
আজ আমাদের বয়স্কব্যক্তিদের মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অর্থাৎ দেশের প্রায় ৬ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ এই রোগের শিকার। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রতি পঞ্চম ডায়াবেটিস-আক্রান্ত মানুষ হলেন এক জন ভারতীয়। একটি দেশে সর্বাধিক ডায়াবেটিস আক্রান্তের নিরিখে আমাদের অবস্থান চীনের ঠিক পরেই। এর থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে এ দেশে দশ কোটিরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হবেন।
ভারতীয়রা জিনগত ভাবে বেশি ডায়াবেটিস প্রবণ। তবে বর্তমানে যে ডায়াবেটিসের আধিক্য দেখা যাচ্ছে এর কারণ শারীরিক কসরতের অভাব এবং অধিক ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা। এর ফলে আমাদের সমাজে মোটা হওয়ার প্রবণতা খুব বেড়ে যাচ্ছে। তবে মোটা নন এমন মানুষও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এঁদের বেশির ভাগেরই তলপেটে চর্বি জমে ভুঁড়ির আকৃতি নেয়। মানসিক স্ট্রেস বা চাপও ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ।
সত্যি কথা বলতে কি ডায়াবেটিস ভালো করে দেওয়ার কোনও চিকিৎসা এখনও নেই। তবে মানব জেনোম প্রকল্পের অগ্রগতির দরুন সুদূর ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস ভালো করে দেওয়ার চিকিৎসা শুরু হলেও হতে পারে। তবে অদূর ভবিষ্যতে তার কোনও সম্ভাবনা নেই।
তবে ডায়াবেটিসকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আক্রান্ত মানুষজন প্রায় সাধারণ জীবনযাপন করতে পারেন।
ফলে প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করাই শ্রেয়। ভালো হয়ে যাওয়ার দুরাশায় অন্য কিছু চেষ্টা করে অর্থ ও সময় নষ্ট করে কোনও লাভ নেই।
সবচেয়ে প্রচলিত হল টাইপ-২ ডায়াবেটিস (আগে এটা ‘ম্যাচিওরিটি অনসেট ডায়াবেটিস’ বা ইনসুলিন লাগে না এমন ডায়াবেটিস নামে পরিচিত ছিল)। এই ডায়াবেটিসের উপর জিনের প্রভাব অত্যন্ত জোরালো। ফলে আপনার ডায়াবেটিস থাকলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা হবে ৪০ শতাংশ।আপনার স্ত্রী/স্বামীরও ডায়াবেটিস থাকলে এই সম্ভাবনা বেড়ে দাঁড়াবে ৯০ শতাংশে। তবে মনে রাখতে হবে ডায়াবেটিস হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশেরও একটা বিশেষ ভূমিকা আছে।
ভাল খবর হল যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যায়। আপনার ছেলেমেয়ে স্বাস্থ্যসচেতন জীবনযাপন করলে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সম্ভাবনা অন্তত ৫০ শতাংশ কমাতে পারবে। তার মানে তাদের ভাজা ও স্নেহ পদার্থযুক্ত খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। খাদ্যতালিকায় তাজা ফল ও সবজির পরিমাণ বাড়াতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। (যেমন জোরে হাঁটা, সাইকেল চালানো বা জগিং করা। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দৈনিক ৩০ মিনিট জগিং করলেও চলবে। ছোটবেলায় এদের শারীরিক কসরৎ হয় এমন খেলাধূলায় আকৃষ্ট করতে হবে এবং কম্পিউটার গেমসের মতো ঘরে বসে খেলায় যথাসম্ভব অনুৎসাহিত করতে হবে)। দেখতে হবে তারা যাতে স্বাভাবিক শারীরিক ওজনের হয়, চর্বিযুক্ত পেটের অধিকারী যেন না হয়।
আপনাকে ফের প্লাজমা গ্লুকোজ পরীক্ষা করতে হবে। হয় আট থেকে দশ ঘণ্টা উপোসে থাকার পর অথবা ৭৫ মিলিগ্রাম গ্লুকোজ নেওয়ার ২ ঘণ্টা বাদে পরীক্ষা করতে হবে। এই পরীক্ষার ফলাফল যদি বিশেষ ভাবে অস্বাভাবিক হয় তা হলে বুঝতে হবে আপনার ডায়াবেটিস রয়েছে। বর্তমানে ডায়াবেটিস নির্ণয়ের যে মান ধরা হয় তা হল, খালি পেটে পরীক্ষায় প্লাজমা গ্লুকোজের পরিমাণ ১২৬ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারের সমান বা তার চেয়ে বেশি। এবং খাবারের মাধ্যমে গ্লুকোজ নেওয়ার দু’ঘণ্টা পর পরীক্ষা করলে তা যদি ২০০ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারের বেশি বা তার সমান হয়। এ ক্ষেত্রে কোনও লক্ষ্মণ ধরা না পড়লেও আপনাকে চিকিৎসা করাতে হবে। (একেবারে শুরুতে জীবনযাত্রার ধরন পাল্টানোর দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। একদম গোড়াতেই ওষুধ নেওয়ার প্রয়োজন নেই।)
ডায়াবেটিসকে ‘নিঃশব্দ ঘাতক’ বলা হয়। এই রোগ নিঃশব্দে আপনার দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। শেষ পর্যন্ত যখন লক্ষ্মণ দেখা দিল তখন চিকিৎসা শুরু করাটা হয়তো দেরি হয়ে যাবে। ডায়াবেটিস হৃদরোগ ও সেরিব্রাল স্ট্রোকের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২-৩ গুণ বাড়িয়ে দেয়। ডায়াবেটিসের কারণে অনেক সময় পা কেটে বাদ দিতে হতে পারে। পূণর্বয়স্কদের অন্ধত্বের অন্যতম কারণই হল ডায়াবেটিস। এই রোগ কিডনির ক্ষতি করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে কিডনির অকার্যকারিতা,বয়স্ক মানুষদের ডায়ালিসিস করা ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের অন্যতম কারণই হল ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের গাফিলতি এই ধরনের জীবনহানিকর স্থায়ী জটিলতার পাশাপাশি অন্য জীবননাশক জটিলতার জন্ম দিতে পারে যেমন ডায়াবেটিক কিটোসাইডোসিস (diabetic ketoacidosis)। বিভিন্ন ধরনের জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। ঠিক সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে এবং তা নিয়মিত ভাবে চালিয়ে গেলে এই ধরনের বেশির ভাগ জটিলতাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
ধূমপায়ীদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সাধারণদের তুলনায় বেশি থাকে। ধূমপান বন্ধ করে দিলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণেও কিছুটা সুবিধা হয়।
তবে ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ধূমপান বন্ধ করতে বলা হয় তার প্রধান কারণ হল, তামাক(যে কোনও ধরনের তামাকের ব্যবহার) ডায়াবেটিস জনিত অন্যান্য জটিলতা যেমন, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি ও চোখের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ডায়াবেটিস ধরা পড়ে রক্তে উচ্চ পরিমাণ শর্করা থাকলে। কিন্তু ডায়াবেটিস রয়েছে এমন ব্যক্তির এমন কিছু জটিলতা থাকতে পারে যা হৃদরোগ, স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। যেমন উচ্চ রক্তচাপ বা রক্তে মাত্রাতিরিক্ত স্নেহজাতীয় পদার্থের উপস্থিতি।(যেমন ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’কোলোস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড) সুতরাং ডায়াবেটিসের প্রকৃত চিকিৎসা শর্করার নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়েও করতে হয়। যেমন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তে লিপিড ঠিকমতো বজায় রাখা। এ ক্ষেত্রে ধূমপান ছেড়ে দেওয়া বিশেষ জরুরি। অ্যাসপিরিনের ব্যবহারও রক্তকে তরল রাখতে সাহায্য করে।
এমন কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই যা থেকে বলা যায় অ্যালকোহল হৃদরোগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। যদিও তা রক্তে কিছুটা ‘ভালো’ কোলোস্টেরল বাড়ায় (যা এইচডিএল নামে পরিচিত)। সুতরাং ‘হার্ড ড্রিঙ্কস’ ডায়াবেটিস আছে বা নেই এমন কোনও ব্যক্তির হৃদরোগের সম্ভাবনা কমায় এটা বলা যায় না।
অ্যালকোহলের পরিমাণ বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস আক্রান্তদের অতিরিক্ত জটিলতা বাড়ে। যেমন—
- ক) ওজন বেড়ে যায়।
- খ) নিয়মিত অ্যান্টি-ডায়াবেটিক ওষুধ নেওয়ার ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ অতিরিক্ত কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।(হাইপোগ্লসিমিয়া)
- গ) অ্যালকোহল ইনসুলিন উৎপাদনকারী প্যানক্রিয়াসের ক্ষতি করে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বাড়ায়।
- ঘ) যাঁদের দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস রয়েছে তাঁদের স্নায়ুর ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তবে মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রিত মদ্যপান ক্ষতিকারক নয়।
ডায়াবেটিস কী রকম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আপনাকে মাঝেমাঝেই তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। শুধুমাত্র লক্ষ্মণের উপর নির্ভর করে পরীক্ষা করাবেন কিনা, চিকিৎসকের কাছে যাবেন কিনা—এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। যদিও আপনি এখন সুস্থ বোধ করছেন তবুও সাধারণ নির্দেশিকা হিসাবে নিয়মিত নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলি করা উচিত
শরীরের ওজন এবং রক্তচাপ |
প্রতি ৩ থেকে ৬ মাসে |
---|---|
পায়ের পাতা পরীক্ষা |
প্রতি ১২ মাসে |
রক্তে শর্করার পরিমাণ |
প্রতি ২ মাসে (যাঁরা ইনসুলিন-নির্ভর চিকিৎসা করছেন তাঁদের ক্ষেত্রে আরও কম সময়ে পরীক্ষা করতে হবে।) |
ব্লাড গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন |
প্রতি ৪ থেকে ৬ মাসে |
ব্লাড ক্রিয়েটানিন, লিপিড প্রোফাইল |
প্রতি ১২ মাসে |
ইউরিন মাইক্রোঅ্যালবুমিন ক্রিয়েটানিন রেশিও |
প্রতি ১২ মাসে |
(তথ্য সংগৃহীত)
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: