odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 31st December 2025, ৩১st December ২০২৫
—ব্যঙ্গ, হাস্যরস আর নির্মম বাস্তবতায় লেখা ২০২৫ সালের বাংলাদেশ—যেখানে আশা ছিল হাই-রেজোলিউশন, আর বাস্তবতা লোডিংয়ে আটকে থাকা এক দীর্ঘ ফাইল

২০২৫-এর আয়নায় অপ্রাপ্তির হাল খাতা: যা চেয়েছিলাম আর যা পেলাম — উন্নয়নের শোকেসে বাংলাদেশ

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ৩১ December ২০২৫ ০৪:৩৭

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ৩১ December ২০২৫ ০৪:৩৭

✍️ - সম্পাদকীয় বিশেষণ | ২০২৫ সালের বাংলাদেশএক বছর পর্যালোচনা

লেখাটি রম্য–ব্যঙ্গের ছলে লেখা—হাসুন, ভাবুন; কাউকে লক্ষ্য করে নয়, ডিসক্লেইমার (Disclaimer) পড়ুন। আমরা কী চেয়েছিলাম ২০২৫ সালে, আর কী পেলাম? ডেঙ্গু থেকে ডিজিটাল স্বপ্ন, বাজার থেকে বাকস্বাধীনতা—এই ফিচার পড়ে আপনি হাসবেন, থামবেন, আবার ভাববেন। ২০২৫ সালের বাংলাদেশকে নিয়ে এক তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গাত্মক সম্পাদকীয়—উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, বাজার ও সমাজের বাস্তব চিত্র যেখানে হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে গভীর অপ্রাপ্তি। স্মার্ট বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট মশা—২০২৫ সালের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে ব্যঙ্গ আর বেদনামিশ্রিত এক দীর্ঘ ফিচার, যা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন।

আমরা সবাই জানি, “আশা” আর “বাস্তবতা” দুটো দুন্তুর মতো—দেখে অনেকটা কাছাকাছি, ধরার পর দূরে প্রায় অনন্ত। ২০২৫ সালটা যেন সেই দূরত্বের ওপর খাতা খুলে বসার বছর। খাতা পাতায় পাতায় লিখে ফেলেছি— কি চেয়েছিলাম, আর বাস্তবে কী পেলাম!

শোকবার্তা

২০২৫: উন্নয়নের শব্দ, বাস্তবতার গুনগুনানি

২০২৫-এর হিসাব নিকাশ করতে বসলে অপ্রাপ্তির খাতাটাও নেহায়েত হালকা নয়। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা ভেবেছিলাম, ডেঙ্গু মশা হয়তো ইতিহাসের পাতায় যাবে, যেমন গেছে ডাইনোসর। কিন্তু মশারা ইতিহাস পড়েনি, তারা বিবর্তন পড়েছে। এখনকার মশারা আর সাধারণ প্রাণী না, তারা স্মার্ট। অ্যারোসল স্প্রে করলে তারা মারা যায় না, বরং গায়ে মেখে নেয়, যেন নতুন কোনো ফ্রেঞ্চ পারফিউম। সিটি কর্পোরেশন একসময় মশা মারতে কামান দেগেছিল, ফলাফল হিসেবে মশার সংখ্যা কমেনি, শুধু গুনগুনানির ভলিউম বেড়েছে। এখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, এরা চাইলে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে কোরাসও দিতে পারবে। নাগরিকত্ব পেলে অবাক হব না।

আমরা বাকস্বাধীনতা চেয়েছিলাম, আর সেটি পেয়েছিও। তবে একটি ছোট্ট কিন্তু এখনো লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলা যাবে, কিন্তু তার পরের অধ্যায়টি সম্পূর্ণ শর্তসাপেক্ষ। তাই এখন মানুষ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার আগে তিনবার ভাবে, একবার আয়নায় তাকায়, একবার উকিলের কথা মনে করে। তারপর সাহস সঞ্চয় করে লেখে, শুভ সকাল, সঙ্গে ব্র্যাকেটে স্পষ্ট করে দেয়—এই স্ট্যাটাসটি কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে নয়। সূর্য ওঠার শুভেচ্ছাতেও এখন ডিসক্লেইমার লাগে।

শিক্ষার দিক থেকে আমরা দারুণ এগিয়েছি। জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এমনভাবে বেড়েছে যে, মনে হয় এটি কোনো সংক্রামক রোগ। কিন্তু সাধারণ জ্ঞান জিজ্ঞেস করলেই উত্তর আসে, গুগল করে বলছি। সার্টিফিকেটের ওজন এত বেড়েছে যে ফাইল ধরলে হাত ব্যথা হয়ে যায়, অথচ চাকরির বাজারে সেই ওজন মাপার যন্ত্রটাই নষ্ট। বেকার যুবকরা এখন নিজেদের ফ্রিল্যান্সার বলে পরিচয় দেয় এবং দিন কাটায় ইউটিউবে কিভাবে সহজে বড়লোক হওয়া যায় ধরনের ভিডিও দেখে। বড়লোক এখন আর লক্ষ্য না, একটি টিউটোরিয়াল।

২০২৫ কে বুঝতে পড়ুন —ফিরে দেখা ঘটনাবহুল ২০২৫: জ্যাম, জনতা ও জিলাপির প্যাঁচের বছর

পরিবেশের কথায় আসলে ঢাকার বাতাস নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার দরকার নেই। বাতাস এখন এতই পুষ্টিকর যে, শ্বাস নিলেই এক বেলার খাবার হয়ে যায়। ধুলো, সীসা আর কার্বনের এই রাজকীয় ককটেল আমাদের ফুসফুসকে ইস্পাতের মতো শক্ত করে তুলছে। ডাক্তাররা নতুন সতর্কবার্তা দিচ্ছেন—বিশুদ্ধ বাতাস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ আপনারা দূষণে অভ্যস্ত। আমরা তাই নিশ্চিন্ত, কারণ এই শহরে বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়ার ভয় অন্তত নেই।

উন্নয়ন: সেতু, রেল, স্মার্ট শহর আর রিমোট কন্ট্রোলড কল্পনা

২০২৫ সালের শুরুটা ছিল একরকম স্বপ্নে মোড়া; আকাশে উড়ছিল স্লোগানের ঘুড়ি—“ডিজিটাল, স্মার্ট, টেকসই বাংলাদেশ।” চারদিকে কল্পনার রংতুলি দিয়ে আঁকা হচ্ছিল উন্নয়নের ছবি—আধুনিক অবকাঠামো, উড়ালসেতু, ফ্লাইওভারে ছুটে চলা গাড়ি, আর রোবট-চালিত ট্রাফিক সিগনালে থেমে থাকা শৃঙ্খলিত নগরবাসী। আমরা যেন অপেক্ষা করছিলাম এক 'স্মার্ট' শহরের, যেখানে রাস্তার মোড়ে পাবো ওয়াই-ফাই, আর বৃষ্টির দিনে ড্রেনের পানি থাকবে শুধুই স্মৃতিতে।

কিন্তু বাস্তবতা ছিল একটু ভিন্ন, বরং বলতে হয়—পরিহাসে ভরা। “উন্নয়ন” নামের হাতিকে গলায় বেল ফেলে ঘোরানো শুরু হলো নানা প্রকল্পে, যার কোনোটি শেষ হয় না, আবার কোনোটি শুরুই হয় যেন শেষের প্রস্তুতি নিয়ে। একটি সেতু উদ্বোধনের দু’সপ্তাহের মাথায় নিচে ফাটল দেখা দিল, আর ফ্লাইওভারের ঠিক মাঝখানে দেখা গেল এমন গর্ত, যা দিয়ে মনে হয়, নিচের তলার গর্তগুলোও হিংসে করতে পারে। রেললাইনগুলোতে ট্রেন নয়, যেন “গণভ্রমণ” চলতে থাকে—যেখানে ছাদ থেকে জানালা পর্যন্ত মানবশৃঙ্খল!

এক ভদ্রলোক মজা করে বলেছিলেন, “ফ্লাইওভার চাইছিলাম, পেলাম ‘ক্রশওভার’। এখন প্রতিদিন রাস্তা পার হই, মনে হয় অ্যাকশন সিনেমার স্টান্ট করছি।” ট্রাফিক জ্যাম এমন যে, গুগল ম্যাপও হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, “ভাই, নিজেই দেখেন!” ড্রাইভারদের মানসিকতায় একধরনের মেটাফোর জন্ম নিয়েছে—তারা ভাবে, ফ্লাইওভার মানে গাড়ি উড়ে যাবে; কিন্তু বাস্তবে গাড়ি না উড়ে, চালকের মুখ দিয়ে ধোঁয়া ওঠে।

এদিকে ডিজিটাল স্বপ্ন ছিল আরেক গল্প। সরকারি ওয়েবসাইটগুলো ডিজিটাল না হয়ে যেন ডিজিট্যালিক হয়ে গেছে। যেখানে লগইন করতে গেলেই দেখা যায়—"ত্রুটি: আপনার ব্রাউজার সমর্থিত নয়"—মনে হয়, ব্রাউজার যদি দেশ হত, তাহলে দেশও লগইন করতে পারত না! ডিজিটাল আইডি পেতে গেলে এত তথ্য জমা দিতে হয়, মনে হয় NSA-ও এত প্রশ্ন করে না। অথচ এসব তথ্য সংরক্ষণ হয় এমন সার্ভারে, যা বছরে তিনবার বিদ্যুৎ চলে গেলে রিকভারি হয় না।

এই ছিল ২০২৫-এর উন্নয়নচিত্র—স্বপ্নে স্মার্টনেস, বাস্তবে গর্ত; পরিকল্পনায় ফ্লাই, বাস্তবে ক্রাশ; আর ঘোষণায় ‘স্মার্ট সিটি’, বাস্তবে রাস্তার মোড়ে ফাটা ওয়াই-ফাই সাইনবোর্ড আর ভাঙ্গা ইন্টারনেট সংযোগ। এমন উন্নয়নের খাতায় লেখা থাকে অপ্রাপ্তির ইতিহাস, যেখানে প্রতিটি পাতাই একেকটি জনগণের দীর্ঘশ্বাসে লেখা ব্যঙ্গকবিতা।

২. বাজার আর পণ্যের মূল্য: পেঁয়াজ, মাংস, ডিম ড্রামাটিক লাভ‑লোকসান

২০২৫ সালে বাজারে ঢোকা মানে শুধু দরদাম জানা নয়, একপ্রকার নাট্যচর্চা অভ্যাস করা। মনে হয় না যেন বাজারে গেছি, বরং ঢুকে পড়েছি কোনো ড্রামা সিরিজের লাইভ সেটে—সেখানে প্রতিদিনই নতুন পর্ব, নতুন চমক। একদিন দাম বাড়ে, আরেকদিন হৃদকম্পন। বিশেষ করে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে তো পুরো একটা বায়োপিক বানিয়ে ফেলা যায়—"পেঁয়াজ: এক আর্দ্র অভিজ্ঞান"।

শুনেছি, কোনো এক বিকেলে পেঁয়াজের দাম যখন ১০০ টাকা ছাড়াল, তখন এক নিউজপোর্টাল হেডলাইন করেছিল—"পেঁয়াজ ১০০, মনোবল ২০০, স্বপ্ন অমূল্য"। এমনকি কেউ কেউ গুজব রটাতে লাগলো—কয়েকটা পেঁয়াজ নাকি নিজের নামে আইপিও ছাড়ার পরিকল্পনা করেছে। কারও কারও বাড়িতে পেঁয়াজ লুকিয়ে রাখার আলাদা লকার তৈরি হয়েছে, যেন এটা সোনা নয়, রান্নাঘরের রাজা!

ডিমও পিছিয়ে নেই। তারও নাটকীয়তা কম নয়। দাম যখন ক্রমাগত বাড়তে থাকল, তখন পরিবারের নতুন বউ ঘোষণা দিল, “এই সংসারে আমি ডিম কিনতে দেব না, আমি নিজেই ‘ডিমিটিউর’, প্রাকৃতিক!” এটা শুনে পাশের পাড়ার সুশীল ভদ্রলোক তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, “ডিম এখন শুধু প্রোটিন না, একটা ক্লাস স্টেটমেন্ট!”

বাজারে ঢুকেই যখন দেখেন, মাংসের দোকানদার কেজির দাম বলার আগে এক ধরনের নাটকীয় দম নেয়—মনে হয় যেন কোনো পুরস্কার ঘোষণার আগে সঞ্চালক যেমন করে তেমন। বলেন, “ভাই, কেজি সাতশ, কিন্তু আপনাকে বলছি ছয়শত নিন, কারণ আপনি আমার ভাই।” আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা ফিসফিস করে বলে, “কালই তো পাচশো বলেছিল!”

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো বাজার মনিটরিং বোর্ড। ওরা যেন মনিটর না করে, বরং একটা অনলাইন গেম শো চালাচ্ছে, যেখানে জনগণ শুধু রিঅ্যাকশন দেবে। মাঝে মাঝে বোর্ড থেকে বলা হয়, “আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।” কী পর্যবেক্ষণ করছেন? হয়ত তারা দেখছে, কোন দোকানি আজ কত দ্রুত দামের তকমা বদলাচ্ছেন!

এই যদি হয় আমাদের পণ্যের বাজারচিত্র, তবে বাজারে যাওয়া মানেই যেন এক লাইভ কমেডি শো দেখা, যেখানে প্রতিদিনই নতুন সংলাপ, নতুন চরিত্র আর নতুন মূল্যতালিকা। জনগণ শুধু দর্শক, আর প্রতিটি রশিদ যেন একেকটা টিকিট—ড্রামাটিক লোকসানে প্রবেশের পাস।

৩. স্বাস্থ্যসেবা: রোগী, ডাক্তার আর টেস্টের মেলায় করুণা

২০২৫ সালের স্বাস্থ্যসেবার গল্পটা একেবারেই রুগ্ণ ব্যঙ্গকাব্য। দেশের হাসপাতালগুলো যেন রোগী নয়, টেস্টের জন্য প্রাণপণে অপেক্ষায় থাকে। আগে যেখানে ডাক্তার বলতেন “কি সমস্যা?”, এখন প্রথমেই বলেন, “এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, প্যানিক অ্যাটাক টেস্ট—সব করে নেন, তারপর দেখা হবে।” যেন রোগী নয়, এক ধরনের পরীক্ষার কেন্দ্রভুক্ত নমুনা।

মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, আমরা কি চিকিৎসা নিতে এসেছি, না কোনো কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি? একজন রোগী তো হাল ছেড়ে দিয়ে বলেই ফেলল, “ভাই, আমি তো আর গায়ে জ্বর নিয়ে এসেছি, না এসেছি বিখ্যাত হোয়াজি গ্রন্থির গবেষণায়। তাও যে পরিমাণ টেস্ট করাল, মনে হচ্ছে আমি NASA-র মঙ্গলগ্রহ অভিযানের অংশ!”

একটি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম, হাসপাতালের মূল ফটকে লেখা আছে “সেবাই ধর্ম”—কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই বোঝা যায়, সেবাটা যেন ক্লাউডে আপলোড হয়ে গেছে। নার্সরা ব্যস্ত, ডাক্তাররা ব্যস্ততর, আর রোগী? তিনি যেন কোনো এপয়েন্টমেন্টের প্রপস। যারা একটু "সিরিয়াস" নয়, তাদের জন্য তো সোজা "রেফার"—যেন চিকিৎসা নয়, হাত বদলের খেলা চলছে।

এক রোগী বলছিলেন, “হাসপাতালটা এমন হয়ে গেছে, ভাবছিলাম খাবার অর্ডার করবো কি না। রুগীর নাম বললেই তো মেন্যু আসে—কোন টেস্ট, কোন কন্সালটেন্ট, কত টাকা।” সেই মেন্যু দেখে মনে হয় না আপনি চিকিৎসা নিচ্ছেন, মনে হয় কোনো ল্যাব ফ্র্যাঞ্চাইজির ফাইনান্সিয়াল প্যাকেজ দেখছেন। এমনকি অনেক ডাক্তার এখন রোগীর গল্প নয়, রোগীর আয় দেখতে চান—কোন ব্যাংকে একাউন্ট, কার্ড আছে কিনা, স্বাস্থ্যবিমা আছে তো?

একবার এক জরুরি রোগী এসে বলল, “জ্বর ১০৩, গায়ে ব্যথা, হাঁটতে পারি না।” ডাক্তার বললেন, “বেশ, আগে CBC, ESR, LFT, KFT, ECG, ECHO, MRI করে আসুন।” রোগী অবাক হয়ে বলল, “ডাক্তার সাহেব, আমি তো মৃত্যুর কাছাকাছি, MRI করতে গেলে ততক্ষণে হয়তো RIP হয়ে যাব!” ডাক্তার চোখ তুললেন না, শুধু বললেন, “সব নিয়ম অনুযায়ী হতে হবে ভাই।”

এই হলো ২০২৫-এর স্বাস্থ্যচিত্র, যেখানে মানুষ আগে রুগী হয় না—প্রথমে হয় টেস্ট কাস্টমার, তারপর হয় মানসিক রোগী। চিকিৎসা একটা কমার্স, রুগী হয়ে গেছে এক বাণিজ্যিক প্রকল্প। আর যে চিকিৎসাবিদ্যা একসময় ছিল মানবতার সেরা উদাহরণ, তা এখন ল্যাব রিপোর্ট নির্ভর এক ভয়ঙ্কর ঠাট্টায় পরিণত হয়েছে।

৪. শিক্ষা: স্মার্টবোর্ডের স্বপ্নে খোয়া‑খাওয়া ক্লাসরুম

শিক্ষা খাতে আমাদের স্বপ্নটা ছিল বেশ হাই-ফাই। ক্লাসরুমে ঢুকলেই স্মার্টবোর্ড জ্বলে উঠবে, শিক্ষক ট্যাবলেটে স্লাইড খুলবেন, আর ছাত্ররা চোখ বড় বড় করে জ্ঞান গিলবে। কিন্তু বাস্তবটা এমন যে, স্মার্টবোর্ডটা দেয়ালে ঝুলে আছে একেবারে ফটোফ্রেমের মতো। ক্লাস শুরু হতেই শিক্ষক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, পাওয়ার নেই স্যার। বিদ্যুৎ অফিস বুঝি নতুন পাঠ্যক্রমে বিশ্বাস করে না।

পাওয়ারের পর আসে ইন্টারনেটের পালা। আধুনিক শিক্ষা মানেই অনলাইন ক্লাস, এই কথাটা সবাই মুখস্থ। কিন্তু ইন্টারনেট নামের ভদ্রলোকটি ক্লাস টাইমে লুকোচুরি খেলতে ভালোবাসে। শিক্ষক বলেন, আজ অনলাইন ক্লাস পেন্ডিং, ইন্টারনেট নাই। ছাত্ররা মনে মনে ভাবে, ইন্টারনেট বোধহয় সিলেবাস শেষ না করে আর আসে না।

বইয়ের কথাও কম নাটকীয় নয়। বই আসে দেরিতে, আসে ভুল বানানে, আসে এমন সব প্রশ্ন নিয়ে, যেগুলো দেখে প্রশ্নই প্রশ্ন হয়ে যায়। পরীক্ষায় সেই ভুলই আবার ঠিক হিসেবে ধরা পড়ে। কোনো সাহসী ছাত্র আঙুল তুলে বলে, স্যার, এটা তো ভুল। শিক্ষক ঠাণ্ডা গলায় বলেন, ভালো করে পড়ো, এটা নতুন পাঠ্যক্রমের অংশ। তখন ছাত্ররা ধীরে ধীরে বুঝে নেয়, নতুন পাঠ্যক্রম মানে পুরোনো ভুলগুলোকে নতুন করে সাজানো।

আরো পড়ুন: শিক্ষা, জিপিএ-৫ আর কোচিং—আমরা কোথায় যাচ্ছি? বঙ্কিমের প্রশ্ন + নজরুলের বজ্র= আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার আয়না।

একদিন এক শিক্ষার্থী খুব গম্ভীর মুখে বলল, আমার স্মার্টফোনই এখন আমার শিক্ষক। সে ইউটিউব খুলে বোঝায়, গুগল খুলে শেখায়। কিন্তু মজার ব্যাপার, সেই স্মার্টফোনও মাঝেমধ্যে বলে ওঠে, স্যার, লাইট অফ। তখন বোঝা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে স্মার্ট জিনিসটা এখনো অন্ধকারে বসেই পড়াশোনা করতে শিখে গেছে।

৫. রাজনীতি নির্বাচনী প্রক্রিয়া: আশা, প্রতিজ্ঞা আর ব্যর্থ কালো প্রেমিকা

২০২৫ সালের রাজনীতিকে যদি একটি নাট্যধর্মী ধারাবাহিক ধরা হয়, তবে সেটির নাম হওয়া উচিত—“প্রতিশ্রুতি প্রোডাকশনস প্রেজেন্টস: গণতন্ত্রের গোপন প্রেম”। এখানে রাজনীতিকরা সবাই মঞ্চে প্রস্তুত, মুখস্থ করা সংলাপ ঠোঁটে, চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের রঙ। কিন্তু যেই দর্শক ভোট দিতে চায়, সে যেন হলঘরে বসে থাকা একমাত্র লোক, যার হাতে টিকিট আছে, কিন্তু ঢুকতে পারছে না—কারণ তার মুখে মাস্ক নেই, অথবা দলীয় অনুমতি নেই।

আমরা চেয়েছিলাম স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি রাজনৈতিক পরিবেশ। যেখানে সাধারণ মানুষ অংশ নেবে, রাজনৈতিক বিতর্ক হবে যুক্তিভিত্তিক, আর নির্বাচন হবে উৎসবমুখর। কিন্তু বাস্তবে কী পেলাম? নির্বাচনের আগে দেখা গেল, একটি পক্ষ বলছে—“আমরা প্রস্তুত, মাঠে নামব।” অন্য পক্ষ তখন ব্যস্ত “শর্তপত্র” সাজাতে। সে শর্তের এমন পরিমাণ ও জটিলতা যে মনে হয়, কেউ আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে যাচ্ছে—‘আমাদের সাথে নির্বাচন করতে চাইলে সূর্য পশ্চিমে উঠতে হবে, ছায়া হতে হবে গোলাপি, আর ক্যালেন্ডারে থাকতে হবে ৩৩তম দিন।’

যখন নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসে, তখন একদল ভোটার খুঁজে পায় না কেন্দ্রে যাওয়ার উৎসাহ, আর অন্যদল ভোট দেয় এমন উদ্দীপনায় যেন তারা এই ভোটের মাধ্যমে তাদের বোনের বিয়ের বর নির্ধারণ করছে। রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা তখন বিশ্লেষণ করেন—“এটি একটি গণতান্ত্রিক বিজয়”, অথচ পাশে বসে থাকা সাধারণ ভোটার ফিসফিস করে বলেন, “ভাই, এখানে ভোট নয়, এইটা লুকিয়ে খুঁজির খেলা!”

রাজনীতিকরা যেন প্রেমিক, যারা প্রতিবার ভোটের আগে এসে বলে—“এইবার সব বদলাবে, তোমার জন্য দেশের মানচিত্রে নতুন ভোর আনব।” কিন্তু ভোটের পর প্রেমিকার মতোই তারা হয় উধাও, নয়তো ছুটিতে যায়—ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট নিয়ে উন্নয়নশীল দেশে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে। জনগণ তখন শুধু বসে থাকে—হাতের মোবাইলে “স্মার্ট বাংলাদেশ” নামক একটি অ্যাপে লগইন করতে চায়, কিন্তু অ্যাপ বলে—“আপনার এলাকার প্রতিনিধির সার্ভার ব্যস্ত, অনুগ্রহ করে পাঁচ বছর অপেক্ষা করুন।”

২০২৫-এর রাজনীতির এই যে নাটকীয় বিভ্রান্তি, এতে একটাই নিশ্চিত—জনগণ সব জানে, তবুও চুপ করে থাকে। রাজনীতিকদের প্রতিশ্রুতি শুনে তারা এখন আর উত্তেজিত হয় না; বরং বলে, “ওদের কথা শুনলেই মনে পড়ে পুরনো প্রেমিকার কথা—প্রতিশ্রুতি অনেক, বাস্তবতায় ব্যর্থ; তারপরও বারে বারে ফিরে আসার কৌশল আছে!” সেই ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি নিয়েই চলছে আমাদের গণতন্ত্র—মাথায় মুকুট আছে, মনের মধ্যে সংশয়, আর পায়ের নিচে জনগণের চাপা দীর্ঘশ্বাস।

৬. নিরাপত্তা: রাস্তা, ট্রাফিক আর পকেটের নিরাপত্তা

নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের স্বপ্নটা ছিল বেশ সোজাসাপটা। রাস্তায় নামব, গন্তব্যে পৌঁছাব, পকেট ঠিক থাকবে, মাথার ওপর আকাশ আর নিচে আইন। কিন্তু বাস্তবে রাস্তায় নামলেই রাস্তা নিজেই প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, এই কোন্ মোড়ে আপনি হচ্ছেন। বাঁকগুলো এমনভাবে ঘুরে দাঁড়ায় যে গুগল ম্যাপও একসময় হাল ছেড়ে দেয়। মনে হয়, রাস্তা নয়, এগুলো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রাণী, যাদের নিজস্ব মতামত আছে।

ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে দেখা হলে নিরাপত্তার অনুভূতিটা আরও গভীর হয়। তিনি সোজা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনার গতি কি বলবে। গাড়ির স্পিডোমিটার তখন লজ্জায় মাথা নিচু করে। চালক ভাবে, গতি যদি কথা বলত, সে নিশ্চয়ই বলত, আমিও জানি না স্যার, এই রাস্তায় আমি কতটুকু দ্রুত।

এর মধ্যেই হেলমেট পরা এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসে। প্রথমে মনে হয়, সচেতন নাগরিক। পরে বোঝা যায়, তিনি ছিনতাইকারী। হাসিমুখে বলেন, আপনি নিরাপদ, আমি নিরাপত্তা। তখন বুঝি, এখানে নিরাপত্তা একটা অনুভূতি নয়, একটা ঘোষণা। যিনি যত জোরে বলেন, তিনিই তত নিরাপদ।

এক ভদ্রলোক আক্ষেপ করে বলছিলেন, আজ আমি গাড়িতে চড়লাম নিরাপদে, মানে অক্ষত শরীরে নামতে পেরেছি। কিন্তু তার মনে হয়, নেটফ্লিক্সের সার্ভার করপোরেট নিরাপত্তা আমাদের শহরের চেয়ে বেশি। অন্তত সেখানে কেউ মাঝপথে সিগন্যাল কেটে দেয় না, আর পাসওয়ার্ড ছাড়া ঢোকাও যায় না।

আর বাসে ওঠা মানে এক ধরনের মানসিক সাধনা। দাঁড়িয়ে থাকা, আবার দাঁড়িয়ে থাকা, এমন দাঁড়িয়ে থাকা যে পা দুটো নিজেই নামতে চায়। নামার সময় মনে হয়, এটা লোকাল স্টপ না মনাল্লা স্টপ, ঠিক বোঝা যায় না। শুধু বোঝা যায়, আপনি যদি অক্ষত নেমে আসেন, তবে আজকের নিরাপত্তা অধ্যায়টা পাস।

. অর্থনীতি বেকারত্ব: চাকরি, ইনফ্লেশন আর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স

২০২৫ সালের অর্থনীতি আর বেকারত্বের গল্পটা যেন এক পকেটছেঁড়া প্যান্টের আত্মজীবনী—যেখানে প্রতিশ্রুতি অনেক, কিন্তু পকেটটা সব সময়ই খালি থাকে। বছরের শুরুতে আমরা ভেবেছিলাম, এবার বুঝি চাকরির হিমালয় ডিঙিয়ে সাফল্যের মেঘে উঠব। চারদিকে “স্টার্টআপ সংস্কৃতি”, “উদ্যোক্তা উন্নয়ন”, “ডিজিটাল কর্মসংস্থান”—এসব শব্দ এমনভাবে ছড়ানো হয়েছিল, মনে হচ্ছিল যেন প্রতিটি মোড়ে মোড়ে একটা চাকরি লুকিয়ে আছে, শুধু খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষা।

কিন্তু বাস্তবে যা ঘটল, তা অনেকটা “পিপঁড়ের খোঁজে গরু খোঁজার” মতো। হাজার রেজ্যুমি সাবমিট করেও যখন কোনো কল এল না, তখন তরুণরা বুঝে গেল, জীবনে চাকরির চেয়ে ‘ফ্লেক্সিবিলিটি’ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন ইন্টারভিউতে প্রথম প্রশ্ন হয়, “আপনি কি ফ্লেক্সিবল?”—মানে আপনি কি সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা অবধি, চা-নাস্তা ছাড়া সবকিছু করতে প্রস্তুত? মানে আপনি কি চাকরি না পেয়ে হতাশ, কিন্তু চাকরি পেলে আরও হতাশ হবেন?

জীবিকার এই অদ্ভুত গোলকধাঁধায় ঢুকেই এক তরুণ একদিন খুব আবেগ নিয়ে বলেছিল, “যদি একদিন আমার ব্যালেন্স শিটটা প্লাস হয়, আমি আমার স্বপ্নগুলোকে ইনভেস্ট করব!” কিছুদিন পর দেখা গেল, সে নিজের মোবাইল ব্যাঙ্কিং অ্যাপ খুলে দেখে, "ব্যালেন্স এখন আরও কম, কারণ ইন্টারনেট টাইম আউট!" জীবন যে শুধু ইন্টারেস্ট নয়, প্রিন্সিপ্যালও নিয়ে যায়।

আর মূল্যস্ফীতির তো কোনো ছাদ নেই—যেন এক ‘উড়ন্ত মূর্তি’ প্রতিযোগিতা চলছে, কে কতো দ্রুত উঁচুতে যেতে পারে। মুদির দোকানে গিয়ে দেখা যায়, আগের ৫০ টাকায় যে জিনিসপত্রে ব্যাগ ভরে যেত, এখন সেখানে শুধু বিলটিই ভরে। দোকানি বলে, “ভাই, দাম বাড়ছে, আপনি পেঁয়াজ নেন নাকি কিডনি বিক্রি করেন—সিদ্ধান্ত আপনার।”

ব্যাংক ব্যালেন্সের অবস্থা এমন, যেন এটি কোনো অলীক সংখ্যা। একটা সময় ছিল যখন মানুষ ব্যালেন্স দেখে সঞ্চয়ের পরিকল্পনা করত। এখন ব্যালেন্স দেখে মানুষ শুধু ডিপ্রেশন গুনে। ‘প্লাস’ শব্দটা এতটাই অচেনা হয়ে গেছে, যে কেউ মোবাইলে ‘প্লাস’ সিম কিনলে বন্ধু বলে, “তুই তো দেখি বিলিওনিয়ার!”

এমন এক অর্থনীতিতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে “উন্নয়ন” মানে পোস্টার, “কর্মসংস্থান” মানে বক্তৃতা, আর “আর্থিক স্থিতি” মানে পাঁচ মিনিটের ওয়েবিনার। মাঝে মাঝে মনে হয়, অর্থনীতিবিদরা Excel শিটে যে সব ‘সাধারণ উন্নয়ন’ দেখান, তা আসলে ম্যাজিক শো। আর আমরা সেই দর্শক, যারা শুধু হাততালি দেই—কারণ আমাদের কাছে বিকল্প কিছু নেই, হাতে হাততালি ছাড়া।

. সমাজ সংস্কৃতি: শোভা, মিডিয়া আর ট্রেন্ডিং টপিক

২০২৫ সাল মানেই এখন সমাজ আর সংস্কৃতি ট্রেন্ডিং লিস্টে বসবাস করে। আমরা চেয়েছিলাম সামাজিক সচেতনতা, নৈতিক মূল্যবোধ আর সংস্কৃতির একটু উন্নত সংস্করণ। কিন্তু খুলে দেখি, শোভা মানে এখন আর আচরণ না, হ্যাশট্যাগ। যত বেশি হ্যাশ, তত বেশি শোভন। কারো কাজে শালীনতা থাক বা না থাক, ক্যাপশনে দুটো ভারী শব্দ আর তিনটা ইমোজি থাকলেই সে সংস্কৃতিবান।

সচেতনতার সংজ্ঞাটাও আপডেট হয়ে গেছে। আগে মানুষ কিছু বুঝত, ভাবত, তারপর কাজ করত। এখন সচেতনতা মানে শেয়ার, লাইক, কমেন্ট। কেউ কিছু না পড়েই শেয়ার করে দেয়, কারণ লেখা থাকে—এই ছবি শেয়ার করুন, যদি আপনি একজন সচেতন নাগরিক। প্রশ্ন হলো, কেউ কি না শেয়ার করে? সবাই করে। তবে বাস্তবে নয়, কমেন্টে। সেখানে গম্ভীর মুখে লেখা হয়, এটি শেয়ার করা হলো। পোস্ট খুশি, মানুষ দায়মুক্ত।

নৈতিকতার অবস্থাও বেশ ট্রেন্ডি। নৈতিকতা এখন আর চরিত্রে থাকে না, থাকে রিয়্যাকশন লুপে। কে কোন পোস্টে কাঁদছে, কে রেগে যাচ্ছে, কে হাততালি দিচ্ছে—এই দিয়েই বিচার হয় মানুষ কতটা নৈতিক। নীতির চেয়ে নোটিফিকেশন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিক অবস্থান বদলায়, কিন্তু প্রোফাইল ছবি বদলায় না।

এক সময় আমরা চেয়েছিলাম মিডিয়ার নৈতিকতা। ভেবেছিলাম সংবাদ মানে দায়িত্ব, মতামত মানে ভারসাম্য। কিন্তু এখন মিডিয়া খুললেই দেখা যায়, খবরের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে টুলবারের ইমোজি। হাসব, কাঁদব, রাগ করব—সবই এক ক্লিকে। ভাবার দরকার নেই, যাচাই করারও না। শেষমেশ মনে হয়, আমাদের সমাজ এখন কথা বলে না, পোস্ট করে। সংস্কৃতি চর্চা করে না, ট্রেন্ড ফলো করে। আর শোভা? সে তো আজকাল শুধু হ্যাশট্যাগে সুন্দর।

উপসংহার: ব্যঙ্গ আর আশা—ছোবলের মাঝেরে এক চিরন্তন গল্প

২০২৫ সালটা যেন এক দীর্ঘ ম্যাজিক শো—মঞ্চে আলো ঝলমল, ঘোষণার ফুলঝুরি, স্লোগানের আতশবাজি, আর দর্শকসারিতে চুপচাপ বসে থাকা নাগরিকসমাজ—যারা চেয়েছিল ভবিষ্যৎ, কিন্তু পেয়েছে ভবিষ্যতের ট্রেইলার। উন্নয়নের নাম ধরে ডাকা হলো শত প্রকল্প; কিন্তু কোথাও গিয়ে দেখা গেল, উন্নয়নটা দাঁড়িয়ে আছে গর্তের ভেতরে, আর লোকজন গর্ত দেখে ছবি তুলে বলছে, “এটাই বুঝি গভীর রাষ্ট্র!”

বাজার চেয়েছিলাম স্থিতিশীল, পেয়েছি টগবগে জ্বলন্ত কড়াই, যেখানে প্রতিদিন দ্রব্যমূল্যের তেলে নতুন কিছু ভাজা হয়। শিক্ষা চেয়েছিলাম যেখান থেকে জ্ঞান বের হবে, কিন্তু পেয়েছি এমন পাঠ্যক্রম, যা দেখে ছাত্ররাও বলে, “স্যার, এই প্রশ্নটা কি বাস্তবে আসবে, না শুধু নাটকে থাকবে?” রাজনীতি চেয়েছিলাম শান্তিপূর্ণ, পেলাম এমন উত্তপ্ত কাব্য, যেখানে প্রতিটি বাক্যেই লুকিয়ে থাকে ব্যালটের চেয়ে বুলেটের ভয়। আর নিরাপত্তা? সে তো এখন সাইনবোর্ডের নাম—রাতে কেউ চুরি করলে পুলিশ আসে সকালবেলা, যেন তারা তদন্ত করছে 'ঘুমন্ত চোরের মনস্তত্ত্ব'।

তবুও আমরা হাল ছাড়ি না। আমাদের জাতীয় চরিত্রের সবচেয়ে হাস্যকর কিন্তু শ্রদ্ধার যোগ্য দিক হলো—আমরা সব জেনেও হাসতে জানি। আমরা গর্তে পড়ে গিয়ে বলি, “ভাগ্যিস এখানে ইন্টারনেট ছিল!” চালের দাম বাড়লে বলি, “ভাত না থাকলেও ভাষা আছে তো!” এই ব্যঙ্গ আমাদের তির, এই হাসি আমাদের ঢাল—যাতে আমরা প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাই, তাও ঝগড়া না করে, বিদ্রুপ করে।

কারণ বাংলার মাটি, বাংলার মানুষ—এরা একবারও জিততে না পারলেও বারবার চেষ্টা করে। আমাদের হাসি ক্ষণিকের নয়, তা আত্মস্থ করার এক পরিণত চর্চা। আর যদি সেই হাসির সঙ্গে যোগ হয় সচেতনতা, দৃঢ় সংকল্প আর দায়িত্ববোধ, তবে একদিন এই ব্যঙ্গ আর কষ্টের মিশ্রণে গড়া মানুষরাই এই দেশটাকে সোজা করে তুলবে—গর্ত নয়, গর্জনে।

তাই ২০২৫ সাল আমাদের শিখিয়ে দিল—হাসতে হাসতে ভাগ্য বদলায় ঠিকই, তবে বদলের জন্য পাঁজর শক্ত করে হাসতে হয়। আর সে শক্তি, সেই হাসি, সেই ব্যঙ্গ—এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের ভিতরে আজও জেগে আছে, প্রস্তুত হয়ে আছে ২০২৬-এ এক নতুন ইতিহাস লেখার জন্য।

⚠️ ডিসক্লেইমার (Disclaimer)

এই লেখাটি একটি রম্য–ব্যঙ্গাত্মক (Satirical) সম্পাদকীয় ফিচার। এখানে ব্যবহৃত ঘটনাবলি, উপমা, সংলাপ, চরিত্র ও বর্ণনা সামগ্রিক সামাজিক বাস্তবতার প্রতীকী সাহিত্যিক উপস্থাপন—কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে নয়।

এই লেখায় উপস্থাপিত মতামত ও বিশ্লেষণ মূলত রূপকের আবরণে মোড়ানো সাহিত্যিক ব্যঙ্গচর্চার অংশ, যা কোনো তথ্যভিত্তিক দাবি, আইনগত অবস্থান কিংবা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তরূপে বিবেচনার জন্য নয়। এর লক্ষ্য কাউকে ছোট করা বা আঘাত করা নয়; বরং ব্যঙ্গ-রসের আলোকে সময়ের জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার অনুপ্রেরণা জোগানো, বিতর্ক ও সংলাপের এক মুক্ত পরিসর তৈরি করা। আমরা পাঠকের ভিন্নমত, পৃথক ব্যাখ্যা ও বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। যদি কোনো পাঠক এই লেখার কোনো অংশে নিজস্ব অভিজ্ঞতা, কোনো গোষ্ঠীর বাস্তবতা কিংবা কোনো ঘটনার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান, তবে তা নিছক কাকতালীয় ও অনিচিত সংযোগ হিসেবে বিবেচিত হোক—এই বিনীত অনুরোধ রইল।

হাসুন, ভাবুন—কিন্তু অপমান নয়, সংলাপই হোক আমাদের পথ

(আপনার মতামত আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান কমেন্ট বক্সে জানান আপনার ভাবনা তবে অনুরোধবিনা কারণে রিলস বা অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও শেয়ার করবেন না!)

প্রফেসর মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

#২০২৫বাংলাদেশ  #বাংলাদেশসম্পাদকীয় #ব্যঙ্গফিচার #সামাজিকব্যঙ্গ #উন্নয়নবাস্তবতা #বাংলাদেশরাজনীতি #বাংলাদেশঅর্থনীতি #শিক্ষাব্যবস্থা #স্বাস্থ্যসেবা #বাজারদর #ডিজিটালবাংলাদেশ #সামাজিকসংকট #EditorialBangla #BanglaFeature #SatireBangla



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: