলীন হয়ে উম্মাহ এক বৃহত্তর ঐক্যের পথে হাঁটে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে: আজ যেখানে সামান্য মতভেদেই প্রতিপক্ষকে শত্রু জ্ঞান করা হয়, যেখানে আলোচনার টেবিলে বসার ধৈর্য নেই, সেখানে আবু বকর (রা.)-এর জীবন শেখায়— বিভেদের আগুনে ঘি না ঢেলে, শাসককে হতে হবে ঐক্যের শীতল ফোয়ারা। অসহিষ্ণুতা নয়, বিনয় এবং প্রজ্ঞার মাধ্যমেই জাতিকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলা সম্ভব।

সম্পদের প্রতি অনীহা: আত্মত্যাগের মাধ্যমে জনকল্যাণ

হজরত আবু বকর (রা.) ছিলেন একজন বিচক্ষণ ব্যবসায়ী, যিনি ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর অর্জিত সব সম্পদ ইসলামের পথে অকাতরে বিলিয়ে দেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, রসুল (সা.)-এর প্রশ্নের জবাবে— ‘(পরিবারবর্গের জন্য রেখেছি) আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে’— শাসক সমাজের জন্য এক কঠিন নৈতিক বার্তা।

এই একটি বাক্যই প্রমাণ করে, ক্ষমতার সিংহাসনে বসার পর একজন নেতার কাছে ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব নয়, বরং ঈমান এবং জনকল্যাণই প্রধান পুঁজি। তিনি বিলাল (রা.)-সহ নির্যাতিত গোলামদের খরিদ করে মুক্তি দিয়েছিলেন, যা প্রমাণ করে রাষ্ট্রের সম্পদের অগ্রাধিকার হলো দুর্বল ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে: বর্তমানে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন দুর্নীতি ও ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করা, তখন আবু বকর (রা.)-এর শিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেয়— ক্ষমতা হলো আমানত। যে নেতা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে তাঁর ‘পারিবারিক ভরণপোষণ’ হিসেবে গণ্য করতে পারেন, কেবল তিনিই জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারেন।

ভণ্ড নবীদের দমন: আদর্শিক আপসহীনতা ও দৃঢ়তা

আবু বকর (রা.)-এর স্বল্পকালীন খিলাফত মোটেও মসৃণ ছিল না। তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল ভণ্ড নবীদের উত্থান এবং জাকাত দিতে অস্বীকারকারী ধর্মত্যাগী গোত্রগুলোর বিদ্রোহ। এই চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে তিনি কঠিন, কিন্তু আদর্শিক আপসহীনতা দেখান। তিনি কোনো প্রকার রাজনৈতিক সুবিধা বা সাময়িক শান্তির জন্য ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে আপস করেননি।

তিনি ছিলেন অন্যায় ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন— তাঁর এই দৃঢ়তাই ইসলামি খেলাফতকে ভেঙে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিল এবং একে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে: মতাদর্শিক দৃঢ়তা মানে অসহিষ্ণুতা নয়, বরং রাষ্ট্রের মূলনীতির প্রতি অবিচল থাকা। আবু বকর (রা.) শিখিয়েছেন, ক্ষমা ও সহনশীলতা থাকতে হবে সাধারণ মানুষের প্রতি, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত্তি ও আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করলে শাসককে হতে হবে সুস্পষ্ট, সুদৃঢ় এবং আপসহীন।

সংকটের নোঙর প্রজ্ঞা

বাংলাদেশের বর্তমান অসহিষ্ণুতার রাজনীতিতে আবু বকরের (রা.) জীবনই হতে পারে রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র বাতিঘর। তাঁর নিঃস্বার্থ ত্যাগ, নেতৃত্ব হস্তান্তরে স্বচ্ছতা (ওমর (রা.)-কে উত্তরসূরি নির্বাচন), এবং সংকটে অবিচল ঐক্যের প্রতিষ্ঠা— এই গুণাবলী বর্তমান শাসকদের মনে করিয়ে দেয়: ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু প্রজ্ঞা চিরন্তন।

আমাদের নেতাদের আজ ব্যক্তিগত ক্ষমতার মোহ ছেড়ে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আবু বকরের (রা.) মতো বিনয় ও ত্যাগের পথে হাঁটতে হবে। তবেই অন্ধকারের এই সময়ে বাংলাদেশ দেখতে পাবে ঐক্য, শান্তি ও সমৃদ্ধির উজ্জ্বল আলো।

✍️ অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

দ্বিতীয় পর্বে পড়ুন নেতৃত্বের দর্পণে আবু বকর (রা.): আজকের রাজনীতিতে কতটা প্রাসঙ্গিক?



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: