odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Sunday, 23rd November 2025, ২৩rd November ২০২৫

শত বছরের নীরবতা এবং আসন্ন মহাবিপর্যয়: আমরা কি প্রস্তুত?

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ২২ November ২০২৫ ২০:৩২

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ২২ November ২০২৫ ২০:৩২

উপসম্পাদকীয় | ঢাকা | ২২ নভেম্বর ২০২৫

গতকাল ২১ নভেম্বর ২০২৫-এর ভূমিকম্পটি হয়তো অনেকের কাছে কেবল কয়েক সেকেন্ডের আতঙ্ক ছিল। কিন্তু ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, এই মৃদু কম্পন আসলে মাটির গভীর তলদেশে চলতে থাকা এক মহাপ্রলয়ের প্রস্তুতিরই ইঙ্গিত। বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা—এই তিনটি বিশাল টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে। এই প্লেটগুলোর বিরামহীন সংঘর্ষ এবং বিগত প্রায় একশ বছরের 'ভূতাত্ত্বিক নীরবতা' আমাদের এমন এক সন্ধিক্ষণে এনে দাঁড় করিয়েছে, যা বিজ্ঞানের ভাষায় 'ক্রিটিক্যাল', আর সাধারণের ভাষায় 'ভয়াবহ'।

মহাবিপর্যয়ের সাইরেন: ১০০ বছরের গাণিতিক হিসাব

ভূমিকম্পের ইতিহাসে 'রিটার্ন পিরিয়ড' বা পুনরাবৃত্তিকাল একটি স্বীকৃত তত্ত্ব। বড় চ্যুতিরেখাগুলোতে (Fault Lines) শক্তি সঞ্চিত হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর তা ভয়ানক আক্রোশে বেরিয়ে আসে। এই অঞ্চলের ইতিহাস বলছে, বড় ভূমিকম্পগুলো প্রায় ১০০ বছরের একটি চক্র মেনে চলে।

সর্বশেষ ১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়িতে ৭.১ মাত্রার যে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল, আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে তার ৯৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ, সেই ১০০ বছরের চক্র পূর্ণ হতে আর মাত্র ৫ বছর বাকি। বিজ্ঞানীদের মতে, আমরা এখন একটি 'সিসমিক গ্যাপ' (Seismic Gap) বা ভূমিকম্পের জন্য অপেক্ষমান সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। মাটির নিচে শিলাস্তরে যে পরিমাণ 'স্ট্রেইন এনার্জি' বা শক্তি জমা হয়েছে, তা যেকোনো মুহূর্তে—আজ, কাল কিংবা ২০৩০ সালের মধ্যে—৭.৫ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে বেরিয়ে আসতে পারে।

ইতিহাস যখন কথা বলে: ১৭৮৭ সালের শিক্ষা

অনেকেই ভাবেন, ভূমিকম্প হয়তো কেবল দালানকোঠাই দুলিয়ে দেয়। কিন্তু ১৭৮৭ সালের মহাদুর্যোগ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, একটি ভূমিকম্প কীভাবে দেশের মানচিত্রই বদলে দিতে পারে।

সে সময় ব্রহ্মপুত্র নদ জামালপুর ও ময়মনসিংহের ওপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে প্রবাহিত হতো। কিন্তু ১৭৮৭ সালের সেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্রের তলদেশ হঠাৎ করে উঁচুতে উঠে যায় (Uplift)। ফলে এই বিশাল নদ তার হাজার বছরের পুরনো পথ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সৃষ্টি হয় নতুন এক প্রমত্তা নদীর, যা আজ 'যমুনা' নামে পরিচিত।

একই ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছে ভাওয়াল ও মধুপুরের গড়। লাল মাটির এই শক্ত টিলাগুলো মূলত টেকটোনিক প্লেটের ধাক্কায় নিচ থেকে ওপরে উঠে আসা ভূমি। আজ ঢাকার উপকন্ঠে যে মধুপুর ফল্ট বা চ্যুতিরেখাটি সুপ্ত অবস্থায় আছে, ১৭৮৭ সালে সেটিই নদীর গতিপথ বদলে দিয়েছিল। ভাবনার বিষয় হলো, সেই একই ফল্ট লাইন যদি আবারও জেগে ওঠে, তবে ঢাকার বুড়িগঙ্গা বা তুরাগের কী দশা হবে? কিংবা ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরের মাটির নিচের অবকাঠামোর কী হবে?

এই মধুপুর ফল্টে একটি ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৪০%-এর বেশি ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে একটি "টাইম বোমার" ওপর বসে আছে: বাংলাদেশে টেকটোনিক প্লেট এবং ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ঢাকার ঝুঁকি: কেয়ামতের মহড়া?

যদি আশঙ্কা সত্যি করে ২০৩০ সালের মধ্যে মধুপুর ফল্ট, ডাউকি ফল্ট কিংবা প্লেট বাউন্ডারি ফল্টে ৭.০ বা ৮.০ মাত্রার কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানে, তবে ঢাকার পরিস্থিতি হবে অকল্পনীয়।

ঢাকা শহরের বিশাল অংশ গড়ে উঠেছে ভরাট করা জলাশয় বা নরম মাটির ওপর। তীব্র কম্পনে এই মাটি পানির মতো তরল হয়ে যেতে পারে, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে 'লিকুইফেকশন' (Liquefaction)। এর ফলে বহুতল ভবনগুলো তাসের ঘরের মতো ভেঙে কিংবা হেলে পড়তে পারে। সরু রাস্তা, জরাজীর্ণ ভবন, এবং মাটির জালের মতো বিছিয়ে থাকা গ্যাসলাইন—সব মিলিয়ে এটি হবে এক জীবন্ত নরক। উদ্ধারকারী যান প্রবেশের সুযোগ থাকবে না, আর আগুনের লেলিহান শিখা পরিস্থিতিকে করে তুলবে বিভীষিকাময়।

বিজ্ঞান যেখানে অসহায়: তওবা আত্মসমর্পণের পথ

ভূতত্ত্ববিদরা প্লেটের গতিবেগ মাপতে পারেন, শক্তির পরিমাণ হিসাব করতে পারেন, ঝুঁকির পূর্বাভাস দিতে পারেন—কিন্তু ভূমিকম্প ঠিক কখন হবে, তা বলার ক্ষমতা বা তা থামানোর সাধ্য আধুনিক বিজ্ঞানের নেই। এই অসহায়ত্বের জায়গাতেই বিজ্ঞানের সীমানা শেষ এবং বিশ্বাসের শুরু।

রিটার্ন পিরিয়ডের এই পরিসংখ্যান এবং মাটির নিচের এই অস্থিরতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা আসলে কতটা নশ্বর। প্রকৃতি যখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে, তখন মানুষের দম্ভ চূর্ণ হয়ে যায়। এই আসন্ন মহাবিপদ থেকে বাঁচার জন্য পার্থিব প্রস্তুতির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিও সমান জরুরি।

মুমিন মাত্রই বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর কোনো গাছের পাতাও আল্লাহর হুকুম ছাড়া নড়ে না। এই যে ১০০ বছর ধরে শক্তি জমা হচ্ছে, তা বিস্ফোরিত হবে নাকি শান্ত থাকবে—তা একমাত্র মহান আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। তাই এই 'ক্রিটিক্যাল' সময়ে আমাদের প্রধান করণীয় হলো সৃষ্টিকর্তার দিকে ফিরে আসা। নিজেদের ভুলত্রুটির জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং তওবা করা।

তবে ইসলাম আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে শেখায়নি। হাদিসের শিক্ষা হলো—"আগে উট বাঁধো, তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করো।" অর্থাৎ, আমাদের যেমন ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করতে হবে, দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে, তেমনি কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে হবে।

শেষ কথা

২০৩০ সাল কোনো চূড়ান্ত সময়সীমা নয়, এটি একটি সতর্কবার্তা। ১৭৮৭ সালের নদী বদল কিংবা ১৯৩০-এর ধ্বংসলীলা—সবই আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত উদাহরণ। এই জনপদের মাটির নিচে এক বিশাল দানব ঘুমিয়ে আছে, যে যেকোনো সময় জাগতে পারে। এখন আমাদের কাজ দুটি—একদিকে বিজ্ঞানের সহায়তায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা, অন্যদিকে ইমানের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করা। হয়তো আমাদের সম্মিলিত তওবা এবং সতর্কতাই পারে আসন্ন এই মহাবিপর্যয় থেকে আমাদের রক্ষা করতে।

✍️ অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: